সাম্রাজ্য বিস্তারকালে নেপোলিয়ান ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম ভাবধারা জাতীয়তাবাদের কথা প্রচার করলেও তিনি জাতীয়তাবাদী ভাবধারার ওপরই পরবর্তীকালে আক্রমণ হেনেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, তাঁর ঘোষিত নীতি ও কার্যকলাপের মধ্যে বিরাট পার্থক্য ছিল। যে রাজ্যেই তিনি তাঁর ক্ষমতা ও সাম্রাজ্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছিলেন সেখানেই পুরাতনতন্ত্রসহ সামন্ততন্ত্রের পতন ঘটেছিল। ফলে প্রথম দিকে ইউরোপের মানুষ তাঁকে মুক্তিদাতা হিসেবে সম্মান জানিয়েছিল। কিন্তু খুব শীঘ্রই তাঁর প্রকৃত ভাবমূর্তি জনসাধারণের সামনে উন্মোচিত হলে তাঁর একনায়কতন্ত্রী, অত্যাচারী, ক্ষমতালোভী ও বংশ- গৌরবে বিশ্বাসী চরিত্রের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ফলে ইউরোপের মানুষের মধ্যে এক প্রতিরোধস্পৃহাসহ বৈপ্লবিক চেতনার সঞ্চার ঘটে।
জাতীয়তাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদঃ
নেপোলিয়ানের সাম্রাজ্যে জাতীয়তাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে একপ্রকার সংঘাত গড়ে উঠেছিল। ইটালি ও জার্মানিতে অস্ট্রিয়ার শক্তি খর্ব করে এবং প্রাশিয়াকে পরাজিত করে তিনি উভয় দেশের ভৌগোলিক জটিলতাকে দূর করেন। ফলে তাদের মধ্যে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটে। কিন্তু এই নবজাগ্রত জাতীয়তাবোধ আর তাঁর সাম্রাজ্যবাদী নীতির সঙ্গে বিস্তর তফাত ছিল। এইভাবে ইটালি, জার্মানি, স্পেন প্রভৃতি অঞ্চলের জনসাধারণের মনের মধ্যে যে সুপ্ত জাতীয়তাবোধের সঞ্চার হয়েছিল সেই নবজাগ্রত জাতীয়তাবোধ ও নেপোলিয়ানের সাম্রাজ্যবাদী নীতির সঙ্গে যখন সংঘাত বাঁধে তখনই নেপোলিয়ানের সাম্রাজ্য বিস্তারের নীতি দুর্বল হয়ে পড়ে ও তাঁকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়।
সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার আদর্শ:
কোড নেপোলিয়ান আইনবিধির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সঙ্গে নেপোলিয়ান বোনাপার্টের মুক্তিদাতা ভাবমূর্তি সমগ্র ইউরোপের কাছে প্রশংসনীয় হয়ে উঠেছিল। নেপোলিয়ানের সেনাবাহিনী যেখানেই প্রবেশ করেছিল ও নেপোলিয়ানের সাম্রাজ্য স্থাপিত হয়েছিল সেখানেই সামন্ততন্ত্রের পতন ও চার্চের প্রাধান্য লোপ পেয়েছিল। প্রতিভা ও যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিয়ে তিনি সাম্যকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কোড নেপোলিয়ানের মাধ্যমে তিনি সাম্যের বাণী প্রচার করে মুক্তিদাতার সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন। ফরাসি বিপ্লবের বাণী প্রচার করে তিনি ফরাসি বিপ্লবকে সমগ্র ইউরোপীয় বিপ্লবে রূপান্তরিত করেছিলেন। সে কারণেই নেপোলিয়ানকে বলা হত বিপ্লবের প্রতীক ও মুক্তির অগ্রদূত।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, একজন একনায়কতন্ত্রে বিশ্বাসী শাসকের অধীনে জনসাধারণের স্বাধীনভাবে থাকা কখনোই সম্ভব ছিল না। নেপোলিয়ান যুদ্ধের দ্বারাই সাম্রাজ্য বিস্তার করে সমগ্র ইউরোপের শাসনকর্তা হয়ে উঠেছিলেন। তাই তাঁর শাসনকালে যেমন গণতন্ত্রের কোনো স্থান ছিল না তেমনই জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। সুতরাং, তাঁকে মুক্তির দূত কিংবা বিপ্লবের প্রতীকরূপে চিহ্নিত করা যুক্তিসংগত নয়।