আমেরিকা অর্থনৈতিক মন্দা কীভাবে কাটিয়ে উঠেছিল?

আমেরিকা অর্থনৈতিক মন্দা কীভাবে কাটিয়ে উঠেছিল
আমেরিকা অর্থনৈতিক মন্দা কীভাবে কাটিয়ে উঠেছিল?

ভূমিকা: 

আমেরিকার জনগণ আর্থিক দুরবস্থার মধ্যেও তাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারায়নি। অর্থনৈতিক মন্দা প্রতিরোধে ব্যর্থ হলে 1932-1933 খ্রিস্টাব্দে আমেরিকায় প্রজাতন্ত্রী দলের শাসনের অবসান ঘটে এবং গণতান্ত্রিক দলের শাসন প্রবর্তিত হয়।

রুজভেল্টের শাসন: 

গণতান্ত্রিক দলের মনোনীত প্রার্থী ফ্র্যাঙ্কলিন ডিলানো রুজভেল্ট আমেরিকার নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ক্ষমতা লাভের পর রুজভেল্ট তাঁর শপথগ্রহণ বক্তৃতায় আমেরিকাবাসীকে আশ্বস্ত করে বলেন যে, আমেরিকার বর্তমান সমস্যা সমাধানযোগ্য। তাঁর বক্তব্য আমেরিকাবাসীর উদ্যমকে পুনর্জাগরিত করে।

রুজভেল্টের নতুন ব্যবস্থা : 

রুজভেল্ট আমেরিকাকে অর্থনৈতিক সংকট থেকে উদ্ধার করার জন্য কয়েকটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ইতিহাসে এই পরিকল্পনা ‘New Deal’ বা ‘নতুন ব্যবস্থা’ নামে পরিচিত।

নতুন ব্যবস্থার উদ্দেশ্য: 

রুজভেল্ট কর্তৃক গৃহীত নতুন ব্যবস্থার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তাঁর দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করা। রুজভেল্ট আর্থিক সংকট থেকে নিজ দেশকে মুক্ত করার জন্য বেকার সমস্যাসমাধানের চেষ্টা করেন এবং নতুন কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দেন। অধঃপতিত শেয়ার বাজারকে তেজি করার জন্য অর্থনৈতিক সংস্কারের কথা বলেন।

রুজভেল্ট কর্তৃক গৃহীত সংস্কার: 

তিনি তাঁর নতুন ব্যবস্থাকে কার্যকারী করার জন্য প্রশাসনিক আধিকারিকদের হাতে বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করেন। রুজভেল্ট তাঁর পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপতি হুবার কর্তৃক প্রবর্তিত কর্মসূচির অনেক কিছুই জারি রাখেন। রুজভেল্ট সরকার সামাজিক পরিকল্পনার বিভিন্ন কর্মসূচি (যেমন-শিশুশ্রম নিষিদ্ধকরণ, শ্রমিকের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ইত্যাদি) গ্রহণ করে। ব্যাংকিং, মুদ্রা ও ঋণ ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন এবং শুল্ক ব্যবস্থার আধুনিকীকরণের ফলে জনগণের মনে আত্মবিশ্বাস ফিরে আসতে থাকে।

রুজভেল্ট প্রণীত আইন: 

রুজভেল্ট প্রণীত আইনগুলির মধ্যে প্রথম ও অন্যতম ছিল ব্যাংকিং আইন। এই আইন রক্ষণশীল হলেও আমেরিকার ব্যাংক ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনেছিল। সাধারণ মানুষের গচ্ছিত টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক সংস্থাগুলিকে স্বল্পকালের জন্য সরকারের কর্তৃত্বাধীনে নিয়ে আসা হয়। রুজভেল্টের লক্ষ্য ছিল সাধারণ মানুষের কাছে নিজের অর্থ বাঁচানোর উদ্দেশ্য তুলে ধরা। শেয়ার বাজার সংগঠনকে ঢেলে সাজানোর জন্য রুজভেল্ট একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেন এবং শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রণ আইন পাস করেন। দেশের সমস্ত শেয়ার বাজারের ওপর লক্ষ রাখার জন্য ‘সিকিউরিটিস অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন’ গঠন করা হয়।

কৃষি সংস্কার: 

আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট কৃষিক্ষেত্রে একাধিক আইন প্রবর্তন করেন। তিনি কৃষকদের উৎপাদন হ্রাস করতে বলেন। এর ফলে কৃষিজাত পণ্যের মূল্য স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পায়। সরকার নতুন ব্যবস্থার মাধ্যমে ঋণগ্রস্ত কৃষকদের ঋণ থেকে মুক্তিদানের ব্যবস্থা করে। রুজভেল্ট সরকার ঋণদাতা ও গ্রহীতা উভয়ের দায়িত্বই গ্রহণ করে।

বেকার সমস্যাসমাধানের প্রচেষ্টা: 

অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে আমেরিকার লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। রুজভেল্ট সরকার একটি বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করার ফলে দেশের যুব সম্প্রদায়ের কর্মসংস্থান সম্ভব হয়। কাজের সঙ্গে তাদের বিনামূল্যে খাদ্য, বস্ত্র ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ করা হয়।

কেইনস্ পরিকল্পনা : 

রুজভেল্টের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের কাজে বিখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ স্যার জন মেনার্ড কেইনস্ বিশেষ সহায়তা করেন। কেইনস্-এর পরামর্শে জাতীয় শিল্প পুনরুদ্ধার আইনের ধারাগুলি তৈরি হয়। তিনি আমেরিকার দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য বিভিন্ন বাঁধ, সেতু, হাসপাতাল, বিমানবন্দর, সরকারি অফিস, বিদ্যালয় ইত্যাদি নির্মাণের কথা বলেন। এর ফলে নতুন নতুন কাজের সুযোগ তৈরি হয়।

শ্রমিক শ্রেণির জন্য সংস্কারমূলক আইন :

শ্রমিকদের কাজের সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য রুজভেল্ট কয়েকটি শ্রম আইন পাস করেন। ‘ন্যাশনাল ইনডাস্ট্রিয়াল রিকভারি’ আইনের মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার প্রদান করা হয়, প্রতিটি শিল্পের জন্য পৃথক আচরণবিধি রচনা করা হয়, শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করা হয় এবং দৈনিক কাজের সময় ৪ ঘণ্টা ধার্য করা হয়। শ্রমিকদের যে-কোনো অভিযোগ শোনার জন্য একটি শ্রম পর্ষদ তৈরি করা হয়।

রুজভেল্ট প্রণীত নতুন ব্যবস্থার সাফল্য: 

রুজভেল্ট গৃহীত নতুন ব্যবস্থার ফলে আমেরিকার লক্ষ লক্ষ কর্মহীন মানুষ কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছিল। সাধারণ আমেরিকাবাসীর মনে রুজভেল্টের শাসন সম্পর্কে আস্থা তৈরি হয়। এ কথা অনস্বীকার্য যে, অর্থনৈতিক মন্দার ফলে বিপর্যস্ত আমেরিকায় রুজভেল্ট কাজের সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। আর্থিক সংকটের সময় ফ্যাসিবাদ বা কমিউনিজমের গ্রাস থেকে রুজভেল্টের নতুন ব্যবস্থা আমেরিকাকে রক্ষা করেছিল।

রুজভেল্ট প্রণীত নতুন ব্যবস্থার ত্রুটি: 

রুজভেল্ট প্রণীত নতুন ব্যবস্থার বিভিন্ন কর্মসূচি কর বৃদ্ধিকে প্রয়োজনীয় করে তুলেছিল। বিত্তশালীদের ওপর কর বৃদ্ধির চাপ তাদের অসন্তুষ্ট করেছিল। ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় যে, নতুন ব্যবস্থায় কোনো সুসংগত বাণিজ্য নীতি প্রবর্তিত হয়নি। হেনরি ফোর্ডের মতন শিল্পপতিরা ‘ন্যাশনাল রিকভারি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ প্রণীত আচরণবিধি মানতে অস্বীকার করেন। নতুন ব্যবস্থা পরিস্থিতির ওপর আশানুরূপ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারেনি।

বুজভেল্ট প্রণীত নতুন ব্যবস্থার মূল্যায়ন :

রুজভেল্ট প্রণীত নতুন ব্যবস্থা সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ লক্ষ করা যায়। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, রুজভেল্ট প্রণীত নতুন ব্যবস্থা নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আমেরিকার অর্থনৈতিক স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে এনেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধই ছিল আমেরিকার কাছে আশীর্বাদস্বরূপ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন অস্ত্রের সব থেকে বড়ো ক্রেতা ছিল ব্রিটেন। আমেরিকা ব্রিটেনকে প্রায় 23 হাজার যুদ্ধ বিমান বিক্রি করে। এর ফলে আমেরিকায় কর্মহীন মানুষ বা বেকার ছিল না বললেই চলে। এভাবে অর্থনৈতিক মহামন্দা কাটিয়ে আমেরিকা পুনরায় বিশ্বের প্রধান ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

Leave a Comment