|
বিসমার্ক কীভাবে জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করেন |
ভূমিকা:
কূটনীতির জাদুকর এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী বিসমার্ক প্রায় সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় বহুধা বিভক্ত জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হন। বিসমার্ক বুঝতে পেরেছিলেন যে, জার্মানির ঐক্যের পথে সবচেয়ে বড়ো অন্তরায় হল অস্ট্রিয়া। তবে অস্ট্রিয়া ছাড়াও বিসমার্কের সামনে আর-একটি কঠিন বাধা ছিল- ক্যাথলিক ফ্রান্স। প্রোটেস্ট্যান্ট প্রাশিয়ার নেতৃত্বে জার্মান ঐক্যসাধন ক্যাথলিক ফ্রান্সের পক্ষে মেনে নেওয়া কখনোই সম্ভব ছিল না।
জার্মানির ঐক্যসাধনে বিসমার্কের গৃহীত পদক্ষেপ:
① রক্ত ও লৌহ নীতি:
প্রাশিয়ার জাতীয়তাবাদী জনগণ ও দেশপ্রেমিকরা প্রাশিয়ার নেতৃত্বে জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করার বাসনা পোষণ করত। বিসমার্ক তাদের বাসনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেন-প্রাশিয়ার উদারনীতির দ্বারা জার্মানির ঐক্য সম্পন্ন হবে না। প্রাশিয়ার সামরিক ক্ষমতাই জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করবে। বক্তৃতা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে নয়, রক্ত ও লৌহ নীতির মাধ্যমেই জার্মানির সমস্যার সমাধান করতে হবে। তাই তিনি প্রথম থেকেই সামরিক প্রস্তুতি ও সমরসজ্জার দিকে নজর দেন।
② যুদ্ধ নীতি:
পরপর তিনটি বিখ্যাত যুদ্ধের মাধ্যমে তিনি জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করেন- (i) 1864 খ্রিস্টাব্দে শ্লেজউইগ ও হলস্টেইনকে কেন্দ্র করে ডেনমার্কের সঙ্গে যুদ্ধ, (ii) 1866 খ্রিস্টাব্দে প্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রিয়ার সঙ্গে ‘স্যাডোয়ার যুদ্ধ এবং (iii) 1870 খ্রিস্টাব্দে সেডানের যুদ্ধে ফ্রান্সকে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে জার্মানির ঐক্য সম্পন্ন করেন।
(i) ডেনমার্কের সঙ্গে যুদ্ধ:
শ্লেজউইগ ও হলস্টেইন প্রদেশ বা ডাচি ছিল জার্মান অধ্যুষিত এবং ডেনমার্কের অধীন। 1852 খ্রিস্টাব্দে লন্ডন চুক্তির দ্বারা স্থির হয় যে, ডেনমার্কের রাজা এই ডাচি দুটির ওপর রাজত্ব করবেন কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তিনি ওই দুটি ডাচি বা প্রদেশকে তাঁর রাজ্যভুক্ত করতে পারবেন না। ডাচি দুটির স্বায়ত্তশাসন অধিকার আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্বীকৃত হয়। কিন্তু 1863 খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের রাজা এই চুক্তি ভঙ্গ করে প্রদেশ দুটিতে নতুন সংবিধান প্রবর্তন করতে চান। জার্মানির অধিবাসীদের স্বায়ত্তশাসন ক্ষুণ্ণ হয়েছে এই অজুহাতে বিসমার্ক অস্ট্রিয়ার সঙ্গে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হন। স্থির হয় যুদ্ধে জয়লাভ করলে অস্ট্রিয়া পাবে হলস্টেইন এবং প্রাশিয়া পাবে শ্লেজউইগ। 1864 খ্রিস্টাব্দে প্রাশিয়া এবং অস্ট্রিয়ার যৌথবাহিনী ডেনমার্ককে পরাস্ত করে। গ্যাস্টিনের চুক্তির দ্বারা ডাচি দুটির ওপর উভয় রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়।
অস্ট্রো-প্রাশীয় যুদ্ধের প্রস্তুতি: অস্ট্রিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ অনিবার্য ধরে নিয়ে বিসমার্ক কূটনৈতিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। প্রথমে তিনি বিয়ারিৎসের গোপন চুক্তি দ্বারা ফ্রান্সের নিরপেক্ষতা লাভ করেন। ইটালির নিরপেক্ষতা অর্জনের জন্য যুদ্ধ শেষে ভেনেসিয়া প্রদেশটি ইটালিকে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। পোল বিদ্রোহ দমনের জন্য প্রাশিয়া রাশিয়াকে নানাভাবে সাহায্য করায় রাশিয়া অস্ট্রিয়ার সঙ্গে আসন্ন যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকার প্রতিশ্রুতি দেয়।
(ii) স্যাডোয়ার যুদ্ধ:
কূটনৈতিক দিক থেকে অস্ট্রিয়াকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করার পর গ্যাস্টিনের চুক্তি ভঙ্গ করার অজুহাতে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে বিসমার্ক যুদ্ধ ঘোষণা করেন। সাত সপ্তাহ (1866 খ্রিস্টাব্দ) স্থায়ী স্যাডোয়ার যুদ্ধে অস্ট্রিয়া শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। প্রাগের সন্ধির মাধ্যমে অস্ট্রিয়া জার্মানি থেকে নির্মূল হয়ে যায়। জার্মানি ঐক্যলাভের পথে অনেকখানি এগিয়ে যায়। উত্তর জার্মানিতে প্রাশিয়ার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
ফ্রান্স ও প্রাশিয়ার যুদ্ধের কারণ: দক্ষিণ জার্মানির রাজ্যগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধ অনিবার্য ছিল। স্যাডোয়ার যুদ্ধে অস্ট্রিয়া পরাজিত হলেও ফরাসিরা মনে করত আসলে এই পরাজয় ছিল তাদের (ফ্রান্সের)। কারণ প্রাশিয়ার শক্তিবৃদ্ধি ফ্রান্সের নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটায়। বিসমার্ক ফ্রান্সকে মিত্রহীন করতে উদ্যোগী হন। আগে থেকেই রাশিয়ার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো ছিল। ইটালিকে রোম প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি তাকে নিজের পক্ষে আনেন। স্যাডোয়ার যুদ্ধের পর অস্ট্রিয়ার প্রতি বিসমার্ক কঠোর মনোভাব গ্রহণ না করায় অস্ট্রিয়া নিরপেক্ষ থাকে।
এমস টেলিগ্রাম : সমস্যাসমাধানের জন্য 1869 খ্রিস্টাব্দে প্রাশিয়ার রাজপরিবার হোহেনজোলার্ন বংশের সন্তান লিওপোল্ডকে আহ্বান করা হয়। হোহেনজোলার্ন বংশের এই শক্তিবৃদ্ধি ফ্রান্সের স্বার্থের পরিপন্থী ছিল। ফ্রান্সের চাপ ও আপত্তিতে লিওপোল্ড সরে দাঁড়ান। ফ্রান্সে এমস নামক স্থানে বিশ্রামরত প্রাশিয়ারাজ প্রথম উইলিয়ামের কাছে ভবিষ্যতে এই বংশের কেউ স্পেনের সিংহাসনে দাবি করবে না- এই প্রতিশ্রুতি দাবি করে ফরাসি রাষ্ট্রদূত কাউন্ট বেনিদিতিকে বিসমার্ক সেখানে পাঠান। সেখানে তাঁদের মধ্যে যে কথাবার্তা হয়েছিল তা টেলিগ্রাম মারফত বিসমার্ককে জানিয়ে দেন। এটিই বিখ্যাত এমস টেলিগ্রাম। সুচতুর ও কৌশলী বিসমার্ক এই টেলিগ্রামের কিছু অংশ রদবদল করে এমনভাবে খবরের কাগজে প্রকাশ করেন, যাতে মনে হয় প্রাশিয়ারাজ ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে অপমান করেছেন। টেলিগ্রামটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলে ফ্রান্স প্রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এটিই ছিল বিসমার্কের উদ্দেশ্য।
(iii) সেডানের যুদ্ধ:
1870 খ্রিস্টাব্দের সেডানের যুদ্ধে ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ান সম্পূর্ণভাবে পরাজিত এবং বন্দি হন। 1871 খ্রিস্টাব্দের ফ্রাঙ্কফুর্টের অপমানজনক সন্ধির দ্বারা ফ্রান্স আলসাস-লোরেনের ওপর আধিপত্য ত্যাগ করতে বাধ্য হয় এবং প্রাশিয়ার নেতৃত্বে একটি ঐক্যবদ্ধ জার্মান রাষ্ট্র গঠিত হয়। বিসমার্ক হন সেই রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী।