রুশ বিপ্লবের প্রভাব আলোচনা করো

রুশ বিপ্লবের প্রভাব আলোচনা করো
রুশ বিপ্লবের প্রভাব আলোচনা করো

রুশ বিপ্লবের প্রভাব: 

1917 খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লব শুধুমাত্র রাশিয়ার ইতিহাসে নয়, সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। সামগ্রিক বিচারে রুশ বিপ্লবকে আধুনিক পৃথিবীর অন্যতম গণতান্ত্রিক আন্দোলন হিসেবে আখ্যা দেওয়া যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসি বিপ্লব যেমন দীর্ঘদিন পর্যন্ত ইউরোপের চিন্তাজগতকে আলোড়িত করে, তেমনি রাশিয়ার বিপ্লবও আজ পর্যন্ত পৃথিবীর বড়ো বড়ো বিপ্লবী আন্দোলনগুলিকে অনুপ্রাণিত করে। এই কারণে ঐতিহাসিকদের মধ্যে অনেকেই রুশ বিপ্লবকে ‘মহাবিপ্লব’ নামে অভিহিত করেছেন। বিশ্ব ইতিহাসের ওপর রুশ বিপ্লবের প্রভাব ছিল বহুমুখী। যেমন-

① ধনতান্ত্রিক দেশগুলির আতঙ্ক : 

রাশিয়ার বিপ্লব ছিল পশ্চিমি সভ্যতার বিরুদ্ধে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। যে আর্থসামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আদর্শ ছিল ইউরোপীয় সভ্যতার মূল প্রাণশক্তি, রুশ বিপ্লবীদের লড়াই ছিল তারই বিরুদ্ধে। রুশ বিপ্লব ধনতন্ত্রী বুর্জোয়া সম্প্রদায়ের ওপর আঘাত হানার ফলে বিশ্বের ধনতান্ত্রিক সম্প্রদায়ের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। 1920 খ্রিস্টাব্দের পর ইটালি ও জার্মানিতে ফ্যাসিবাদী আন্দোলন প্রসারের মূলে ছিল সাম্যবাদী আদর্শের প্রতি ঘৃণা ও ভীতি। এই কারণে পৃথিবীর প্রথম সাম্যবাদী রাষ্ট্র হিসেবে রাশিয়ার আত্মপ্রকাশ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

② বিশ্বের মুক্তিসংগ্রামে অনুপ্রেরণা: 

1917 খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লব বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মুক্তিকামী মানুষকে বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত করে। চিনের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনেও রুশ বিপ্লবের প্রভাব লক্ষ করা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলিতে যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন দেখা দেয় সেখানেও বলশেভিক নেতৃবৃন্দ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ভিয়েতনাম, কিউবা, অ্যাঙ্গোলা, আরব, বাংলাদেশ ছিল এদের মধ্যে অন্যতম। ভারতবর্ষের জাতীয় আন্দোলনেও রুশ বিপ্লব বিশেষ প্রেরণা জুগিয়ে ছিল। স্বাধীন ভারতবর্ষের পুনর্গঠনেও রুশ বিপ্লবের অবদান কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণীয়। স্বাধীন ভারতের শিল্পোন্নয়নে সোভিয়েত রাশিয়ার কারিগরি সাহায্য ও সৈন্যবাহিনীর আধুনিকীকরণে সোভিয়েত রাশিয়ার সামরিক সহায়তা বিশেষ স্মরণীয়। বিশ্বের ধনতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে মুক্তি আন্দোলনে রুশ বিপ্লবের প্রভাব আজ সর্বজনস্বীকৃত। সোভিয়েত রাশিয়ার সহযোগিতায় পোল্যান্ড, চেকোশ্লোভাকিয়া, বুলগেরিয়া, রুমানিয়া প্রভৃতি সমাজবাদী রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। 1917 খ্রিস্টাব্দের বলশেভিক বিপ্লব বিশ্বের মানুষের মনে যে আশার আলো জাগ্রত করেছিল তা আজও অম্লান।

③ বিশ্বের আর্থিক উন্নয়নে সহায়তা: 

1917 খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লবের সাফল্যের পর লেনিন যে নতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তা উন্নয়নশীল দেশগুলিকে আর্থিক উন্নয়নের অনুপ্রেরণা জোগায়।। ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক প্রভৃতি দেশগুলিতে রাশিয়ার অনস্যত পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গৃহীত হয়।

④ মার্কসবাদী দর্শনের সফল প্রয়োগ: 

সাম্যবাদী সরকার প্রতিষ্ঠার পর সোভিয়েত সরকার কর্তৃক গৃহীত সংস্কারগুলি বিশ্বের অধিকাংশ দেশের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করেছিল। জাতীয় সম্পদের সুষম বণ্টন, কলকারখানার ওপর রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, ব্যক্তিগত মালিকানার বিলোপ প্রভৃতি ছিল রাশিয়া কর্তৃক গৃহীত আদর্শ। এগুলি বিশ্বের অধিকাংশ দেশে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গঠনে পরিচালকের ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। এর ফলে শ্রমিক শোষণের পথও যেমন রুদ্ধ হয়েছে তেমনি শ্রমিক কল্যাণমূলক আইন প্রণয়নেও রাষ্ট্রগুলি উদ্যোগী হয়েছে। ভারতসহ বিভিন্ন দেশে কয়লা, লোহা প্রভৃতি মৌলিক শিল্পগুলির রাষ্ট্রীয়করণের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকেই অনুসরণ করা হয়েছে। মার্কসবাদী দর্শনের সফল প্রয়োগ রাশিয়ার বিপ্লবেই প্রথম দেখা যায়। বর্তমানে বিশ্বের সমাজবাদী জাগরণ রাশিয়ার বিপ্লবের ফলেই সম্ভব হয়েছে।

⑤ অন্যান্য দেশে শ্রমিক শ্রেণির জাগরণ: 

বলশেভিক বিপ্লবের সাফল্য ও মার্কসবাদের বাস্তব প্রয়োগ অন্যান্য দেশেও শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির আন্দোলনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের আদর্শ বিভিন্ন দেশের শ্রমিক শ্রেণির রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি করে।

⑥ আমেরিকায় প্রভাব: 

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ’ আমেরিকার দেশগুলিতেও রুশ বিপ্লবের প্রভাবে শ্রমিকেরা ধর্মঘট ও আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের দাবি আদায়ের পথ গ্রহণ করে।

⑦ আন্তর্জাতিক সর্বহারা শ্রেণির সমর্থন: 

আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও রুশ বিপ্লবের গভীর প্রভাব লক্ষ করা যায়। রুশ বিপ্লবের সাফল্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশে সর্বহারা শ্রেণির যে আন্দোলন দেখা দিয়েছিল, নব প্রতিষ্ঠিত সোভিয়েত রাষ্ট্র তার প্রতি সমর্থন জানায়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র রাশিয়াকে ধ্বংস করার সাম্রাজ্যবাদী প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির শ্রমিকরাও আন্দোলন করে। এর ফলে নতুন আন্তর্জাতিক আন্দোলনের সূচনা হয়।

⑧ সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার বিরুদ্ধে ‘ন্যাটো’ গঠন :

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাম্যবাদী রাশিয়া ও ধনতান্ত্রিক দেশগুলির মধ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষ আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছিল। এর ফলে ধনতান্ত্রিক দেশগুলি সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে ‘ন্যাটো’-র মতো শক্তিজোট গঠন করে। অন্যদিকে সোভিয়েত রাশিয়াও পশ্চিমি ধনতান্ত্রিক দেশগুলির বিরুদ্ধে ‘ওয়ারশ’ চুক্তি গঠন করে।

মূল্যায়ন: 

সবশেষে বলা যায় যে, মানবজাতির সামনে এক নতুন সম্ভাবনার এবং নতুন সভ্যতার দুয়ার উন্মুক্ত করেছে রুশ বিপ্লব। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু মন্তব্য করেছেন যে, মানবসমাজের ইতিহাসে রুশ বিপ্লব এক বিশাল উল্লম্ফন এবং এর দ্বারা যে উজ্জ্বল শিখা প্রজ্বলিত হয়েছে তা নির্বাপিত করা যায়নি।

Leave a Comment