রাশিয়ার জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার কর্তৃক ভূমিদাস প্রথার অবসান সম্পর্কে আলোচনা করো

রাশিয়ার জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার কর্তৃক ভূমিদাস প্রথার অবসান সম্পর্কে আলোচনা করো
রাশিয়ার জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার কর্তৃক ভূমিদাস প্রথার অবসান সম্পর্কে আলোচনা করো

দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের উদ্যোগ: 

রাশিয়ার শাসককে (রাজা) জার বলা হত। জার প্রথম নিকোলাসের মৃত্যুর পর তাঁর দ্বিতীয় পুত্র দ্বিতীয় আলেকজান্ডার (1855- 1881 খ্রিস্টাব্দ) সিংহাসনে বসেন। দ্বিতীয় আলেকজান্ডার প্রজাকল্যাণকামী, সংস্কারবাদী, বাস্তববাদী ও দায়িত্ববান শাসক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তবে স্বৈরতন্ত্রের ওপরেও তাঁর বিশেষ আস্থা ছিল। কিন্তু প্রয়োজনে উদারনৈতিক সংস্কারের পথও তিনি অবলম্বন করেন। তিনি রাশিয়া তথা বিশ্ব ইতিহাসে দাসপ্রথার উচ্ছেদকারী হিসেবে সমাদৃত হন। এ ব্যাপারে আব্রাহাম লিঙ্কনের সঙ্গে তার নাম উচ্চারিত হতে পারে।

ভূমিদাস প্রথা: 

রাশিয়ায় বহুদিন ধরেই দাসপ্রথা চালু ছিল। আধুনিক যুগের শুরুতেও সেখানে এই প্রথা প্রবর্তিত থাকতে দেখা যায়। 1861 খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ায় 5 কোটি ভূমিদাস ছিল। এই ব্যবস্থা ছিল অমানবিক ও যুদ্ধের সম্পূর্ণ বিপরীত। ভূমিদাসদের জীবনযাত্রা ছিল অবর্ণনীয়। এই জগদ্দল পাথরের ভারে রাশিয়ার সমাজ ও অর্থনীতির অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।

ভূমিদাস প্রথা উচ্ছেদের পটভূমিকা: 

1861 খ্রিস্টাব্দের 19 ফেব্রুয়ারি জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার এক ঘোষণার দ্বারা ভূমিদাস প্রথার উচ্ছেদ করেন। ঐতিহাসিক লিপসনের মতানুযায়ী, পূর্বতন শাসকের কঠোর শৈত্যপ্রবাহ থেকে বর্তমান শাসনের উদারতা বসন্তের আগমনবার্তা বয়ে এনেছিল। (After the wintry rigour of the old regime, the miness of the new region gave promise of the down of spring.)

① ভূমিদাস প্রথার অপ্রয়োজনীয়তা : অনেক আগে থেকেই রাশিয়ার ভূমিদাস প্রথা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল। কারণ, রাশিয়ায় শিল্পবিপ্লব ও অন্তর্বাণিজ্য গড়ে ওঠায় স্বাধীন শ্রমিকের অত্যন্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তা ছাড়া কৃষিক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক ও উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে ভূমিদাসদের আর কোনো প্রয়োজন ছিল না।

② কৃষকদের ক্ষোভ: জারের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে কৃষকেরা উদারনৈতিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। এইরকম একটি বিদ্রোহ হল ডিসেমব্রিস্ট বিদ্রোহ। প্রথম নিকোলাসের আমলে 1845-1855 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে চারশোটি কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। তাই ঐতিহাসিক হ্যাজেন মনে করেন যে, রাশিয়ার ভূমিদাস প্রথা উচ্ছেদের পশ্চাতে কৃষক বিদ্রোহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

③ বুদ্ধিজীবীদের প্রভাব :
রাশিয়ার বহু লেখক ও বুদ্ধিজীবী দাসপ্রথার অবসানে কলম ধরেন। পুশকিন, টলস্টয়, তুর্গেনিভ, গোগোল, গ্লিনকা প্রমুখের নাম এই বিষয়ে উল্লেখযোগ্য।

④ দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের ভূমিকা :
এই অবস্থায় রাশিয়ায় জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার তাঁর উদারনৈতিক সংস্কারের দ্বারা এক ঘোষণায় ভূমিদাস প্রথার উচ্ছেদ করেন। রাশিয়ায় এভাবে ভূমিদাস প্রথার অবসান ঘটে।

মুক্তির ঘোষণাপত্র: 

1857 খ্রিস্টাব্দে একবার ভূমিদাস প্রথার উচ্ছেদের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু জমিদারদের বিরোধিতায় তা বাস্তবায়িত হয়নি। অবশেষে 1861 খ্রিস্টাব্দের 19 ফেব্রুয়ারি মুক্তির ঘোষণাপত্র জারি হয়। এই নির্দেশনামায় মোট 300টি পাতায় 22টি ধারার উল্লেখ ছিল। এতে বলা হয়-

① ভূমিদাসদের ওপর কোনো মালিকের কর্তৃত্ব বা অধিকার থাকবে না।

② মুক্ত ভূমিদাসদের জমি দিতে হবে এবং তাদের ওপর জমিদারদের কোনো অধিকার থাকবে না।

③ ভূমিদাসদের জমিগুলি পরিচালনার ভার ‘মির’ নামক গ্রাম্য সমিতির ওপর থাকবে।

④ জমিদারদের ক্ষতিপূরণ সরকার মিটিয়ে দেবে।

⑤ ‘মির’গুলি কর আদায়, কর জমা দেওয়া, সেনা সংগ্রহ ইত্যাদি কাজ করবে।

ফলাফল: 

ভূমিদাস প্রথার উচ্ছেদ দু-ধরনের ফলাফলই লক্ষ করা যায়। যথা-

সুফল:

① এর ফলে রাশিয়ার ইতিহাসে কলঙ্কময় অধ্যায়ের অবসান ঘটে এবং প্রগতিশীল সংস্কারের পথ উন্মুক্ত হয়।

② রাশিয়ার বাণিজ্য, কৃষির উপাদান এবং জমির মূল্যবৃদ্ধি ঘটে।

③ রাশিয়ায় শিল্পবিপ্লব ত্বরান্বিত হয়।

④ ভূমিদাসদের জীবনযাত্রায় গুণগত পরিবর্তন আসে।

⑤ রাশিয়া সংস্কারের দ্বারা উন্নতির পথে পা বাড়ায়।

⑥ রাশিয়া পরবর্তী বিপ্লবের জন্য তৈরি হতে শুরু করে।

কুফল:

① মুক্ত ভূমিদাসদের দেয় অর্থ (জমির জন্য) অনেক বেশি ছিল।

② মুক্ত ভূমিদাসদের ওপর চড়া হারে কর বসানো হয়।

③ অনুর্বর ও খারাপ জমিগুলি ভূমিদাসদের ভাগে পড়ে।

④ প্রয়োজনের তুলনায় ভূমিদাসদের জমির পরিমাণ ছিল অল্প।

⑤ ভূমিদাসদের উপর ‘মির’-এর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ⑥ভূমিদাসদের বিক্ষোভের কোনো অবসান হয়নি।

Leave a Comment