রংপুর বিদ্রোহের কারণ, বিস্তার ও গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো। |
ভূমিকা
১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বাংলার রংপুরের কৃষকরা ইজারাদার দেবী সিংহের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল, তা রংপুর বিদ্রোহ নামে পরিচিত। অধ্যাপক নরহরি কবিরাজ বলেছেন যে, ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ছিল একটি সফল কৃষক অভ্যুত্থান। রংপুর বিদ্রোহের প্রধান নেতা ছিলেন নুরুলউদ্দিন।
রংপুর বিদ্রোহের কারণ
রংপুর বিদ্রোহের পেছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান ছিল–
[1] ইজারাদার দেবী সিংহের অত্যাচার : ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে দিনাজপুরের রাজা হন নাবালক রাধানাথ সিংহ। বাংলার গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস দেবী সিংহ নামে এক ব্যক্তিকে তাঁর দেওয়ান নিযুক্ত করেন। দেবী সিংহ বার্ষিক ১৬ লক্ষ টাকার বিনিময়ে দিনাজপুর, রংপুর ও এদ্রাকপুর পরগনার ইজারা নেন। এরপর ইজারাদার হয়ে দেবী সিংহ স্থানীয় জমিদার ও কৃষকদের উপর অত্যধিক হারে রাজস্ব ধার্য করে। তার অত্যাচারে ওই অঞ্চলের প্রজারা জর্জরিত হয়ে ওঠে।
[2] জমিদারি বাজেয়াপ্ত: নির্দিষ্ট সময়ে রাজস্ব দিতে না পারার জন্য অনেক জমিদারের জমিদারি বাজেয়াপ্ত করা হয়। এজন্য জয়দুর্গা চৌধুরাণী, বামনডাঙার জমিদার জগদীশ্বরী চৌধুরাণী, টেপাগ্রামের জমিদার-সহ অনেক জমিদারের জমিদারি বাজেয়াপ্ত হয়।
[3] মহাজনদের শোষণ: দরিদ্র কৃষকরা রাজস্ব দেওয়ার জন্য বা বিভিন্ন প্রয়োজনে মহাজনের কাছে চড়া সুদে টাকা ধার নিতে বাধ্য হত। মহাজনরাও এই সুযোগে কৃষকদের শোষণ করত।
রংপুর বিদ্রোহের বিস্তার
বিদ্রোহ প্রথমে শুরু হয় রংপুরের টেপা, তিমলা, ফতেপুর, রুজিরহাট প্রভৃতি অঞ্চলে। বিদ্রোহীরা তাদের মধ্য থেকে নুরুলউদ্দিনকে ‘নবাব’ বলে এবং দয়ারাম শীল নামে আর-এক ব্যক্তিকে ‘নবাবের দেওয়ান’রূপে ঘোষণা করে। হিন্দু-মুসলিম সকল কৃষকই ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন শুরু করে। তাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম দ্রুত দিনাজপুর ও কোচবিহার জেলাতেও বিস্তার লাভ করে।
বিদ্রোহ দমন
এমতাবস্থায় বিদ্রোহ দমনে ইংরেজরা সেনাবাহিনীর সাহায্য নেয়। নুরুলউদ্দিন আহত হয়ে বন্দি হন, পরে মৃত্যুবরণ করেন। দয়ারাম শীলও নিহত হন। শেষপর্যন্ত বিদ্রোহীদের উপর প্রচণ্ড অত্যাচার চালিয়ে ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে এই বিদ্রোহ দমন করা হয়।
রংপুর বিদ্রোহের গুরুত্ব
রংপুর বিদ্রোহ দমিত হলেও এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
[2] ইজারাদারি প্রথার কুফলগুলির প্রকাশ : ইজারাদারি প্রথা যে কত ভয়ংকর হতে পারে এই বিদ্রোহের ফলে তা প্রকাশ পেয়েছিল।
[3] শোষকদের নগ্নরূপের প্রকাশ: এই বিদ্রোহের ফলে জমিদার, মহাজন, ইজারাদার, সরকারি কর্মচারীদের কৃষক-শোষণের রূপ প্রকাশিত হয়েছিল।
[4] হিন্দু-মুসলমান কৃষকদের মিলিত বিদ্রোহ: রংপুর বিদ্রোহ ছিল নির্যাতিত হিন্দু ও মুসলমান প্রজাদের মিলিত আন্দোলন। ঐতিহাসিক নরহরি কবিরাজও রংপুর বিদ্রোহকে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন।