ভিয়েনা সম্মেলনের কার্যাবলির একটি সমালোচনামূলক মূল্যায়ন করো

ভিয়েনা সম্মেলনের কার্যাবলির একটি সমালোচনামূলক মূল্যায়ন করো
ভিয়েনা সম্মেলনের কার্যাবলির একটি সমালোচনামূলক মূল্যায়ন করো।

ভূমিকা

নেপোলিয়নের পতনের পর বিজয়ী শক্তিবর্গ অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেন। এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপের তীব্র অস্থিরতা দূর করে নিরবিচ্ছিন্ন শান্তি প্রতিষ্ঠা করা, এবং ইউরোপের পুনর্গঠন, পুনর্বণ্টন করা। সম্মেলনের নেতৃবর্গ ন্যায়, সততা প্রভৃতি উচ্চ আদর্শের কথা প্রকাশ্যে বললেও তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিপ্লব (ফরাসি) প্রসূত ভাবধারা দমন করা এবং ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল নিজেদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া। নিজেদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে এবং শক্তিসাম্যের দিকে লক্ষ রেখে এই সম্মেলনে মূলত তিনটি নীতি অনুসরণ করা হয় সেগুলি হল (১) ন্যায্য অধিকার, (২) ক্ষতিপূরণ ও (৩) শক্তিসাম্য। 

ভিয়েনা-সম্মেলনের সমালোচনা

আধুনিক ইউরোপের কূটনীতির ইতিহাসে ভিয়েনা কংগ্রেস একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হলেও সম্মেলনে নানাভাবে সমালোচিত হয়েছিল-

প্রকৃত সম্মেলন নয়: ভিয়েনা সম্মেলনে ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশ অংশ গ্রহণ করলেও ইংল্যান্ড, রাশিয়া, প্রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্স এই পাঁচটি শক্তি মুখ্যভূমিকা গ্রহণ করে। সব সিদ্ধান্ত আগের থেকেই গোপন বৈঠক করে ঠিক করে রাখা হত। ফলে যোগদানকারী অন্যান্য দেশগুলির কোনো ভূমিকাই ছিল না। স্বাভাবিক কারণেই এই সম্মেলনকে প্রকৃত সম্মেলন বলাই যায় না।

নীতি প্রয়োগের ত্রুটি: ভিয়েনা কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ বাস্তবে যে তিনটি নীতি (ন্যায্য অধিকার, ক্ষতিপূরণ, শক্তি সাম্য) প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন তা বাস্তব ক্ষেত্রে সব জায়গায় সমানভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়নি অর্থাৎ নিজেদের তৈরি করা নীতি নিজেরাই মেনে চলেননি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ভেনিসে পূর্বের ন্যায় প্রজাতন্ত্র ফেরানো হয়নি। অর্থাৎ ইটালির ক্ষেত্রে ন্যায্য অধিকার প্রয়োগ করা হয়নি।

গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদকে ধ্বংস সাধন:
ফরাসি বিপ্লব ইউরোপের দেশগুলিতে যে জাতীয়তাবাদের জোয়ার এনেছিল, ভিয়েনা চুক্তি প্রণেতাগণ সেই জাতীয়তাবাদকে অবজ্ঞা করে লক্ষ লক্ষ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা উপেক্ষা করে গণতন্ত্র, উদারতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের ধ্বংস সাধন করেছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় সমস্ত জার্মান জাতিকে এক রাষ্ট্র গঠন করতে না দিয়ে এক অসংবদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্র শাসনব্যবস্থা স্থাপন করা হয় এবং অস্ট্রিয়াকে এর সভাপতিত্বদান করা হয়। ইটালির জাতীয়তাবাদকে উপেক্ষা করে ইটালিকে আবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত করে দিয়ে ভৌগোলিক সংজ্ঞায় পরিণত করা হয়।

নিমর্মতা : ভিয়েনা সম্মেলনের উদ্যোক্তারা নতুন নতুন ভূখণ্ড লাভের জন্য এতটাই লালায়িত ছিল তারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তিগুলির সম্পত্তি অধিকার করতে একটুও পিছুপা হয়নি। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তিগুলির স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলির কোনো ব্যাপারই মনে হয়নি অর্থাৎ তারা ক্ষুদ্র ও অসহায় জাতিগুলির প্রতি নির্মম ছিল। ঐতিহাসিক গ্রান্ট ও টেম্পরলি মন্তব্য করেছিলেন যে, ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলির প্রতি অশ্রদ্ধা ছিল ভিয়েনা সম্মেলনের মারাত্মক ত্রুটি।

ঘোষিত উচ্চ আদর্শের বাস্তবায়নে অনীহা : সম্মেলনের প্রারম্ভে কর্মকর্তারা অনেক উচ্চ আদর্শের কথা ঘোষণা করলেও বাস্তবে তা পর্যবসিত হয়নি বরং নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করা এবং গোপন চুক্তি কার্যকরী করাই প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

প্রতিক্রিয়াশীল :
ভিয়েনা সম্মেলনের কর্ণধাররা সকলেই ছিলেন রাজতন্ত্র ও স্বেচ্ছাচারে বিশ্বাসী ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিবিদ। নানা অজুহাতে, বিশেষত ন্যায্য অধিকার নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে তারা ইউরোপে ফরাসি বিপ্লবের পূর্বের অবস্থাকেই ফিরিয়ে আনেন।

অযৌক্তিকতা: ভিয়েনা-কংগ্রেস পোল্যান্ডবাসীর আকাঙ্ক্ষা পূরণ না করে পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদ এবং জাতি ধর্ম ঐতিহাসিক বিবর্তন উপেক্ষা করে বেলজিয়ামকে হল্যান্ডের অধীনে স্থাপন-এই দুই ব্যবস্থাই ছিল অযৌক্তিক।

অস্থায়িত্ব: ভিয়েনা সম্মেলনে যেসব চুক্তি ও ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছিল তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। জুলাই বিপ্লব (১৮৩০ খ্রি.) ফেব্রুয়ারি বিপ্লব (১৮৪৮ খ্রি.) এবং ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে জার্মানি ও ইটালির ঐক্য প্রতিষ্ঠার ফলে ভিয়েনা সম্মেলনের অধিকাংশ চুক্তি ও সিদ্ধান্ত বাতিল হয়। টীকা ৭০ লক্ষা

সম্পদ ভাগ করে নেওয়া: ভিয়েনা সম্মেলনের নেতৃবর্গ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করার জন্য নিজেদের মধ্যে বিজিতদের সম্পদ ভাগ করে নিয়েছিলেন। বিপ্লব প্রসূত সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার আদর্শগুলি ধ্বংস করার প্রচেষ্টা করেছিলেন।

কালের গতির বিরুদ্ধাচরণ: ভিয়েনা সম্মেলনের প্রতিনিধিরা বিপ্লব প্রসূত নব আদর্শ ও পুরাতনতন্ত্রের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে ব্যর্থ হয়। ফলে তারা যুগধর্মকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছিলেন। অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে তারা তাল মেলাতে ব্যর্থ হন। ঐতিহাসিক গর্ডন ক্রেইগ বলেছেন যে, ভিয়েনা সম্মেলনের উদ্যোক্তারা তখন ফরাসি বিপ্লব প্রসূত আধুনিক ভাবধারাগুলি প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে ইউরোপে অশান্তি দেখা দিত।

উপসংহার

ভিয়েনা চুক্তির বিপক্ষে যুক্তিহীন স্বীকার করেও বলা যায় এই চুক্তি দ্বারা ইউরোপে বহুদিন শান্তি ও স্থিতি স্থাপিত হয়। ইউরোপে অন্তত ৪০ বছর শান্তি আসে।

Leave a Comment