ফরাজি আন্দোলনের কারণ আলোচনা করো। এই আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব বিশ্লেষণ করো। |
উনিশ শতাব্দীর প্রথমদিকে বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকা প্রভৃতি স্থানে হাজি শরিয়ৎউল্লাহ-র নেতৃত্বে ইসলামের মধ্যে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল। ইসলাম ধর্মকে কঠোরভাবে মেনে চলার লক্ষ্যে ‘ফরাইজ’ বা ‘অবশ্য পালনীয় কর্তব্য’ পালনের জন্য শুরু হওয়া এই গণ আন্দোলন ফরাজি আন্দোলন নামে পরিচিত।
ফরাজি আন্দোলনের কারণ
[1] ইসলাম ধর্মের শুদ্ধতা রক্ষা করে প্রয়োজনীয় সংস্কারসাধন করা তথা সামাজিক কুসংস্কারগুলি দূর করে ইসলাম ধর্মের বিশ্বজনীন আবেদন প্রতিষ্ঠা করার জন্য ফরাজি আন্দোলন শুরু হয়।
[2] মুঘল শাসন বা মুসলমান শাসনের অবসান ঘটিয়ে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষকে শত্রুদের দেশ বা ‘দার-উল-হারব’-এ পরিণত করেছে। এরই বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে শরিয়ৎউল্লাহ ঘোষণা করেন যে, ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত করে ‘ইসলামের পবিত্র দেশ’ বা ‘দার-উল-ইসলাম’-এ পরিণত করতে হবে।
[3] ইংরেজ সমর্থনপুষ্ট নীলকর এবং জমিদার শ্রেণির শোষণ ও অত্যাচারের অবসান ঘটানো ছিল ফরাজি আন্দোলনের অপর এক উদ্দেশ্য।
ফরাজি আন্দোলনের আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য
[1] এটি ছিল ইসলাম ধর্মের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের জন্য কৃষক সম্প্রদায়ের আন্দোলন, যার কেন্দ্রীভবন ঘটেছিল পূর্ব বাংলার ফরিদপুর অঞ্চলে।
[2] ফরাজি আন্দোলনের জনক ছিলেন হাজি শরিয়ৎউল্লাহ। জমিদারদের হাতে উৎখাত হওয়া প্রজা, বেকার, কারিগরশ্রেণির মানুষজন তাঁর অনুগামী সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছিল।
[3] মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত কুসংস্কারগুলির সমালোচনা করা এবং সেগুলি যে ইসলাম ধর্মবিরোধী তা বোঝানোর মধ্য দিয়ে ফরাজি আন্দোলন শুরু হয়। শরিয়ৎউল্লাহ-এর মতে, ইসলামধর্মে সবাই সমান। সেখানে ‘পীর’ (প্রভু) এবং ‘মুরিদ’ (দাস) দুটি শব্দই পরিত্যাজ্য। এর বদলে তিনি ‘ওস্তাদ’ ও ‘শাকরেদ’ শব্দ দুটিকে বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করতেন।
[4] ফরাজি অনুগামীদের নিয়ে বাংলাদেশে তৈরি হয়েছিল ‘ফরাজ-ই-খিলাফৎ’ নামক এক স্বাধীন প্রশাসনিক ব্যবস্থা।
দুদু মিঞার আমলে ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ফরাজি আন্দোলন অধিক শক্তিশালী হয়ে ওঠে। বাহাদুরপুরকে কেন্দ্র করে তিনি ‘ফরাজ-ই-খিলাফৎ’-কে আরও সুসংগঠিত করেন। ঘোষণা করেন, তিনিই পূর্ববঙ্গের প্রকৃত শাসক বা খলিফা। নীলকর এবং জমিদার সম্প্রদায় তাঁর বিরুদ্ধে ইংরেজদের সাহায্য প্রার্থনা করে।
[6] দুদু মিঞার আমলে ফরাজি আন্দোলন গণতান্ত্রিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়। তবে ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে দুদু মিঞার গ্রেফতার হওয়া এবং ৩ বছর বন্দি জীবনযাপনের পর তাঁর মৃত্যু ফরাজি আন্দোলনকে গতিহীন করে দেয়।
ফরাজি আন্দোলনের গুরুত্ব
[1] কৃষকদের মধ্যে নবজাগরণের সঞ্চার: ফরাজি আন্দোলনের গুরুত্ব সম্বন্ধে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও এ কথা অনস্বীকার্য যে, পূর্ব বাংলার কৃষকদের মধ্যে নবজাগরণের সঞ্চার করেছিল এই আন্দোলন। ধর্মীয় রং-এর ছোঁয়া লাগলেও এই আন্দোলনের মূল শক্তি ছিল কৃষকদের ক্ষোভ ও অসন্তোষ।
[2] হিন্দু কৃষকদের অংশগ্রহণ: শুধু মুসলমান কৃষকরাই নয়, অনেক হিন্দু কৃষকও এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন।
[3] রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্য: ধর্মীয় সংস্কারের লক্ষ্য থেকে এই আন্দোলন শেষপর্যন্ত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছিল।
[4] ব্রিটিশ বিতাড়নের প্রেরণা: ফরাজি আন্দোলন ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ করতে না পারলেও বাংলা থেকে ব্রিটিশদের বিতাড়নের প্রেরণা জুগিয়েছিল।