ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ফলাফলগুলি লেখো – আজকের পর্বে ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ফলাফলগুলি আলোচনা করা হল।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ফলাফলগুলি লেখো
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ফলাফলগুলি লেখো। |
ভূমিকা
বল্কান অঞ্চলে সংঘটিত ক্রিমিয়ার যুদ্ধ (১৮৫৪-৫৬ খ্রি.) ছিল ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির আন্তঃরাষ্ট্রীয় যুদ্ধ এবং অনেক ঐতিহাসিকের মতে, এটি ছিল অনাবশ্যক ও অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধ।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফলাফল
ক্রিমিয়ার (১৮৫৪-৫৬ খ্রি.) যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে-
(ক) রাশিয়ার বিস্তারনীতি
এই যুদ্ধে রাশিয়ার ভয়ানক মর্যাদাহানি হয়। কৃষ্ণসাগর এলাকায় রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী বিস্তারনীতি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল।
(খ) তুরস্ক সাম্রাজ্যের লাভ
তুরস্ক সাম্রাজ্য ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে শেষ না হয়ে আরও কিছুকাল নিরাপদে টিকে থাকার সুযোগ পায়।
(গ) মানব-সম্পদ ক্ষয়
ক্রিমিয়ার যুদ্ধে অপর প্রত্যক্ষ ফল ছিল যে, ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনা সন্ধির দ্বারা ইউরোপে অন্তত ৪০ বছরের জন্যে যে দীর্ঘশান্তি স্থাপিত হয়েছিল ক্রিমিয়ার যুদ্ধ তাতে যবনিকা টেনে দেয়। এই যুদ্ধ ছিল আধুনিক যুগের প্রথম লেক্ষ ক্ষয়কারী বৃহৎ যুদ্ধ যাতে ইউরোপের প্রধান শক্তিগুলি জড়িত ছিল। ক্রিমিয়া যুদ্ধের ভয়াবহতা ছিল সত্যিই মর্মান্তিক, এই যুদ্ধে যোগদানকারী দেশগুলির প্রায় পাঁচ লক্ষ লোকের প্রাণনাশ হয়। সেই যুগের লোকসংখ্যার অনুপাতে এই লোক ক্ষয় কম ছিল না। ১৮৯৫-১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে আর কোনো যুদ্ধে এত প্রাণহানি হয়নি।
তবে বলা যায় ক্রিমিয়ার যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফল ছিল প্রায় শূন্য ও গুরুত্বহীন। ক্রিমিয়ার যুদ্ধের মূল লক্ষ্য তুরস্কের সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষা ও তুরস্কের আধুনিকীকরণ কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। তুরস্ককে রক্ষা করা অপেক্ষা রাশিয়াকে হতমান করতে ব্রিটেন ও ফ্রান্স বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পরোক্ষ ফলাফল
পরোক্ষ ফলাফল বিচার করলে ক্রিমিয়ার যুদ্ধের গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়, যেমন :
(ক) ইংল্যান্ড ও রাশিয়ার স্বার্থরক্ষা
ইংল্যান্ড এই যুদ্ধের ফলে ঋণগ্রস্ত হয়ে প্রত্যক্ষভাবে কিছু লাভ না করলেও পরোক্ষভাবে লাভবান হয়। ভূমধ্যসাগরের দিকে রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ রক্ষা পায়।
(খ) ইটালির ঐক্য ত্বরান্বিত
পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার ফলে ইটালির ঐক্যসাধনের প্রশ্নটি বৃহত্তর ইউরোপীয় রাজনীতির সঙ্গে সংযুক্ত হয়। ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলি বিশেষত ফ্রান্স ইটালিকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেয়, এইভাবে ইটালির ঐক্যকরণের পথ প্রশস্ত হয়।
(গ) অস্ট্রিয়া-রাশিয়া বিরোধ
এই যুদ্ধের ফলে অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়। ফলে রাশিয়া ক্রমশ প্রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করে। সদিচ্ছায়ামাত
(ঘ) রাশিয়া-প্রাশিয়া মৈত্রী
রাশিয়ার সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে ফলে প্রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রি বিসমার্ক জার্মানিতে অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য বিনষ্ট করার সুযোগ লাভ করে এবং প্রাশিয়ার নেতৃত্বে জার্মানির ঐক্যসাধন সম্ভব হয়ে ওঠে।
(ঙ) রাশিয়ায় প্রতিক্রিয়া
এই যুদ্ধের ফলে রাশিয়ার প্রশাসনিক ও সামরিক দুর্বলতা প্রকট হয়ে ওঠে, এবং প্রশাসন ও অর্থনীতিতে বিপর্যয় দেখা দেয়। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সবদিক বিচার করে রাশিয়ার জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার (১৮৫৫-৮১ খ্রি.) রাশিয়ার অভ্যন্তরে ভূমিদাস প্রথা বিলোপসহ অন্যান্য সংস্কার করেন ও মধ্য এশিয়ায় বিস্তার নীতি গ্রহণ করেন।
১৮৪৮-এর ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর থেকে ইউরোপের বিভিন্ন শক্তিগুলির মধ্যে যে পারস্পরিক সন্দেহ ও বিদ্বেষের বিষ দেখা দেয়। তা ক্রিমিয়ার যুদ্ধে আরো বাড়ে। এর ফলে প্রতিটি রাষ্ট্র নিজ নিজ স্বার্থকেই বড়ো করে দেখে এবং সেই স্বার্থপূরণের জন্য তারা অস্ত্র ব্যবহার করতে থাকে।