ভিয়েনা সম্মেলনের প্রধান নীতিগুলি উল্লেখ করো

ভিয়েনা সম্মেলনের প্রধান নীতিগুলি উল্লেখ করো – আজকের পর্বে ভিয়েনা সম্মেলনের প্রধান নীতিগুলি উল্লেখ করা হল।

    ভিয়েনা সম্মেলনের প্রধান নীতিগুলি উল্লেখ করো

    ভিয়েনা সম্মেলনের প্রধান নীতিগুলি উল্লেখ করো
    ভিয়েনা সম্মেলনের প্রধান নীতিগুলি উল্লেখ করো।

    ভূমিকা

    ভিয়েনা সম্মেলন ছিল পৃথিবীর প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন। ওয়াটারলুর যুদ্ধে নেপোলিয়নের চূড়ান্ত পরাজয়ের পর ইউরোপের রাষ্ট্রব্যবস্থার পুনর্গঠন, পুনর্বণ্টন অদ্ভুত রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুষ্ঠু সমাধান, বিপ্লবী ভাবধারার গতিরোধ ও ইউরোপে নিরবচ্ছিন্ন শান্তি রক্ষার জন্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রনায়করা ভিয়েনা সম্মেলনের আহ্বান করেছিলেন। এই সম্মেলনে মূলত তিনটি নীতি গৃহীত হয়- (১) ন্যায্য অধিকার (২) ক্ষতিপূরণ (৩) শক্তি সাম্য। 

    ন্যায্য অধিকার নীতি (Legitimacy)

    ইউরোপে যথা সম্ভব প্রাক্-বিপ্লবী অবস্থার পুনঃপ্রবর্তন করাই ছিল ন্যায্য অধিকার নীতির মূল কথা। অর্থাৎ ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে যেখানে যে রাজা বা রাজবংশ রাজত্ব করত ন্যায্য অধিকার নীতি অনুসারে প্রাক্-বিপ্লব যুগের সেইসব রাজাদের ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই ছিল ন্যায্য অধিকারের মূলকথা।

    এই নীতি অনুসারে প্রাক্-বিপ্লবযুগের যেসব রাজা ও রাজবংশকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়।

    ফ্রান্স : ফ্রান্সের সিংহাসনে ফিরিয়ে আনা হয় বুরবোঁ রাজবংশকে, সিংহাসনে বসেন অষ্টাদশ লুই।

    ইতালি: উত্তর ইটালিতে অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। হয়। দক্ষিণ ইটালিকে আগের সমস্ত রাজ্যে আবার ভাগ করে পূর্বতন রাজপরিবারগুলিকেই সিংহাসন ফিরিয়ে দেওয়া হয়। পোপ ন্যায্য অধিকার নীতি অনুসারে মধ্য ইটালি রাজ্য আবার ফিরে পায়।

    জার্মানি: জার্মানিতে অস্ট্রিয়ার আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়। 

    স্পেন: স্পেনে বুরবোঁ বংশীয় রাজারা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হন। হল্যান্ডের সিংহাসন ফিরে পায় অরেঞ্জ বংশ।

    এ ছাড়াও ফরাসি বিপ্লব ও নেপোলিয়নের উত্থানের ফলে বিতাড়িত বৌ রাজবংশ যেগুলি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় সেগুলি হল সিসিলি ও নেপলস-এ বুরবোঁ রাজবংশ সার্ডিনিয়া ও পিডমন্টে স্যাভয় রাজবংশ প্রভৃতি।

    ক্ষতিপূরণ নীতি

    নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলিকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য যে নীতিটি গৃহীত হয় তা ক্ষতিপূরণ নীতি নামে পরিচিত।

    আর্থিক ক্ষতিপূরণ

    ফ্রান্সের কাছ থেকে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ 90 কোটি ফ্রাঙ্ক বরাদ্দ করা হয়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশকে নানা অঞ্চল প্রদান-

    ইংল্যান্ডকে ক্ষতিপূরণ প্রদান: ইংল্যান্ড ক্ষতিপূরণ বাবদ লাভ করে সিংহল, দক্ষিণ আফ্রিকার স্পেনগুলি ভূমধ্যসাগরের মাল্টাদ্বীপ, মরিশাস, হেলিগোল্যান্ড আইডনিয় দ্বীপপুঞ্জ, ফ্রান্স এবং স্পেনের কয়েকটি বন্দর।

    রাশিয়াকে ক্ষতিপূরণ প্রদান : রাশিয়াকে ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রদান করা হয় ফিনল্যান্ড, বেসারাবেরিয়া এবং পোল্যান্ডের এস্টারেড অংশ।

    প্রাশিয়াকে ক্ষতিপূরণ দান: প্রাশিয়া লাভ করে স্যাপ্পানির উত্তরাংশ ডানজিক, রাইন, পোমেরানিয়া পোজেন, থর্ন প্রভৃতি অঞ্চল ও রাইন নদীর বামতীর।

    অস্ট্রিয়া লাভ করে: অস্ট্রিয়াকে প্রদান করা হয় উত্তর ইতালির লোম্বার্ডি ও ভেনেসিয়া, টাইরল, সালজ বার্গ ও ইল্লিরিয়া ও পোল্যান্ডের কিছুটা অংশ।

    শক্তিসাম্য নীতি

    ফ্রান্স যাতে ভবিষ্যতে ইউরোপের অন্য কোনো রাষ্ট্র আক্রমণ করতে না পারে এবং ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলি যাতে একে অপরের চেয়ে অধিক শক্তিশালী হয়ে উঠতে না পারে সেজন্য যে ব্যবস্থা বা নীতিটি ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত হয় তাকেই বলা হয় শক্তিসাম্য।

    ফ্রান্স সম্পর্কিত ব্যবস্থা: ফ্রান্সের সৈন্যদল ভেঙে গিয়ে ফরাসি ভূখণ্ডে মিত্র সৈন্য রাখার ব্যবস্থা করা হয়। ফ্রান্সের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলির শক্তি বৃদ্ধি করে ফ্রান্সের চারধারে বৃহ্য তৈরি করা হয়। ফ্রান্সের ওপর বিরাট অঙ্কের ক্ষতিপূরণ চাপিয়ে দেওয়া হয়।

    শক্তিসমতা : হল্যান্ডের সঙ্গে বেলজিয়ামকে যুক্ত করা হয় উত্তর-পশ্চিম জার্মানিতে প্রাশিয়ার শক্তি বৃদ্ধি করে ইউরোপীয় শক্তিগুলির মধ্যে সমতা রাখার চেষ্টা করা হয়।

    এভাবে প্রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, রাশিয়া প্রভৃতি দেশকে এমনভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় যাতে একটি দেশ অপর একটি দেশের চেয়ে অধিক শক্তিশালী হয়ে না ওঠে এই ভাবেই শক্তিসাম্য রক্ষা করা হয়।

    পর্যালোচনা

    ভিয়েনা সম্মেলনের প্রধান নীতিগুলির সাফল্য ছিল নিম্নরূপ:

    অস্থিরতার অবসান :
    ফরাসি বিপ্লব ও নেপোলিয়নের উত্থানের ফলে ইউরোপে যে রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছিল ইউরোপের পুনর্গঠনের মাধ্যমে সেই সমস্যার সাময়িক সমাধান হয়েছিল।

    শান্তি প্রতিষ্ঠা :
    ভিয়েনা কংগ্রেসের নীতিগুলি দীর্ঘদিন ইউরোপে শান্তি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল। প্রায় চল্লিশ বছর ইউরোপে শান্তি বজায় ছিল।

    উপসংহার

    ভিয়েনা সম্মেলন দ্বারা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ফ্রান্স। ফ্রান্সের প্রতি অত্যন্ত অবিচার করা হয়েছিল। তবুও নিঃসন্দেহে এ কথা বলা যায় ভিয়েনা সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলি সম্পূর্ণরূপে যুগোপযোগী না হলেও এটি ছিল একটি যুক্তিসংগত ও রাষ্ট্রনীতিমূলক ব্যবস্থা।

    Leave a Comment