দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধাস্ত্রের প্রকৌশলগত পরিবর্তন সম্পর্কে আলোকপাত করো

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধাস্ত্রের প্রকৌশলগত পরিবর্তন সম্পর্কে আলোকপাত করো
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধাস্ত্রের প্রকৌশলগত পরিবর্তন সম্পর্কে আলোকপাত করো

ভূমিকা : 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অস্ত্রের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। আক্রমণাত্মক এবং রক্ষণাত্মক যুদ্ধ উভয় ক্ষেত্রেই এই পরিবর্তন দেখা যায়। যুদ্ধে উড়োজাহাজের ব্যবহার আগের তুলনায় বেড়েছিল। ব্লিৎজ ক্রিগ আক্রমণ, স্থল ও বিমান বাহিনীর যুগপৎ ব্যবহারের ফলে জার্মানি চমকপ্রদ সাফল্য পেয়েছিল।

প্রকৌশলগত পরিবর্তনঃ 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বোমারু বিমানের হামলা থেকে বাঁচার জন্য তৈরি হয় উন্নতমানের রাডার যন্ত্র, যা বিমানহানার সম্ভাবনা আগে থেকেই জানাতে পারত। উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয় বিমান বিধ্বংসী কামানের যার একটি উদাহরণ জার্মানির ৪৪ মিমি কামান। বিমানের ক্ষেত্রে জেট প্রযুক্তির ব্যবহারও শুরু হয় এই বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে। তা ছাড়া পূর্বের তুলনায় বিমানগুলি অনেক বেশি ভারী হয় এবং সেগুলি অনেক ওপর থেকে বোমাবর্ষণ করতে পারত। যার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বি-29 বিমানগুলি।

নৌবাহিনীর ক্ষেত্রে পরিবর্তন: 

নৌবাহিনীর ক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হল বিমানবাহী জাহাজের ব্যবহার এবং উন্নতর ইউ-বোট বা সাবমেরিন তথা ডুবোজাহাজের ব্যবহার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত ডুবোজাহাজগুলি শব্দগ্রাহক যন্ত্রের ব্যবহার ঘটিয়ে নিখুঁত নিশানায় টর্পেডো ছুড়তে পারত। অন্যদিকে জলের তলায় থাকা সাবমেরিনকে ধ্বংস করার জন্য ব্যবহার করা হয় ডেপথ্ চার্জ প্রযুক্তি।

স্থলযুদ্ধে পরিবর্তন: 

স্থলযুদ্ধও আর আগের মতো ছিল না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তুলনায় এসময় স্থলবাহিনীর গতি এবং অভিমুখ পালটানোর ক্ষমতা, দুই-ই পরিবর্তিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ট্যাংক ছিল স্থলবাহিনীর একটি সহায়ক অঙ্গ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ট্যাংক স্থলযুদ্ধের প্রধান অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। যুদ্ধের আগে এবং যুদ্ধ চলাকালীন ট্যাংকের প্রযুক্তিগত নানা পরিবর্তন হয়। এর ফলে সেগুলির ভেদশক্তি, ঘাতসহতা এবং গতি বৃদ্ধি পেয়েছিল। স্থলযুদ্ধে বহনযোগ্য মেশিনগানের সংখ্যা অনেক বেড়েছিল। জার্মানির এম.জি. 38-হল এর একটি উদাহরণ। তা ছাড়া শহরাঞ্চল এবং দুর্গম জঙ্গলে যুদ্ধের উপযোগী সাবমেশিনগানও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহার হয়েছিল। এসময়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার হল অ্যাসল্ট রাইফেল। রাইফেল আর সাবমেশিনগান জাতীয় অস্ত্রের মিলনে তৈরি এই অস্ত্র হল আজকের দিনের এ কে-47-এর উত্তরসূরি। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রযুক্তির ব্যবহারের সবচেয়ে বিধ্বংসী উদাহরণ হল পারমাণবিক বোমা। আপাত অবিভাজ্য পরমাণুর ভিতরে লুকিয়ে থাকা প্রবল শক্তিকে কাজে লাগিয়ে তা যুদ্ধে ব্যবহারের উপযোগী করে তুলেছিলেন ম্যানহাটান প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত মার্কিনি বিজ্ঞানীরা। এর ফলে যে ভয়াবহ অস্ত্র তৈরি হয় তা আজও বিশ্বের কূটনৈতিক সম্পর্ককে নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার গবেষণার ওপর ভিত্তি করে অন্যান্য বিভিন্ন অস্ত্র বর্তমান পথিবীতে ব্যবহার হয়ে চলেছে। তার মধ্যে রয়েছে মিসাইল, রকেট প্রভৃতি বিধ্বংসী অস্ত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মানুষের তৈরি অস্ত্রের মারণ ক্ষমতা বেড়ে গিয়েছিল অনেক গুণ।

পারমাণবিক অস্ত্রঃ 

বর্তমানে পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলির হাতে যে পরিমাণ বিপজ্জনক অস্ত্র রয়েছে, তা ব্যবহার করলে এই পৃথিবী বহুবার ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই অস্ত্রের ব্যবহারের সম্ভাবনা কমিয়ে আনাই বর্তমান যুগে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে বলা হয় সর্বাত্মক যুদ্ধ (টোটাল ওয়ার)। সাধারণ যুদ্ধের সঙ্গে এর পার্থক্য এই যে, সাধারণ যুদ্ধ সীমাবদ্ধ থাকে কেবল যুদ্ধক্ষেত্রে, কিন্তু সর্বাত্মক যুদ্ধে কোনও নির্দিষ্ট রণাঙ্গন থাকে না। বসতবাড়ি, চাষের জমি, কলকারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সর্বত্রই যুদ্ধের ধ্বংসলীলা চলতে থাকে। হিটলার তাঁর বিপক্ষের ওপর সর্বাত্মক যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে তাদের মনোবল নষ্ট করে দিতে চেয়েছিলেন। এই ধরনের যুদ্ধে সাধারণ মানুষের ওপরও আক্রমণ নেমে আসে বলে যুদ্ধে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়।

ফলাফল: 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তুলনায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অনেক বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। একটি আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মোট 17 মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে 10 মিলিয়ন সৈন্য ও 7 মিলিয়ন বেসামরিক মানুষ ছিলেন। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে 50 মিলিয়নেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়, যার মধ্যে 34 মিলিয়ন ছিলেন বেসামরিক ব্যক্তি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রধান কারণ ছিল উপনিবেশ এবং সম্পদের জন্য লড়াই কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ। যে জাতীয়তাবাদ মনে করে আমার জাতি শ্রেষ্ঠ বলেই আমার অধিকার রয়েছে অন্য জাতিকে ধ্বংস করে তার সম্পদ দখল করার। নাতসি জার্মানিতে এই জাতি ঘৃণা এমন পর্যায়ে পৌঁছোয় যে শুধুমাত্র একটি বিশেষ জাতিগত সম্প্রদায়ের লোক হওয়ার জন্যই লক্ষ লক্ষ মানুষকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের গ্যাস চেম্বারে মরতে হয়েছে।

উপসংহার: 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভৌগোলিক বিস্তারও তুলনামূলকভাবে কম ছিল। মূলত ইউরোপেই সীমাবদ্ধ ছিল সেই যুদ্ধ। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চরিত্র ছিল প্রকৃতই বিশ্বজনীন। যুদ্ধের প্রকৌশলগত পরিবর্তন সমগ্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তার প্রভাব ক্ষেত্রকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল।

Leave a Comment