তোমার প্রিয় লেখক রচনা
তোমার প্রিয় লেখক রচনা |
“সাহিত্যের মজা হল যে, যা একবার লেখা হল, সেটা যদি পাঠকদের মনে ধরে যায় তাহলে লেখকের জীবনকালে তিনি যতই আদর পান, তিনি স্বর্গে গেলে, খালি সেরা বইগুলিকেই লোকে মনে রাখে! বাকিগুলো নিয়ে খালি পন্ডিতরা আর তাঁদের ছাত্ররা মাঝে মাঝে ঘাঁটাঘাঁটি করেন। কিন্তু যেগুলি সেরা লেখা, সেগুলি সাহিত্যে একটা চিরন্তন আসন পেয়ে যায়।”
-লীলা মজুমদার
ভূমিকা
জ্ঞানের কাঠিন্যকে অতিক্রম করে যাঁর লেখা আমাদের নিয়ে যায় স্বপ্ন-কল্পনার এক মায়াময় জগতে, যাঁর হাত ধরে সহজেই অতি তুচ্ছ রোজকার জীবন থেকে মুক্তি পাওয়া যায় অনায়াসে—সেই লীলা মজুমদার আমার প্রিয় লেখক।
ভালো লাগার কারণ
কোনো পণ্ডিতি ভাষা, শক্ত গদ্য তাঁর লেখায় পাওয়া যাবে না। সে লেখা পড়লে যেন মনে হয়, গল্প পড়ছি না, গল্প শুনছি স্বয়ং তাঁরই মুখ থেকে। সেসব গল্পের মেজাজ এতই সুন্দর, যে মনে হয় এ যেন আমাদের চেনা পৃথিবীর গল্পই নয়! রসের কারবারি একটি মানুষ তাঁর রসিক চোখে দেখে চলেছেন গোটা পৃথিবী, আর তারপর নিজের সহজাত বর্ণনদক্ষতায় সেইসব গল্প শুনিয়ে আসর জমাচ্ছেন। আশ্চর্য সব ঘটনা ঘটে তাঁর লেখা চরিত্রদের সঙ্গে।
‘কাগ নয়’ গল্পে ডিমের গায়ে আঁকবাঁকা অক্ষরে, ভুল বানানে লেখা থাকে ‘ডিমের ঠেলা ঠেল্কি যখণ বুঝবি তখণ বুঝবি’, ‘ময়নাশালিখ’ গল্পে দুই যমজ বোন ময়না আর শালিখ দাদুর সঙ্গে ছুরপি খেতে খেতে পাহাড়ে যায় বাবাকে খুঁজতে, ‘টংলিং’ গল্পে এক আশ্চর্য জায়গার সন্ধান মেলে যার নাম পেরিস্তান, আবার গুপি আর পানু মিলে তাদের ছোটোমামার সঙ্গে জোট বেঁধে নানান রহস্য উদ্ঘাটন করে। তাঁর বাবা ছিলেন বনের জরিপ বিভাগে কর্মরত। বাবার কাছে শোনা বাঘের নানান গল্প, হাতির গল্প জড়ো করে তিনি লিখেছেন বাঘের বই, হাতির বই। খুব ভালোবাসতেন বেড়াল-লিখেছেন বেড়ালের বই।
লিখনশৈলী
তাঁর লেখা ভূতের গল্প তো বাংলা সাহিত্যে একটি স্বতন্ত্র জায়গা করে নিয়েছে। যত সব অদ্ভুতুড়ে নামক বইতে রয়েছে আশ্চর্য সব ভূতেদের ততোধিক আশ্চর্য সব কাণ্ডকারখানা। বেশিরভাগই নিপাট ‘ভালোমানুষ’ শান্তশিষ্ট ভূত-তাদের না আছে রাগ, না আছে ভয় দেখানোর কারসাজি। কেউ কেউ তো আবার এইটাই বুঝে উঠতে পারেনি যে, তারা ভূত হয়ে গেছে। ‘অহিদিদির বন্ধুরা’ গল্পে আবার রয়েছে একদঙ্গল ছানাপোনা ভূত। একা মানুষ অহিদিদির নিঃসঙ্গতা ভোলানোর জন্য প্রতি সন্ধেবেলায় দল বেঁধে তারা অহিদিদির কাছে আসে পরির গল্প শুনতে।
আর অহিদিদিও তাদের সাধ মিটিয়ে নিমকি, কুচো চিংড়ি ভাজা, গোলাপি বাতাসা খাওয়ান। আশ্চর্য ভাষা তাঁর, আর তেমনি আশ্চর্য উপমা দেওয়ার ক্ষমতা- ‘পদিপিসির বর্মিবাক্স’ গল্পে যেমন কখনোই ভোলা যাবে না ‘চোখ ইজ জ্বলজ্বলিং’-এর কথা, তেমনই ‘বাঘের গল্প’-তে পিসিমার ডবল ডাবের বাড়ি মেরে বাঘ শায়েস্তা করার আশ্চর্য গল্পও রয়েছে। ‘বাতাসবাড়ি’, ‘হাওয়ার দাঁড়ি’, ‘ব্যাঘ্রবিজ্ঞান’-এইসব মজায় ভরপুর নানান কল্পবিজ্ঞানের গল্প তাঁর হাতে ফলেছে সোনার মতো।
উপসংহার
সবমিলিয়ে, লীলা মজুমদার এক আশ্চর্য মানুষ-যাঁর হাতে কলম আর কালি হয়ে যায় সোনার কাঠি আর রুপোর কাঠি, যা ছুঁইয়ে পাঠককে তিনি মুহূর্তেই নিয়ে চলেন অচিন দেশের রূপকথায়।
আরও পড়ুন – শৈশবের স্মৃতি রচনা