মানুষের বিজ্ঞাননির্ভরতা ও তার সংকট প্রবন্ধ রচনা

মানুষের বিজ্ঞাননির্ভরতা ও তার সংকট প্রবন্ধ রচনা

মানুষের বিজ্ঞাননির্ভরতা ও তার সংকট – পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম হাতিয়ার হল বিজ্ঞান। দৈনন্দিন জীবন থেকে গ্রহান্তরে জীবনের সন্ধান করা- প্রতিটি ক্ষেত্রে বিজ্ঞানই হয়েছে মানুষের একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু সবক্ষেত্রে মানুষের বিজ্ঞাননির্ভরতা কখনও মানুষের আবেগ অনুভূতি ও পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সংকট তৈরি করে দিচ্ছে কিনা এটাই হয়ে উঠেছে একুশ শতকের চেতনাসম্পন্ন মানুষের অন্যতম বিবেচ্য বিষয়।

মানুষের বিজ্ঞাননির্ভরতা ও তার সংকট প্রবন্ধ রচনা
মানুষের বিজ্ঞাননির্ভরতা ও তার সংকট প্রবন্ধ রচনা
মানুষের বিজ্ঞাননির্ভরতা ও তার সংকট
“তোমার কাজ/ আগুনকে ভালোবেসে উন্মাদ হয়ে যাওয়া নয়/ আগুনকে ব্যবহার করতে শেখা।”
-বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

ভূমিকা:

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম হাতিয়ার হল বিজ্ঞান। দৈনন্দিন জীবন থেকে গ্রহান্তরে জীবনের সন্ধান করা- প্রতিটি ক্ষেত্রে বিজ্ঞানই হয়েছে মানুষের একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু সবক্ষেত্রে মানুষের বিজ্ঞাননির্ভরতা কখনও মানুষের আবেগ অনুভূতি ও পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সংকট তৈরি করে দিচ্ছে কিনা এটাই হয়ে উঠেছে একুশ শতকের চেতনাসম্পন্ন মানুষের অন্যতম বিবেচ্য বিষয়।

বিজ্ঞানের অবদান:

আজকের গোটা মানবসভ্যতাই বিজ্ঞানের অবদান। প্রতিদিনের জীবনে সকাল থেকে সন্ধে বিজ্ঞানকে সঙ্গে নিয়েই মানুষ চলে। বিজ্ঞান যোগাযোগ ব্যবস্থায় এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। শরীরে অদৃশ্য ডানা লাগিয়ে মানুষ এখন অনায়াসে চলে যেতে পারে পৃথিবীর যে-কোনো প্রান্তে। হাতের মুঠোয় থাকা মোবাইল ফোন মুহূর্তে সংযোগ গড়ে দেয় অন্য গোলার্ধের কোনো মানুষের সঙ্গে। শুধু কথা বলা নয়, লাইন, স্কাইপ ইত্যাদির সাহায্যে মা তাঁর বহুদূরে থাকা ছেলেকে পর্দায় দেখতে পারেন। কৃষিতে বিজ্ঞানের প্রয়োগ নিয়ে এসেছে যুগান্তর। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতি মৃত্যুকে হয়তো পরাজিত করতে পারেনি, কিন্তু মানুষের জীবনকালকে আরও দীর্ঘ করেছে। কম্পিউটারের আবিষ্কার আলাদিনের আশ্চর্যপ্রদীপের সন্ধান দিয়েছে মানুষকে। নেট- ব্যাংকিং, অনলাইন কেনাকাটা থেকে শুরু করে রাস্তাঘাটের হদিস-সবই সম্ভব হয় ইনটারনেট সংযোগের মাধ্যমে। বিজ্ঞানের কল্যাণে পৃথিবীর বুকে আজ মানুষের ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর।

সংকটের স্বরূপ:

 দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের প্রতি মানুষের ঝোঁক তাকে ক্রমশই ভোগবাদের প্রতি আকৃষ্ট করে তুলছে। সুখস্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি আকর্ষণ মানুষের মধ্যে জন্ম দিচ্ছে সীমাহীন লোভ ও চাহিদার। মানুষ নিজের সুখের স্বার্থে পৃথিবীর অন্য প্রাণীদের অবহেলা করছে, তাদের থাকার জায়গার সংকট তৈরি করছে, মানুষ তার নিজের স্বার্থে জীববৈচিত্র্যকে বিপন্ন করছে। ভোগবাদী চাহিদা যে ইঁদুরদৌড়কে আহ্বান করছে তা শৈশবকে অনাবশ্যক চাপে ফেলে দিচ্ছে, তৈরি হচ্ছে মানসিক অবসাদ। আমরা এমন একটা সমাজ তৈরি করছি যেখানে টাকাপয়সাই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণের প্রধান মাপকাঠি হয়ে উঠেছে। আর নৈতিক মূল্যবোধ, নান্দনিক ধারণা সেখানে ক্রমশ অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে।

প্রযুক্তির প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতা

মানুষকে যন্ত্রমানবে পরিণত করেছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, সহানুভূতির জায়গাগুলো ক্রমশই নষ্ট হচ্ছে। মানুষ ক্রমে ক্রমে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। ফলে সামাজিকতাবোধের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। যন্ত্রকে ব্যবহার করে নানা অপরাধমূলক কাজকর্ম ঘটছে। সাইবার ক্রাইম তো আধুনিক সমাজের সর্বস্তরে আতঙ্কের বিষয় হয়ে উঠছে। টুইটার, ফেসবুক ইত্যাদি সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করেও নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। অতিরিক্ত যন্ত্রনির্ভরতা, বিশেষত কম্পিউটারের সর্বাত্মক ব্যবহার মানবসম্পদের বিকাশের ক্ষেত্রকে সংকুচিত করে দিচ্ছে।

উপসংহার:

বিজ্ঞানের সঠিক ব্যবহারই পারে এই সংকটমুক্তি ঘটাতে। অব্যাহত রাখতে হবে শিল্প-সাহিত্যের চর্চাকে, আর নিয়ন্ত্রণ করতে হবে নগরায়ণকে। মনে রাখতে হবে বিজ্ঞানের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য বিজ্ঞান। তবেই তৈরি হতে পারে শঙ্কামুক্ত এক সুন্দর পৃথিবী।

কম্পিউটার ও আধুনিক পৃথিবী প্রবন্ধ রচনা

কম্পিউটার ও আধুনিক পৃথিবী প্রবন্ধ রচনা
কম্পিউটার ও আধুনিক পৃথিবী প্রবন্ধ রচনা
কম্পিউটার ও আধুনিক পৃথিবী প্রবন্ধ রচনা
“নমো যন্ত্র, নমো যন্ত্র, নমো যন্ত্র, নমো যন্ত্র”।
–মুক্তধারা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ভূমিকা:

মানবসভ্যতার গতিপথকে পালটে দেওয়া বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর আবিষ্কার হল কম্পিউটার। মানুষের জ্ঞান এবং প্রচেষ্টার সীমানাকে বহুদূর অবধি বিস্তৃত করে দিয়েছে কম্পিউটার। পুরোনো পৃথিবীর সঙ্গে নতুনের সীমাহীন ব্যবধান তৈরি করে মানবসভ্যতার সামনে এই কম্পিউটারই হাজির করেছে এক শিহরণ জাগানো ভবিষ্যতের ছবি, যা কিছু বছর আগেও মানুষের ভাবনাচিন্তার বাইরে ছিল।

আবিষ্কার:

অনেকে মনে করেন খ্রিস্টের জন্মেরও আগে ‘অ্যাবাকাস’ নামে যে গণনাপদ্ধতি প্রচলিত ছিল তার মধ্যেই নিহিত আছে কম্পিউটারের আদি ইতিহাস। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজ গণিতজ্ঞ চার্লস ব্যাবেজকে ‘কম্পিউটারের জনক’ বলা হয়। ১৯৩০-এ হওয়ার্ড আইকেন এবং গ্রেস হপার সাধারণের ব্যবহারের উপযোগী কম্পিউটার তৈরি করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মানিতে, ব্রিটেনে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটারের দ্রুত বিবর্তন ঘটে। সেখান থেকে এখন মানবসভ্যতা এসে পৌঁছেছে পঞ্চম প্রজন্মের কম্পিউটারে।

ভারতে কম্পিউটার:

ভারতে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম কম্পিউটার আসে। কিন্তু আটের দশক থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কম্পিউটারের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে ভারত সরকার রাষ্ট্রীয় স্তরে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। পৃথিবীতে কম্পিউটার উৎপাদনে ভারত যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে তেমন কম্পিউটার গবেষণায় ন্যাশনাল সেন্টার ফর সফটওয়্যার টেকনোলজি, টাটা ইন্সটিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়-প্রতিষ্ঠানগুলি নিরলস প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।

কম্পিউটারের প্রয়োগ :

আধুনিক সভ্যতায় কম্পিউটারের প্রয়োগ সর্বত্র। যে-কোনো হিসাবনিকাশে, আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রদানে, চিকিৎসাবিজ্ঞানে, মুদ্রণ শিল্পে কম্পিউটারের ব্যবহার বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। উপগ্রহ যোগাযোগ, যান চলাচলের সিগন্যালিং ব্যবস্থা সবই কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত। আবার রেল-বিমানের আসন সংরক্ষণ থেকে টেলিফোন, ইলেকট্রিক বিল প্রদান-ব্যক্তিগত জীবনেও কম্পিউটারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কম্পিউটারের সাহায্যেই আন্তর্জাতিক সংযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডার চলে আসে ঘরের মধ্যে। তাই হাটে- বাজারে, অফিসে-আদালতে, স্কুল-কলেজে কম্পিউটারের আজ সর্বাত্মক ব্যবহার ঘটছে। ডেক্সটপ, ল্যাপটপ, পামটপ ইত্যাদি নানা চেহারায় কম্পিউটার আজ মানুষের ব্যক্তিগত জীবনযাপনের সঙ্গী হয়ে উঠেছে।

অন্য কথা:

কম্পিউটার অসম্ভবের সীমারেখাকে প্রায় মুছে দিয়েছে। কিন্তু এই কম্পিউটারই মানুষের প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে দিয়ে মানবসম্পদের সংকট তৈরি করেছে। কম্পিউটার মানুষকে শুধু যন্ত্রনির্ভরই করেনি, জীবনযাপনের অন্য উপকরণগুলি যেমন, বইপড়া, ছবি আঁকা এসব থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। সিনেমা, গান ইত্যাদিকে কম্পিউটার এতটাই সহজলভ্য করে দিয়েছে যে, এদের কেন্দ্র করে যে ব্যাবসা হয় তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দীর্ঘকালীন কম্পিউটারের ব্যবহার নানা শারীরিক সমস্যাকেও ডেকে আনছে।

উপসংহার:

কম্পিউটার ব্যবহারের ইতিবাচক দিকগুলি দেখলে কম্পিউটার সম্পর্কে বিরূপ ধারণাগুলিকে নিতান্তই ছোটো মনে হয়। একুশ শতকের গতিশীল পৃথিবীর কম্পিউটার কোনো অলংকার নয়, মস্তিষ্ক। তাই এর সার্থক ব্যবহার এবং উন্নতিতে আত্মনিয়োগই আধুনিক মানবসভ্যতার অনিবার্য নিয়তি। মার্কিন লেখক যোশেফ ক্যাম্পবেল হয়তো যথার্থই বলেছেন-“Computers are like Old Testament Gods; lots of rules and no mercy.”

Leave a Comment