সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ ও গুরুত্ব আলোচনা করো। |
ভূমিকা
সাঁওতালরা হল কঠোর পরিশ্রমী, শান্তিপ্রিয় এক কৃষিজীবী আদিবাসী সম্প্রদায়। তারা বীরভূম, মানভূম, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, মুরশিদাবাদ প্রভৃতি অঞ্চলে বসবাস করত। ব্রিটিশ ভূমিরাজস্ব নীতির চাপে তারা রাজমহল পাহাড়ের প্রান্তদেশে বনভূমি পরিষ্কার করে বসবাস ও চাষবাস শুরু করে। তাদের এই অঞ্চলকে ‘দামিন-ই-কোহ’ (পাহাড়ের প্রান্তদেশ) বলা হয়। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে এই অঞ্চলের সাঁওতালরা বিভিন্ন কারণে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ
[1] সাঁওতালদের জমি হরণ: সাঁওতালরা কঠোর পরিশ্রম করে দামিন-ই-কোহ অঞ্চলের পাথুরে ও জঙ্গলাকীর্ণ জমিকে চাষযোগ্য জমিতে পরিণত করে। তাদের এই জমিগুলি জমিদার, ইজারাদার ও মহাজনরা নানা অজুহাতে দখল করতে থাকে। ফলে সাঁওতালদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
[2] অত্যধিক হারে রাজস্ব আদায়: ব্রিটিশ কোম্পানির সহযোগী জমিদাররা সাঁওতালদের কাছ থেকে অত্যধিক হারে ভূমিরাজস্ব আদায় করত। একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, এই অঞ্চলে ১৮ বছরের মধ্যে ১০ গুণ খাজনা বৃদ্ধি করা হয়। তা ছাড়া জমিদার ও তাদের কর্মচারীরা নানা ধরনের উপশুল্ক আদায় করত। এই সব কর মেটাতে সাঁওতালরা নাজেহাল হয়ে যেত।
[3] মহাজনদের শোষণ: নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থায় নগদ অর্থে খাজনা দিতে হত। সাঁওতালরা নগদ অর্থের জন্য মহাজনদের কাছে ফসল বিক্রি করতে এবং ঋণ নিতে বাধ্য হত। মহাজনরা ঋণ দেওয়ার সুযোগে ৫০% থেকে ৫০০% হারে সুদ আদায় করত। এইভাবে সাঁওতালদের নানারকম কৌশলে শোষণ করত মহাজনরা।
[4] ইংরেজ কর্মচারী ও ঠিকাদারদের অত্যাচার: লর্ড ডালহৌসির আমলে রাজমহল, রামপুরহাট, ভাগলপুর প্রভৃতি অঞ্চলে রেললাইনের কাজ শুরু হয়। এর জন্য এই অঞ্চলে বিভিন্ন কর্মচারী ও ঠিকাদাররা আসে। তারা নানাভাবে সাঁওতালদের উপর অত্যাচার করত। নামমাত্র মজুরিতে কাজ করানো, সাঁওতালদের হাঁস, মুরগি, ছাগল কেড়ে নেওয়া, এমনকি নারীদের সম্মানহানিতেও তারা পিছপা হত না। ফলে সাঁওতালরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল।
[5] বহিরাগত ব্যবসায়ীদের শোষণ : বহিরাগত কিছু ব্যবসায়ী সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চলে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর দোকান খুলে বসে। তারা সাঁওতালদের সরলতার সুযোগে ‘কেনারাম’ ও ‘বেচারাম’ নামক ভুয়ো বাটখারার দ্বারা কম ওজনে মালপত্র ক্রয়বিক্রয়ের মাধ্যমে দরিদ্র সাঁওতালদের প্রতারণা করে।
[6] সাঁওতাল সমাজে ব্রিটিশ আইন প্রবর্তন : সাঁওতালরা তাদের নিজস্ব নিয়মে চলত। বাংলার ছোটোলাট ফ্রেডারিক হ্যালিডের নির্দেশে সাঁওতালদের মধ্যে ব্রিটিশ আইন কার্যকর করা হয়। এর ফলে তাদের চিরাচরিত উপজাতীয় সংগঠন ভেঙে পড়ায় তারা ক্ষুব্ধ হয়।
সাঁওতাল বিদ্রোহ
সাঁওতালরা মহাজন, জমিদার ও সরকারি কর্মচারীদের মিলিত শোষণ ও অত্যাচারে বিক্ষুব্ধ হয়ে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন ভগনাডিহির মাঠে ১০ হাজার সাঁওতাল সমবেত হয়ে সিধু (সিধো) ও কানু (কানহা)-র নেতৃত্বে স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করে। বিদ্রোহী সাঁওতালদের আক্রমণে কুখ্যাত মহাজন কেনারাম ভগত ও দিঘি থানার অত্যাচারী দারোগা মহেশলাল দত্ত খুন হন। বিদ্রোহীরা বহু নীলকুঠি ও রেলবাংলো ধ্বংস এবং অত্যাচারী জমিদার ও মহাজনদের হত্যা করেছিল।
বিদ্রোহ দমন
আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে লাঠি, টাঙ্গি, বল্লম, তিরধনুক নিয়ে যুদ্ধ করে শেষপর্যন্ত সাঁওতালরা পরাজিত হয়েছিল। ইংরেজ সৈন্য ২৩ হাজার বিদ্রোহীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। ইংরেজরা সিধু, কানু-সহ অন্যান্য বীর সাঁওতাল নেতাদের ফাঁসি দিয়েছিল, বহু বিদ্রোহীদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল এবং তাদের গ্রামগুলি ধ্বংস করে দিয়েছিল। এভাবে ইংরেজরা ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই সাঁওতাল বিদ্রোহ দমন করেছিল।
সাঁওতাল বিদ্রোহের গুরুত্ব
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সাঁওতাল বিদ্রোহের গুরুত্ব ছিল সুদূরপ্রসারী।
[1] ইংরেজ সরকার সাঁওতাল অধ্যুষিত গ্রামগুলিকে নিয়ে সাঁওতাল পরগনা গঠন করেছিল।
[2] সাঁওতালদের ‘উপজাতি’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল।
[3] এই অঞ্চলে বাঙালি মহাজনদের প্রবেশ নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেছিল সরকার এবং সুদের হারও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল।
সাঁওতাল বিদ্রোহের গুরুত্ব প্রসঙ্গে ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন, “যদি ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহকে স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে মনে করা হয়, তবে সাঁওতাল বিদ্রোহকেও স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্যাদা দেওয়া উচিত।”