ফরাসি বিপ্লবের জন্য বুরবোঁ রাজতন্ত্র কতখানি দায়ী ছিল?

ফরাসি বিপ্লবের জন্য বুরবোঁ রাজতন্ত্র কতখানি দায়ী ছিল
ফরাসি বিপ্লবের জন্য বুরবোঁ রাজতন্ত্র কতখানি দায়ী ছিল?

ফরাসি বিপ্লবে বুরবোঁ রাজতন্ত্রের দায়িত্ব:

ফরাসি বিপ্লব ছিল রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ফরাসি জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। রাজতন্ত্রের দুর্বলতা ও স্বেচ্ছাচারিতা জনগণকে বাধ্য করেছিল বিপ্লবের পথ বেছে নিতে। বুরবোঁ রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা চতুর্দশ লুই ফ্রান্সে অতি কেন্দ্রীভূত স্বৈরাচারী শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ‘সূর্য রাজা’ নামে খ্যাত চতুর্দশ লুই মনে করতেন ঈশ্বরই তাঁর ক্ষমতার উৎস এবং তিনি হলেন রাষ্ট্র। শাসন পরিচালনায় প্রজাদের কোনো ভূমিকা ছিল না। এই কারণে 1614 খ্রিস্টাব্দের পর স্টেটস জেনারেল বা ফরাসি জাতির প্রতিনিধি সভার কোনো অধিবেশন আহ্বান করা হয়নি। বলা বাহুল্য তিনিও একটি সুসংহত রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেননি। চতুর্দশ লুই-এর উত্তরাধিকারী পঞ্চদশ লুই ছিলেন বিলাসী ও শাসনকার্য পরিচালনায় অযোগ্য। তাঁর সময় ফ্রান্স উত্তরাধিকার সংক্রান্ত যুদ্ধ ও সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার ফলে একদিকে যেমন রাজকোশ শূন্য হয়ে পড়ে অন্যদিকে তেমনি ফ্রান্সের আন্তর্জাতিক সম্মানও বিনষ্ট হয়। পঞ্চদশ লুই-এর পৌত্র ষোড়শ লুই সৎ ও ধার্মিক হলেও শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেননি। তাঁর সময়ে ফরাসি রাজতন্ত্রের পতন ঘটে। ষোড়শ লুই যদি দূরদৃষ্টি সম্পন্ন শাসক হতেন, তবে হয়তো এই বিপ্লবকে এড়ানো যেত।

রাজার ওপর অভিজাতদের প্রভাব : 

ষোড়শ লুইয়ের দুর্বলতার সুযোগে অভিজাতরা ফরাসি প্রশাসনের ওপর প্রভাব বিস্তার করেন। তা ছাড়া ষোড়শ লুইয়ের পত্নী মেরি আতোঁয়ানেতের ব্যক্তিগত জীবনযাপন পদ্ধতি তাঁকে প্রজাদের কাছে অপ্রিয় করে তোলে। নরম্যান হ্যানসন মনে করেন শাসনব্যবস্থায় অভিজাতদের হস্তক্ষেপ ফরাসি বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেছিল।

অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সংকট: 

ফ্রান্সে সরকারি রাজস্ব ব্যবস্থা ছিল বৈষম্যে পরিপূর্ণ। যাজক ও অভিজাত সম্প্রদায়ের মানুষ ছিল সীমাহীন সম্পত্তি ও অর্থের মালিক। ভূমিহীন কৃষক, দিনমজুর, শ্রমিক ও কিছু মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ সমস্ত করভার বহন করতেন। ফলে সমাজে একদিকে ছিল প্রাচুর্য, অন্যদিকে ছিল দুঃখ, দারিদ্র্য এবং অনাহার। দেশের ও প্রজাদের প্রয়োজন মেটাতে রাজাকে প্রায়ই ঋণগ্রহণ করতে হত।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসি রাজারা ইউরোপের বিভিন্ন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। ফলে যুদ্ধজনিত অর্থের ব্যয়ভার ফরাসি অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়ায় এবং ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তা ছাড়া সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের পর কানাডাও ফ্রান্সের হাতছাড়া হয়ে যায়। ভারতে ফরাসি উপনিবেশ দখল করে ইংরেজরা। ফলে ফরাসি জনগণ হতাশ হয়।

দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা : 

বিপ্লবের পূর্বে ফরাসি শাসনব্যবস্থায় বৈষম্য ও দুর্নীতি জনগণের দুর্দশা বৃদ্ধি করেছিল। ইনটেনডেন্ট নামক কর্মচারীদের জন্য জনসাধারণের দুর্ভোগের সীমা ছিল না। ফ্রান্সের বিচারব্যবস্থা ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত ও পক্ষপাতদুষ্ট। অভিজাতরা অর্থের বিনিময়ে রাজার কাছ থেকে ‘লেতর দ্য ক্যাশে’ নামে গ্রেফতারি পরওয়ানার সাহায্যে যে-কোনো ব্যক্তিকে বিনা বিচারে বন্দি করে রাখতে পারত। তা ছাড়া বিচারব্যবস্থা ছিল জটিল ও ব্যয়বহুল।

ষোড়শ লুইয়ের দায়িত্ব: 

বুরবোঁ রাজা ষোড়শ লুই-এর অযোগ্যতার ফলে অভিজাত সম্প্রদায় বিশেষ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। অভিজাতদের ক্রিয়াকলাপে ফ্রান্সে শাসনব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে। এই সত্য উপলব্ধি করা সত্ত্বেও ষোড়শ লুই অভিজাতদের বিরুদ্ধে কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেননি। ইতিহাসিক লেফেভর-এর মতে, ষোড়শ লুই যদি চতুর্থ হেনরি বা চতুর্দশ লুই-এর মতো যোগ্যতা সম্পন্ন হতেন তবে নিঃসন্দেহে ঘটনার গতি অন্যরকম হত। কিন্তু দুর্বলচিত্ত ষোড়শ লুই পরিস্থিতির যথার্থ মূল্যায়ন করতে না পেরে ঘটনার স্রোতে ভেসে গিয়ে বিপ্লব ডেকে এনেছিলেন।

মূল্যায়ন: 

এইভাবে দেখা যায় যে, রাজা ষোড়শ লুই স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রকে ক্রমে রানি ও অভিজাতদের স্বেচ্ছাচারিতার পীঠস্থানে পরিণত করেন। তথাপি অভিজাতরা ফরাসি বিপ্লবকে অনিবার্য করে তোলেন।

Leave a Comment