পৃথিবীপৃষ্ঠে অবস্থান নির্ণয়ের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করো |
ভূগোলে ‘স্থান’ ও ‘অবস্থান’ শব্দ দুটি ভূ-পৃষ্ঠে কোনো বিন্দু বা এলাকা চিহ্নিতকরণের জন্য ব্যবহার করা হয়। গোলীয় পৃষ্ঠ দেশে বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে আছে কত দেশ, শহর, গ্রাম, বসতি। এগুলো পৃথিবীর কোথায় আছে, তা জানা দরকার। সমুদ্রে কোনো জাহাজ বিপদগামী হলে উদ্ধারকারী দলকে দ্রুত সেখানে পৌঁছাতে হবে – সুতরাং জাহাজের অবস্থান জানা প্রয়োজন।
আবার কোনো জায়গার অবস্থান জানা থাকলে, সেখানকার স্থানীয় সময়, জলবায়ু, স্বাভাবিক উদ্ভিদ, মানুষের জীবনযাপন সম্পর্কে ধারণা করা যায়। এসবের জন্যই অবস্থান নির্ণয় প্রয়োজন।
অবস্থান নির্ণয়ের প্রয়োজনীয়তা :
(ক) প্রাকৃতিক ও অপ্রাকৃতিক বিষয়ের ঠিকানা জানতে অবস্থানের প্রয়োজনীয়তা:
পৃথিবীপৃষ্ঠে কোনো মহাদেশ, দেশ, রাজ্য, জেলা, গ্রামের মতো স্থলভাগ ও মহাসাগর ও সাগর ও উপসাগরের মতো জলভাগের ঠিকানা জানতে অবস্থান জানা প্রয়োজন।
আবার রৈখিক বিষয় যেমন রাস্তাঘাট, নদনদী প্রভৃতির ঠিকানা ও অবস্থান দ্বারাই জানা সম্ভব, এমনকি পৃথিবীপৃষ্ঠে অবস্থিত স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল ও টিউবওয়েলের মতো ক্ষুদ্র ঠিকানা জানতে অবস্থান জানা জরুরি।
(খ) মানচিত্রায়নে অবস্থানের প্রয়োজনীয়তা :
মানচিত্রায়নে মানচিত্রের প্রধান দুটি আবশ্যিক উপাদান হল অবস্থান ও ভৌগোলিক উপাদান। পৃথিবীপৃষ্ঠের সঠিক অবস্থান ছাড়া ভৌগোলিক উপাদান উপস্থাপন অর্থহীন। উদাহরণ সঠিক অবস্থানের সাপেক্ষে আন্টার্কটিকার তুষার ক্ষেত্রের বিস্তার না দেখিয়ে ভারতের থর মরুভূমিতে যদি এই তুষার ক্ষেত্রের বিস্তার দেখানো হয় তা যেমন অমূলক হয়ে ওঠে তেমনি আমাজন অববাহিকায় যেখানে সারা বছর বৃষ্টিপাত হয়, সেখানে সাহারা মরুভূমির বিস্তার দেখানোও তেমনি ভ্রান্ত ধারণার উপস্থাপন করে। তাই মানচিত্রে ভৌগোলিক উপাদান উপস্থাপনে অবস্থানের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
(গ) প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে অবস্থানের প্রয়োজনীয়তা :
কোন্ সম্পদ প্রকৃতির থেকে আহরণ করতে হবে, তা নির্বাচন যেমন দরকার তেমনি কোন্ স্থানে সম্পদ গচ্ছিত আছে তা জানাও প্রয়োজন। সম্পদের সঠিক অবস্থান না জানা থাকলে, দক্ষতার সঙ্গে তা আহরণ করা সম্ভব হয় না। যেমন কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে সমুদ্রে মাছের কেন্দ্রীভবন অনুসন্ধান করা যায়। মাছের অবস্থান জানতে পারলে GPS -এর সহযোগিতায় নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছালে, তা সংগ্রহ করা সম্ভব। মাছের ঝাঁকের অবস্থান পূর্ব নির্দেশিত না হলে, যত্রতত্র মাছের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতে হয়। তাই সম্পদ আহরণে পৃথিবীপৃষ্ঠের সম্পদ সঞ্চয়ের অবস্থান অত্যন্ত জরুরি।
(ঘ) সামরিক ক্ষেত্রে অবস্থান নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা :
সামরিক প্রয়োজনে লক্ষ্য বস্তুর অবস্থান সঠিকভাবে নির্ধারণ করা অত্যন্ত জরুরি। সঠিকভাবে অবস্থান নির্ণয় না করে আক্রমণ চালালে দেশের অভ্যন্তরের অংশও আক্রান্ত হতে পারে। যেমন – কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে শত্রু দেশের নির্দিষ্ট লক্ষ্য বস্তুর সঠিকভাবে অবস্থান নির্ধারণ করে নিজ দেশ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রয়োগ করা যায়।
(ঙ) নৌ বা আকাশপথ পরিক্রমণে অবস্থানের প্রয়োজনীয়তা :
সঠিক গন্তব্যস্থলের অবস্থান জানা থাকলে সমুদ্রপথে বা আকাশ পথে পূর্ব নির্ধারিত স্থানে কখনো পৌঁছানো সম্ভব নয়। যেমন আকাশপথে কলকাতা থেকে লন্ডন বা সিডনি যাওয়া স্থির হলে ওই দুটি স্থানের অবস্থান সঠিকভাবে জানা না থাকলে লন্ডন বা সিডনির পরিবর্তে অন্য স্থানে পৌঁছাতে হবে। তাই সঠিকভাবে গন্তব্যস্থলের অবস্থান জানা প্রয়োজন।
(চ) প্রকল্পের পরিকল্পনা ও প্রকল্প রূপায়ণে অবস্থানের প্রয়োজনীয়তা:
প্রকল্পের পরিকল্পনা ও রূপায়ণে অবস্থান নির্ধারণ অত্যন্ত জরুরি। যেমন কোনো জলবিদ্যুৎ প্রকল্প রূপায়ণে নদীতে আড়াআড়িভাবে বাঁধ দিয়ে বাঁধের পিছনে জলাশয় গঠন প্রয়োজন। এর জন্য উপযুক্ত স্থান নির্বাচন ও অবস্থান নির্ণয় প্রয়োজন। যেখানে নদী খাত সংকীর্ণ এবং এর সংলগ্ন অংশের শিলাস্তর কঠিন, সেই স্থানে প্রকল্প রূপায়ণ না হলে ব্যয় অধিক হতে পারে, বাঁধের স্থায়িত্ব ও প্রকল্প রূপায়ণে বাধার সৃষ্টি হতে পারে।
(ছ) সীমানা পরিবর্তনে :
সীমানা বা ‘Boundary’ পরিবর্তনে অবস্থান নির্ণয় জরুরি। যেমন- রাজনৈতিক সীমানা (Political Boundary) যেমন স্বাধীনতার পরবর্তীকালে ভারত ও পাকিস্তানের দেশ বিভাজনের ক্ষেত্রে অবস্থান নির্ণয় করে সীমানা নির্দিষ্ট করা হয়।