বাংলা শব্দভান্ডার সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্ন ও উত্তর |
১। শব্দ কাকে বলে?
এক বা একাধিক ধ্বনি যুক্ত হয়ে সুস্পষ্ট অর্থপ্রকাশক শ্রুতিমধুর যে ভাষাখণ্ড তৈরি করে এবং যা বাক্যে স্বতন্ত্রভাবে ব্যবহৃত হতে পারে ও ভাষার নিজস্ব সংকলনে (অভিধানে শব্দকোশে) স্থান পাবার যোগ্য হয় তাকে শব্দ বলে।
২। শব্দভান্ডার কাকে বলে?
ভাণ্ডার শব্দটির অর্থ ‘কোশাগার’। শব্দের কোশ বা শব্দ সম্পদের আগারই শব্দভাণ্ডার।
৩। বাংলা শব্দভাণ্ডারের শব্দের রূপগুলি সারণির মাধ্যমে চিহ্নিত করো।
৪। সংস্কৃতমূল শব্দকে কটিভাগে ভাগ করা হয় ও কী কী?
সংস্কৃতমূল শব্দকে তিনভাগে ভাগ করা হয়। যথা- তৎসম, অর্ধতৎসম, তদ্ভব।
৫। তৎসম শব্দ কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
তৎসম = তদ্ + সম। তদ্ = তার (সংস্কৃত), সম = সমান, অনুরূপ। যে সমস্ত সংস্কৃত শব্দ বাংলা ভাষায় অবিকল, অবিকৃত বা অপরিবর্তিতরূপে গৃহীত ও ব্যবহৃত হয়, তাদের তৎসম শব্দ বলে। যেমন-গৃহ, পিতা, মাতা, চন্দ্র, সূর্য ইত্যাদি। বাংলা সাধুভাষার শতকরা প্রায় পঁয়তাল্লিশ ভাগ শব্দই তৎসম।
৬। অর্ধতৎসম শব্দ কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
অর্ধতৎসম = অর্ধেক সংস্কৃতের সমান বা অনুরূপ। যে সমস্ত সংস্কৃত শব্দ বাঙালির মুখের ভাষায় বা কবিতার ভাষায় উচ্চারণ সুবিধা বা বিকৃতিতে সামান্য পরিবর্তিত রূপে ও বানানে বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছে, তাদের অর্ধতৎসম শব্দ বলে। উদাহরণ : ‘বোষ্টম কেত্তন গাইছে’। বাক্যটিতে বৈয়ব ‘বোষ্টম’ হয়েছে, কীর্তন হয়েছে ‘কেত্তন’। পরিবর্তিত এই ‘বোষ্টম’ ও ‘কেত্তন’ শব্দ দুটিই অর্ধতৎসম শব্দ। এ ছাড়াও কুৎসিত > কুচ্ছিত, শ্রী > ছিরি, রৌদ্র > রোদ্দুর, জ্যোৎস্না > জোছনা, পুত্র > পুত্তুর, কৃষ্ণ> কেষ্ট ইত্যাদি। একে ভাঙা তৎসম বা ভগ্ন তৎসম শব্দও বলা হয়।
৭। তদ্ভব শব্দ কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
তদ্ভব = তৎ + ভব। তৎ = সংস্কৃত, ভব = জাত বা উৎপন্ন। যে সমস্ত সংস্কৃত শব্দ পালি-প্রাকৃত-অপভ্রংশের মধ্য দিয়ে এসে বাংলা ভাষায় নতুন রূপ পেয়েছে তাদের তদ্ভব শব্দ বলে।
৮। তদ্ভব শব্দ কত প্রকারের ও কী কী?
তদ্ভব শব্দ সাধারণত দুই প্রকারের। যথা- নিজস্ব তদ্ভব এবং কৃতঋণ তদ্ভব।
৯। নিজস্ব তদ্ভব শব্দ কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
বৈদিক বা সংস্কৃত যেসব শব্দ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলা শব্দরূপ পেয়েছে তাদের নিজস্ব তদ্ভব শব্দ বলা হয়। যেমন-
উপাধ্যায় > ওঝা, কৃষ্ণ > কানাই ইত্যাদি।
১০। কৃতঋণ তদ্ভব শব্দ কাকে বলা হয়? উদাহরণ দাও।
যেসব শব্দ অন্য ভাষা থেকে সংস্কৃতে এসে বিবর্তনের মাধ্যমে বাংলা শব্দরূপ পেয়েছে তাদের কৃতঋণ তদ্ভব শব্দ বলা হয়। যেমন- (গ্রিক) দ্রাগ্নে > (সংস্কৃত) দ্রম্য > (প্রাকৃত) দম্ম > (বাংলা) দাম।
১১/ অর্ধতৎসম ও তদ্ভব শব্দের মধ্যে মিল ও অমিল কোথায়?
মিল: (ক) এদের দুজনেরই মূল রূপটি সংস্কৃত। (খ) এরা দুজনেই সংস্কৃত রূপটি হারিয়ে ফেলেছে।
অমিল: (ক) তদ্ভব শব্দ তৎসম শব্দের বিবর্তিত রূপ। অর্ধতৎসম শব্দ তৎসম শব্দের বিকৃত রূপ।
(খ) তদ্ভব শব্দ বাংলার নিত্য ব্যবহার্য কথ্য ও লেখ্য ভাষার অধিকাংশ জুড়ে আছে। অর্ধতৎসম শব্দ মূলত উচ্চারণ বিকৃতি বা অশিক্ষিত, অশুদ্ধ উচ্চারণের ফল।
(গ) তদ্ভব শব্দ সাধু-চলিত উভয় ভাষারীতিতেই ব্যবহৃত। অর্ধতৎসম শব্দ চলিতভাষা, কথ্য উপভাষায় ব্যবহৃত।
১২। দেশি শব্দ কাকে বলে?
আর্যরা ভারতে আসার আগে কোল, ভিল, দ্রাবিড়, অস্ট্রিক ইত্যাদি গোষ্ঠী ভারতবর্ষে বাস করত। পরবর্তীকালে এইসব আদিম অধিবাসীদের ভাষার বহু শব্দই বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডারে স্থান পেয়েছে। বাংলাদেশের প্রাচীন বা আদিম অধিবাসীদের ভাষা (অনার্য ভাষা) থেকে যেসব শব্দ বাংলা ভাষায় স্থান পেয়েছে তাদেরই দেশি শব্দ বলে। যেমন-ঢেঁকি, ঝাঁটা, উলু, পাঁঠা, পেট, বাদুড়, মুড়ি, কুকুর ইত্যাদি।
১৩। দেশি শব্দ কত প্রকার ও কী কী?
দেশি শব্দ দুই প্রকার। যথা– জ্ঞাতমূল এবং অজ্ঞাতমূল।
১৪। জ্ঞাতমূল দেশি শব্দ কাকে বলে? একে কটি ভাগে ভাগ করা যায় ও কী কী?
যেসব দেশি শব্দের উৎস কোন্ আদিম ভাষা থেকে তা জানা যায়, তাকে জ্ঞাতমূল শব্দ বলে। একে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- দ্রাবিড়মূল দেশি শব্দ (তামিল) পিল্লৈ > পিলে। অস্ট্রিকমূল দেশি শব্দ চিংড়ি, ডাব, ঢাক, ঢোল।
১৫ । অজ্ঞাতমূল দেশি শব্দ কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
যেসব দেশি শব্দগুলির উৎস প্রাচীন উপলব্ধি করা গেলেও মূল খুঁজে পাওয়া যায় না, তাদের অজ্ঞাতমূল দেশি শব্দ বলে। যেমন-কোপাই, কাঁসাই, রিষড়া ইত্যাদি।
১৬ আগন্তুক শব্দ কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
ভারতের বাইরে থেকে বা ভারতের অন্য প্রদেশ থেকে যেসব শব্দ বাংলা ভাষার স্বরূপে বা কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে এসেছে তাদের আগন্তুক শব্দ বলে। যেমন-আতর, অজুহাত, কাঁচি, অক্সিজেন ইত্যাদি।
১৭। আগন্তুক শব্দকে কটি ভাগে ভাগ করা যায় ও কী কী?
আগন্তুক শব্দকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- বিদেশি শব্দ এবং ও ভারতের অন্য প্রদেশীয় শব্দ।
১৮। বিদেশি শব্দ কাদের বলে?
ভারতবর্ষের বাইরের দেশগুলি থেকে বিভিন্ন ভাষার যেসব শব্দ বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছে, তাদের বিদেশি শব্দ বলে।
১৯। কোন্ কোন্ বিদেশি ভাষা থেকে আগত শব্দ বাংলা শব্দভাণ্ডারে গৃহীত হয়েছে?
বাংলা শব্দভাণ্ডারে আরবি, ফারসি, তুর্কি, ইংরেজি, পোর্তুগিজ, ফরাসি, চিনা, জাপানি, বর্মি, ইতালীয়, ওলন্দাজ ইত্যাদি ভাষা থেকে আগত শব্দ গৃহীত হয়েছে।
২০। ভারতের অন্য কোন্ কোন্ প্রদেশের শব্দ বাংলা শব্দভাণ্ডারে গৃহীত হয়েছে?
বাংলা শব্দভাণ্ডারে গুজরাটি, মারাঠি, তামিল, তেলেগু, পাঞ্জাবি ইত্যাদি প্রাদেশিক ভাষা থেকে শব্দ গৃহীত হয়েছে।
২১। সংকর শব্দ বা মিশ্র শব্দ কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
এক ভাষার শব্দ, উপসর্গ, প্রত্যয় ইত্যাদির সঙ্গে অন্য ভাষার শব্দ, উপসর্গ, প্রত্যয় ইত্যাদি যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ গঠন করলে তাকে সংকর বা মিশ্র শব্দ বলে। যেমন-বিদেশি শব্দ + বাংলা প্রত্যয় = মাস্টারি।
২২। ভাষাঋণ বলতে কী বোঝো?
এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় উপাদান গ্রহণ আসলে ভাষাঋণ বা ভাষাধার; তা কখনও সম্পূর্ণরূপে অন্য ভাষায় আসে, কখনও বিদেশি ভাষাকে সরাসরি গ্রহণ না করে তার অর্থ অবিকৃত রেখে শব্দ বা বাক্য অনুবাদ করে ভাষায় নতুন শব্দ তৈরি হয়।
২৩। অনূদিত শব্দ কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
অন্য ভাষা, বিশেষত ইংরেজি ভাষা থেকে কিছু শব্দকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে। এই ধরনের শব্দকে অনূদিত শব্দ বলা হয়। যেমন- newspaper > সংবাদপত্র।
২৪। বিদেশি ভাষার অর্থ অবিকৃত রেখে অনুবাদে সৃষ্ট দুটি শব্দের উদাহরণ দাও।
ইংরেজি University > বাংলা বিশ্ববিদ্যালয়, ইংরেজি Wrist Watch > বাংলা হাতঘড়ি।