ভার্সাই সন্ধি কতদূর যুক্তিযুক্ত ছিল? |
ভূমিকা:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিজয়ী মিত্রশক্তি পরাজিত জার্মানি ও তার সহযোগী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে শান্তি চুক্তি সম্পাদনের জন্য ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহ্বান করে। এখানে পৃথিবীর মোট 32টি দেশের প্রতিনিধি যোগ দেয় এবং মোট পাঁচটি সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তার মধ্যে 339টি ধারা সংবলিত সবচেয়ে দীর্ঘ সন্ধিটি ছিল ‘ভার্সাই সন্ধি’।
ভার্সাই সন্ধির সমালোচনাঃ
পৃথিবীর ইতিহাসে ভার্সাই (সন্ধির) চুক্তির মতো আর কোনো চুক্তি এতটা সমালোচিত হয়নি। জার্মানি তীব্র ভাষায় এই চুক্তির সমালোচনা করে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভার্সাই সন্ধির সমালোচনা করেছেন।
ভার্সাই সন্ধির বিপক্ষে যুক্তি:
① জবরদস্তিমূলক সন্ধি:
জার্মান জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকেরা ভার্সাই সন্ধিকে একটি ‘জবরদস্তিমূলক সন্ধি’ বলে অভিহিত করেছেন। এই চুক্তির মূলত দুটি উদ্দেশ্য ছিল-(i) যুদ্ধ সৃষ্টির অপরাধে জার্মানিকে কঠোর শাস্তি দেওয়া এবং (ii) ভবিষ্যতে জার্মানির আক্রমণের সম্ভাবনা থেকে ইউরোপকে রক্ষা করা। প্রচণ্ড মানসিক ও সামরিক চাপের মধ্যে জার্মানি এই চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়েছিল। পরাজিত জার্মানিকে সন্ধি আলোচনার সুযোগ না দিয়ে একতরফাভাবে সন্ধি চাপানোর ফলে এই সন্ধির নৈতিক ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়।
② কঠোর শান্তিমূলক সন্ধি:
পরাজিত শত্রুর প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন না করে চুক্তি রচয়িতাগণ পরাজিত শক্তির ওপর কেবল শাস্তিমূলক ব্যবস্থাই নিয়েছিলেন।
③ মিত্র শক্তিবর্গের কপটতা ও স্বার্থপরতা :
এই সন্ধির চুক্তিতে ন্যায়নীতি এবং পারস্পরিক সুবিধা নীতি মোটেই ছিল না। অন্যান্য শক্তিগুলি এই যুদ্ধের জন্য দায়ী থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধ অপরাধী বলে জার্মানিকে একঘরে করে রাখা হয়। জাতিসংঘের সদস্যপদ থেকে তাকে দীর্ঘদিন বঞ্চিত করে রাখা হয়। জার্মানির ওপর বিভিন্ন শাস্তিমূলক শর্ত চাপানো হয়। উইলসনের 14 দফা শর্তের চতুর্থ শর্ত অনুযায়ী প্রতিটি রাষ্ট্রই দেশই দেশরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম সামরিক শক্তি রেখে উদ্বৃত্ত সামরিক অস্ত্রশস্ত্র হ্রাস করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। কিন্তু সন্ধি দ্বারা কেবলমাত্র জার্মানিরই অস্ত্রশস্ত্র হ্রাস করা হয়েছিল। মিত্র শক্তিবর্গের এই কপটতা ও স্বার্থপরতা জার্মানির জনগণকে ক্ষুব্ধ করেছিল।
④ জার্মানির রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ক্ষুণ্ণ :
উইলসনের ‘একজাতি এক রাষ্ট্র’ নীতি অনুযায়ী জার্মানি ফ্রান্সকে আলসাস-লোরেন এবং পোল্যান্ডকে পশ্চিম প্রাশিয়া ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু অস্ট্রিয়ার জার্মান অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি জার্মানি ফিরে পায়নি। এইজন্য যেসব জার্মান অন্য দেশে বাস করছিল তারা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়।
⑤ বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতিপূরণ:
জার্মানির ওপর যে পরিমাণ ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপানো হয়েছিল, তা কখনোই বাস্তবসম্মত ছিল না। জার্মানির উৎপাদিত কয়লার 40%, লোহার 65% এবং সমস্ত রবার মিত্রশক্তি অধিকার করে নেয়। এ ছাড়া খনিজসম্পদ সমৃদ্ধ ‘সার’ অঞ্চলটিও 15 বছরের জন্য মিত্রশক্তির অধীনে থাকবে বলে ঘোষণা করা হল। এইভাবে জার্মানির অর্থ উপার্জনের পথ বন্ধ করে দিয়ে তার ওপর ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হল।
ভার্সাই সন্ধির সপক্ষে যুক্তি:
বিভিন্ন ঐতিহাসিকের মতে কিছু ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও ভার্সাই সন্ধি পুরোপুরি অবাস্তব ছিল না।
① সমকালীন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি:
দীর্ঘস্থায়ী ও বিধ্বংসী প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সারা পৃথিবীতে বিশ্বযুদ্ধ সৃষ্টিকারী জার্মানির বিরুদ্ধে চরম আকারে ক্ষোভ ও ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায়। এইরকম পরিস্থিতিতে ন্যায়-অন্যায় বিচার করে চুক্তি রচনা করা সম্ভব ছিল না। যদি চুক্তি রচয়িতারা জার্মানির প্রতি দাক্ষিণ্য দেখাতেন, তাহলে তাদের নিজেদের মধ্যেই তীব্র বিরোধ সৃষ্টি হত।
② ভার্সাই চুক্তির পূর্বে রাশিয়ার প্রতি জার্মানির আচরণ:
‘ভার্সাই সন্ধির শর্তগুলি ছিল অতিকঠোর’- এই মতও সঠিক নয়। কারণ এইরকম পরিস্থিতিতে পড়লে জার্মানি আরও বেশি শর্ত আরোপ করতে দ্বিধা করত না। জার্মানির আত্মসমর্পণের অব্যবহিত পূর্বে রাশিয়ার সঙ্গে স্বাক্ষরিত ব্রেস্ট-লিটভস্কের সন্ধি এই বক্তব্যের প্রমাণ দেয়।
③ ‘এক জাতি এক রাষ্ট্র নীতি’-র অসারত্ব:
‘এক জাতি এক রাষ্ট্র’ নীতি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসরণ করা বাস্তবে সম্ভব ছিল না। জার্মান অধ্যুষিত জার্মানি ও অস্ট্রিয়াকে সংযুক্ত করলে জার্মানি আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে পুনরায় আগ্রাসী হয়ে উঠত।
উপসংহার:
কোনো-কোনো ঐতিহাসিক ভার্সাই চুক্তিকে সন্ধি না বলে যুদ্ধবিরতি বলতে চেয়েছেন। কারণ ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষরের দ্বারা বিজয়ী ও বিজিত কোনো পক্ষকেই সন্তুষ্ট করা যায়নি। এর ফলেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্ম হয়।