জার্মানিতে নাতসিবাদের উত্থানের কারণগুলি বিশ্লেষণ করো।

জার্মানিতে নাতসিবাদের উত্থানের কারণগুলি বিশ্লেষণ করো
জার্মানিতে নাতসিবাদের উত্থানের কারণগুলি বিশ্লেষণ করো।

ভূমিকা: 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময় জার্মানিতে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং ফ্রেডারিখ হিবার্টের নেতৃত্বে সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান দল ক্ষমতা গ্রহণ করে। কিন্তু বেশিদিন জার্মানিতে গণতন্ত্র স্থায়ী হয়নি। অচিরেই হিটলারের হাত ধরে নাতসি দল ক্ষমতা দখল করে। এই দলের ক্ষমতা দখলের পশ্চাতে নিম্নলিখিত কারণগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।

জার্মানিতে নাতসিবাদের উত্থানের কারণসমূহ:

① ভাইমার প্রজাতন্ত্রের ব্যর্থতা: 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রেডারিখ হিবার্টের নেতৃত্বে ভাইমার প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও অপমানজনক ভার্সাই সন্ধি মেনে নিয়ে 660 কোটি পাউন্ড আর্থিক জরিমানা দিতে রাজি হলে সমগ্র জার্মানবাসী এই সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তা ছাড়া বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আর্থিক মন্দা, মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব প্রভৃতি সমস্যার সমাধানে এই সরকারের ব্যর্থতা জনগণের কাছে তার জনপ্রিয়তা হ্রাস করে।

② আর্থিক সমস্যা: 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে জার্মানিতে আর্থিক সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। বিপুল ক্ষতিপূরণ জনিত ভার, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অভাব, মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব প্রভৃতি জার্মান জনগণকে প্রজাতান্ত্রিক সরকারের বিরোধী করে তোলে।

③ প্রজাতান্ত্রিক দলের পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতা: 

ভার্সাই সন্ধিতে স্বাক্ষর করে জার্মানির সামরিক স্বাধীনতা লুপ্ত হয়, সেনাবাহিনীর ধ্বংসসাধন করা হয়, রাইন অঞ্চল কেড়ে নেওয়া হয়। এই অবস্থার প্রতিকার করতে প্রজাতান্ত্রিক সরকার ব্যর্থ হলে জার্মান জনগণ ক্ষুব্ধ হয়।

④ জার্মানবাসীর একনায়কতন্ত্রী শাসনের প্রতি আকর্ষণ: 

1919-1928 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে জার্মানিতে প্রায় 15টি মন্ত্রীসভা ক্ষমতায় আসে এবং প্রত্যেকটিই উদ্ধৃত পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়। ফলে যুদ্ধ পরবর্তী আর্থিক ও পররাষ্ট্রনীতিগত সংকট মোকাবিলায় জার্মানবাসীরা একনায়কতন্ত্রের উদ্ভবের প্রতিই আকর্ষিত হন। তা ছাড়াও জার্মানবাসীদের গণতান্ত্রিক সংসদীয় ব্যবস্থার প্রতি আস্থাও বিশেষ ছিল না।

⑤ কমিউনিস্ট বিরোধিতা: 

জার্মানিতে স্পার্টাকান বা কমিউনিস্টরা কৃষক শ্রমিক আন্দোলনের সূত্রপাতের দ্বারা বিভিন্ন শিল্প কারখানাগুলিতে ধর্মঘট শুরু করে। এতে শিল্পপতিসহ সাধারণ মানুষ বিপর্যস্ত হয় ও নাতসিদের সমর্থন করে।

⑥ ইহুদি বিরোধিতা: 

টিউটন জাতিভুক্ত জার্মানবাসীরা কখনোই ইহুদিদের প্রতি সহনশীলতার নীতি নেয়নি। তাই হিটলার ইহুদি বিতাড়নকে তাঁর অন্যতম কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করলে জার্মানরা পরিতৃপ্ত হয়।

⑦ হিটলারের উত্থান: 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আর্থিক মন্দা, দুর্বল পররাষ্ট্রনীতিজনিত ভাইমার প্রজাতন্ত্রের ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে হিটলার তাঁর জ্বালামুখী বক্তৃতা ও ব্যক্তিগত সাংগঠনিক ক্ষমতার ভিত্তিতে অতি দ্রুত ক্ষমতা লাভ করতে থাকেন। তিনি অপমানজনক ভার্সাই সন্ধির প্রতিকার, আর্থিক উন্নতি, বেকার সমস্যার সমাধান, কমিউনিস্ট বিরোধিতা ও ইহুদি বিতাড়নকে নিজ ঘোষিত নীতির মধ্যে এনে জার্মানবাসীর হৃদয় জয় করে নেন।

⑧ নাতসি দলের ক্ষমতা লাভ: 

1932 খ্রিস্টাব্দে নির্বাচনে নাতসি দল 60৪টি আসনের মধ্যে 230টি আসন লাভ করে ও বহুদলীয় সরকারে অংশগ্রহণ করে। পরবর্তী সময়ে নির্বাচনে নাতসি দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়ে জোট সরকারে যোগ দেয়। কিন্তু জার্মান সংসদের এক বিশেষ আইনে হিটলার আইন প্রণয়ন ও শাসন পরিচালনার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করেন। ইতোমধ্যে জার্মান প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ মারা গেল হিটলার নিজেকে ‘ফ্যুয়েরার’ হিসেবে ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি উভয় পদ গ্রহণ করেন। জার্মানিতে নাতসিবাদের উত্থান ঘটে।

Leave a Comment