|
স্পেনের গৃহযুদ্ধে বিদেশি শক্তির ভূমিকা কী ছিল |
ভূমিকা:
স্পেনের গৃহযুদ্ধে জয়লাভ করে জেনারেল ফ্রাঙ্কো একনায়কতন্ত্র স্থাপন করেছিলেন। এই গৃহযুদ্ধে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। জার্মানির হিটলার ও ইটালির মুসোলিনি জেনারেল ফ্রাঙ্কোকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেছিলেন। তাঁরা আশা করেছিলেন স্পেনে একনায়কতন্ত্র স্থাপিত হলে জার্মানি ও ইটালির একনায়কতন্ত্র শক্তিশালী হয়ে উঠবে।
জার্মানির যোগদানের কারণ:
হিটলার স্পেনের গৃহযুদ্ধে তাঁর নতুন সামরিক অস্ত্রের উপযোগিতা পরীক্ষা করতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর অপর একটি উদ্দেশ্য ছিল জার্মানির আগ্রাসী নীতির প্রতি ইউরোপের প্রতিক্রিয়া যাচাই। তা ছাড়া স্পেনে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে জার্মানির চিরশত্রু- ফ্রান্সকে দুর্বল ও ব্যতিব্যস্ত রাখা।
ইটালির যোগদানের কারণ:
ইটালির সর্বাধিনায়ক মুসোলিনি জেনারেল ফ্রাঙ্কোকে সমর্থন করেছিলেন। তিনি আশায় ছিলেন, স্পেনে ফ্রাঙ্কোর একনায়কতন্ত্র স্থাপিত হলে ইউরোপেও একনায়কতন্ত্র শক্তিশালী হবে এবং ইটালিতে ফ্যাসিবাদ আরও সুদৃঢ় হবে। তা ছাড়া স্পেনে একনায়কতন্ত্র স্থাপিত হলে পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ইটালির প্রভাব বৃদ্ধি পাবে।
রাশিয়ার অংশগ্রহণ:
সোভিয়েত রাশিয়া স্পেনের গৃহযুদ্ধে প্রজাতন্ত্রী সরকারকে সমর্থন করেছিল। রাশিয়ার আশঙ্কা ছিল যে, ফ্রাঙ্কো জয়লাভ করলে স্পেনে একনায়কতন্ত্র স্থাপিত হবে। ইটালি, জার্মানি ও স্পেনে একনায়কতন্ত্র স্থাপিত হবে। ইটালি, জার্মানি ও স্পেনে একনায়কতন্ত্র স্থাপিত হলে রাশিয়ার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। রাশিয়া ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাম্যবাদী ও সমাজতন্ত্রীরা স্পেনের প্রজাতান্ত্রিক সরকারের পক্ষ সমর্থন করে প্রজাতন্ত্রের পক্ষে একটি আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গড়ে তুলেছিল।
ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের অবস্থান:
স্পেনের প্রজাতন্ত্রী সরকারের পক্ষে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সহানুভূতি থাকলেও তারা স্পেনের গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করেনি। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স একনায়কতন্ত্র অপেক্ষা সাম্যবাদকেই অনেক বেশি বিপজ্জনক বলে মনে করত। তাই তারা সমাজতন্ত্রী রাশিয়ার বিরুদ্ধে হিটলারকে তোষণ করতে শুরু করেছিলেন। স্পেনে হস্তক্ষেপ করলে যদি হিটলারের বিরাগভাজন হতে হয়, তাই ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স স্পেনে হস্তক্ষেপ না করার নীতি গ্রহণ করে।
স্পেনকে বিদেশি প্রভাব থেকে দূরে রাখা:
স্পেনের গৃহযুদ্ধে বৈদেশিক হস্তক্ষেপকে দূরে রাখা অসম্ভব ছিল। ইউরোপের অনেক রাষ্ট্র স্পেনের গৃহযুদ্ধে যোগদান না করার প্রতিশ্রুতি দিলেও ইটালি ও জার্মানি প্রত্যক্ষভাবে জেনারেল ফ্রাঙ্কোকে সাহায্য করেছিল। রাশিয়াও সক্রিয়ভাবে স্পেনের প্রজাতন্ত্রীদের সমর্থন জানিয়েছিল। সাফল্যের জন্য স্পেনের প্রজাতন্ত্রী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী উভয়কেই বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল। পোর্তুগালের একনায়ক সালাজার ফ্রাঙ্কোর প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং পোর্তুগালের মাধ্যমে বিদ্রোহী গোষ্ঠী বিদেশি সাহায্য লাভ করেছিল। একইভাবে প্রজাতন্ত্রীদের সাহায্য আসত ফ্রান্সের মাধ্যমে। ফ্রান্সের সরকার প্রজাতন্ত্রীদের সমর্থন করা সত্ত্বেও নিজের দেশের দক্ষিণপন্থীদের বিরোধিতার আশঙ্কায় স্পেনে সরাসরি হস্তক্ষেপ থেকে বিরত ছিল। অন্যদিকে ইংল্যান্ডে সরকার-বিরোধী শ্রমিক দলের সহানুভূতি ছিল প্রজাতন্ত্রীদের পক্ষে। কিন্তু ইংল্যান্ডের বলডুইনের রক্ষণশীল সরকার স্পেনের বিদ্রোহী জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী বা ইটালি কাউকেই অসন্তুষ্ট করতে চায়নি। ফ্রান্সের লিয় ব্লুসের ‘না হস্তক্ষেপ কমিটি’ গঠনের প্রস্তাব বলডুইন সমর্থন করেন। ইউরোপের 27 টি রাষ্ট্র নিয়ে এই কমিটি গঠিত হওয়ার আগেই পোর্তুগাল ও ফ্রান্সের মাধ্যমে স্পেনে উভয়পক্ষের কাছেই বিদেশি সাহায্য পৌঁছেছিল।
লিগের নির্দেশ অমান্য করে যোগদান :
1936 খ্রিস্টাব্দে লিগ কাউন্সিল স্পেনের গৃহযুদ্ধে অন্য কোনো দেশকে হস্তক্ষেপ না করার নির্দেশ দিলেও সে নির্দেশ কেউ মান্য করেনি। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের উদ্যোগে হস্তক্ষেপ না করার মূল কারণ হল এই যে, স্পেনের প্রজাতন্ত্রী সরকার বন্ধু রাষ্ট্রগুলির কাছ থেকে অস্ত্রশস্ত্র কিনতে পারবে না। অথচ বিদ্রোহী গোষ্ঠী পোর্তুগালের মাধ্যমে জার্মানি ও ইটালির কাছ থেকে পর্যাপ্ত সামরিক সাহায্য সংগ্রহ করতে থাকে। ডেভিড টমসন মন্তব্য করেছেন যে, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের এই তোষণনীতি গণতান্ত্রিক আদর্শের ওপর কঠিন আঘাত হেনেছিল।
ফ্রাঙ্কোর জয়লাভ:
দীর্ঘ তিন বছর যুদ্ধ চলার পর 1939 খ্রিস্টাব্দে জেনারেল ফ্রাঙ্কো জয়লাভ করে স্পেনে একনায়কতন্ত্র স্থাপন করেন। ফ্রাঙ্কো প্রজাতন্ত্রীদের ওপর নির্মম অত্যাচার চালান এবং অসংখ্য ব্যক্তিকে হত্যা করেন। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের তোষণ নীতি ও সাম্যবাদ ভীতি ফ্রাঙ্কোর জয়লাভের অন্যতম কারণ ছিল।