নিমাই কে? তিনি কীভাবে বাঙালির হিয়া অমিয় মথিয়া’ কায়া ধারণ করেছেন? |
নিমাই-এর পরিচয়
নদীয়ার নবদ্বীপের জগন্নাথ মিশ্র ও শচীদেবীর কনিষ্ঠ পুত্র চৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দ)। তাঁর বাল্যকালীন গৃহনাম ছিল নিমাই। তাঁর পিতৃদত্ত নাম ছিল বিশ্বম্ভর। গায়ের রঙের উজ্জ্বলতার জন্য গৌরাঙ্গ, পরবর্তীতে মহাপ্রভু এবং শ্রীকৃয়চৈতন্য বা সংক্ষেপে চৈতন্যদেব নামেই পরিচিত হন তিনি। গৌড়ীয় বৈম্নবধর্মের জনক নিমাই তাঁর প্রথমা পত্নী লক্ষ্মীপ্রিয়ার অকালমৃত্যুর পর বিন্নুপ্রিয়াকে বিবাহ করেন। গয়ায় ঈশ্বরপুরীর কাছে গোপালমন্ত্রে এবং কাটোয়ায় মাত্র ২৪ বছর বয়সে কেশব ভারতীর কাছে তিনি সন্ন্যাস দীক্ষা নেন। জীবনের শেষপর্ব জগন্নাথ ধামেই কাটিয়েছিলেন। জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল’ কাব্যে উল্লিখিত যে, রথের সামনে ভাবাবেগে বিহ্বল নৃত্যকালে তাঁর পায়ে ইটের কুচি বিদ্ধ হওয়ায় ব্যাধিকবলিত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। চৈতন্য নতুন ধর্মমতের প্রতিষ্ঠাতা যতখানি, তার চেয়ে অনেক বেশি ধর্মমতের নতুন ব্যাখ্যাকর্তা। তিনি বিভাজিত বঙ্গসমাজে আচণ্ডালকে কোল দিয়ে হরিমন্ত্রের অভেদত্বে বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করেন। শ্রেণি- বর্ণ-জাতি-ধর্মনির্বিশেষে তাঁর এই ভক্তিসাধনা পরবর্তী বাঙালি জী বন-সাহিত্য-ধর্ম-সংগীত-সবকিছুকেই বদলে দেয়। ষোড়শ শতক তাই ‘চৈতন্য রেনেসাঁ’ নামে খ্যাত।
নিমাইয়ের কায়াধারণের স্বরূপ
বিচ্ছিন্ন, বিভাজিত বাঙালির একান্ত আপনারজন নিমাই বা চৈতন্য। তিনি বাঙালির সমস্ত মঙ্গলবোধের মূর্তরূপ হয়ে দেখা দেন। তাই তো ব্রাহ্মণ থেকে শূদ্র, চণ্ডাল থেকে রাজমন্ত্রী, কাজি থেকে ডাকাত সকলেই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। ধর্মের বহুস্তরী বিভেদ মুছে তিনি ধর্মের নতুন ব্যাখ্যা দেন। উদাত্তকণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘চণ্ডালোহপি দ্বিজশ্রেষ্ঠ হরিভক্তি পরায়ণম্।’ অমৃতের স্পর্শে চিরন্তনত্ব আসে, মৃত্যুময়তা মুছে যায়। অমৃত তাই শাশ্বতকল্যাণের প্রতিভূ। কবি বাঙালির নিত্যপূজ্য চৈতন্য সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন–
‘বাঙালির হিয়া অমিয় মথিয়া নিমাই ধরেছে কায়া।’
কবি চৈতন্যকে বাঙালির শুভবোধের চিরন্তন প্রতীক হিসেবে দেখেছেন বলেই বাঙালির হৃদয়ামৃতের মূর্তবিগ্রহ বলে তাঁকে চিহ্নিত করেছেন।