বাংলাদেশে ওয়াহাবি আন্দোলন এবং তার চরিত্র বিশ্লেষণ করো |
ওয়াহাবি আন্দোলন
‘ওয়াহাবি’ কথাটির অর্থ হল ‘নবজাগরণ’। আরব দেশে আবদুল ওয়াহাব (১৭০৩-৮৭ খ্রিস্টাব্দ) নামে এক ধর্মপ্রাণ মুসলমান ইসলাম ধর্মের সংস্কারের জন্য একটি আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সম্প্রদায় ওয়াহাবি নামে পরিচিত।
বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন
বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন তিতুমির। ধর্মীয় উদ্দেশ্যে মক্কায় গিয়ে তিতুমির ওয়াহাবিদের দ্বারা প্রভাবিত হন। রায়বেরিলির সৈয়দ আহমদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ঘটে। মক্কা থেকে ফিরে এসে তিতুমির বারাসত সংলগ্ন অঞ্চলে প্রচার শুরু করেন। শুরুতে বাংলায় হিন্দু-মুসলিম সমন্বয়বাদী কিছু ধর্মীয় আচার-আচরণ ও রীতিনীতির বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করেন। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ধর্মীয় সংস্কারমূলক আন্দোলন সুস্পষ্টভাবে জমিদারবিরোধী রূপ পরিগ্রহণ করে।
ওয়াহাবি আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য
সূচনা, প্রসার ও অবসানের ক্ষেত্রে ওয়াহাবি আন্দোলন নানান বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছিল। যথা-
দাড়ির উপর কর: বারাসত অঞ্চলের পুড়া গ্রামের জমিদার কৃমদেব রায় ওয়াহাবিদের দাড়ির উপর ২%, টাকা হারে কর ধার্য করলে তাদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ ও বিক্ষোভ দেখা দেয়। তিতুমিরের অনুগামীরা কুমদেব রায়ের বাসভবন আক্রমণ করে এবং ব্যাপক লুঠপাট চালায়।
নীলকরবিরোধী আন্দোলন: তিতুমিরের বিদ্রোহ শুরুতে রাজস্ব সংগ্রহকারী জমিদারদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল। স্বল্পকালের | মধ্যেই নীলকররা তাদের আন্দোলনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে তা ঔপনিবেশিক সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়। ছোটো ছোটো কৃষকদের নিয়ে মূল বিদ্রোহী বাহিনী গড়ে উঠেছিল, তবে এদের সঙ্গে কর্মচ্যুত তাঁতিরাও যোগদান করে। প্রথম জীবনে জমিদারদের অধীনে কাজ করায় জমিদারদের শোষণ সম্পর্কে তাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল।
ওয়াহাবি আন্দোলনের অবসান
বাঁশের কেল্লা ধ্বংস: জমিদার ও কুঠিয়ালরা সরকারের কাছে প্রতিকার প্রার্থনা করে আবেদন জানালে তিতুমিরের সঙ্গে সরকারের প্রত্যক্ষ সংঘাতের সূত্রপাত হয়। গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্কের নেতৃত্বাধীন ইংরেজ সেনাবাহিনীর আক্রমণে তিতুমিরের বাঁশের কেল্লা গুঁড়িয়ে যায়।
ওয়াহাবি আন্দোলন ব্যর্থতার কারণ
তিতুমিরের আন্দোলনের সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতা হল- এই আন্দোলনে সব শ্রেণির কৃষককে শামিল করা যায়নি। এ ছাড়াও ব্যর্থতার অন্যতম কারণ ছিল- ওয়াহাবিদের সঙ্গে অন্যান্য কৃষক সম্প্রদায়ের ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আসলে জমিদারদের বিরুদ্ধে এই আন্দোলনে ওয়াহাবি-বিরোধী মুসলমানরাও যেমন যোগদান করেনি, তেমনি ক্রমশ আন্দোলন সাম্প্রদায়িক রূপ পরিগ্রহ করায় হিন্দু কৃষকেরাও এই আন্দোলন থেকে দূরে সরে থাকে। কিন্তু ব্যর্থতা সত্ত্বেও এই আন্দোলনের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।
ওয়াহাবি আন্দোলনের চরিত্র
ড. কুয়েমুদ্দিন আহমদ মনে করেন, এই আন্দোলনে হিন্দু-মুসলিম একত্রে অংশগ্রহণ করে এবং এতে সাম্প্রদায়িকতার কোনো ভূমিকা ছিল না। আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য ছিল ভারত থেকে ব্রিটিশশক্তির বিতাড়ন।
উইলিয়ম হান্টারের মতে, তিতুমিরের নেতৃত্বে ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল কৃষকশ্রেণির একটি শ্রেণিসংগ্রাম। তবে ঐতিহাসিক ড. শশীভূষণ চৌধুরী বলেছেন যে, জমিদার শ্রেণির শোষণের বিরুদ্ধে আরম্ভ হলেও শেষপর্যন্ত এই আন্দোলন সাম্প্রদায়িক চরিত্র নেয়। মোট কথা তিতুমিরের আন্দোলন ছিল স্থানীয় জমিদার, নীলকর ও ব্রিটিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন।
ড. বিনয় চৌধুরীর মতে, তিতুমির জমিদারি প্রভুত্বের বিরুদ্ধেই মূলত সংগ্রাম করেন। জমিদাররা বেশিরভাগ হিন্দু ছিলেন বলেই তিনি জমিদারদের ধর্মবিশ্বাসকে আঘাত করতে চান। ডব্লু সি স্মিথ-ও তিতুমিরের আন্দোলনকে কৃষক বিদ্রোহ হিসেবেই দেখেছেন।
ড. অভিজিৎ দত্ত অবশ্য বলেন যে, তিতুমিরের আন্দোলন সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় দিক দিয়ে মিশ্র চরিত্রবিশিষ্ট ছিল। কেনেথ ডব্লু জোনস তিতুমিরের আন্দোলন সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, তিতুমিরের আন্দোলন ধর্ম ও অর্থনীতিকে এমনভাবে মিশ্রিত করেছিল, যার দরুন তাঁকে হিন্দু জমিদার ও ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সংঘাতে অবতীর্ণ হতে হয়।