|
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ‘সামরিক বিদ্রোহ’ বলা হয় কেন? |
ভূমিকা
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রকৃতি সম্বন্ধে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন। ঘটনার সূত্রপাত, অংশগ্রহণ, নেতৃত্ব, পরিণতির দিক থেকে বিচার করে অনেকে এই ঘটনাকে সামরিক বা সিপাহি বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন। ভারতীয় সৈন্যরা ‘সিপাহি’ নামে পরিচিত ছিলেন। সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল ‘বেঙ্গল আর্মি’তে। তবে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ১০ মে মিরাটের সেনানিবাসেই প্রকৃতপক্ষে ‘বিদ্রোহ’ শুরু হয়।
সামরিক বিদ্রোহ
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল সেনাছাউনি থেকে। এই বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল অসন্তুষ্ট সিপাহিরা। তাদের অসন্তোষের কারণ ছিল-
[1] পেশাগত বৈষম্য : ইউরোপীয়দের তুলনায় ভারতীয় সেনাদের বেতন ছিল কম। উচ্চপদগুলি ইংরেজদের জন্য সংরক্ষিত থাকত। যোগ্যতা থাকলেও ভারতীয় সেনাদের পদোন্নতি হত না।
[2] বর্ণবৈষম্য: ইংরেজ সৈন্যরা ভারতীয় সেনাদের ‘কালা আদমি’ বলে দুর্ব্যবহার করত। শৃঙ্খলার নামে তারা ভারতীয় সৈন্যদের উপর নির্যাতন করত।
[3] খাদ্য সরবরাহে বৈষম্য: সামরিক শিবিরে ভারতীয় সেনাদের ইউরোপীয় সেনাদের তুলনায় অতি নিম্নমানের খাদ্য সরবরাহ করা হত।
[4] সমুদ্রযাত্রায় অনীহা: তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় হিন্দুদের সমুদ্রযাত্রা বা কালাপানি পার হওয়ায় ধর্মীয় ও জাতিগত বাধা ছিল। কিন্তু সিপাহিদের চাকরির শর্তই ছিল প্রয়োজনে সমুদ্রপথে বিদেশ যেতে হবে। এই বিষয়টিও ছিল সিপাহিদের বিদ্রোহী হওয়ার অন্যতম কারণ।
[5] রীতিপালনে বাধা: ভারতীয় সৈন্যদের পাগড়ি, টিকি, তিলক, দাড়ি রাখা নিষিদ্ধ করা হয়। এ ছাড়া দূরদেশে যুদ্ধে যাওয়ার অতিরিক্ত ভাতাও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
[6] এনফিল্ড রাইফেল: এই অসন্তোষের পটভূমিতে সেনাবাহিনীতে এনফিল্ড রাইফেল-এর ব্যবহার চালু হয়। এর কার্তুজ দাঁতে কেটে রাইফেলে ভরতে হত। গুজব রটে যায়, এই কার্তুজে গোরু ও শূকরের চর্বির প্রলেপ আছে। ফলে হিন্দু-মুসলিম সিপাহিরা ধর্মনাশের আশঙ্কা করে। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে ব্যারাকপুর সেনাছাউনিতে মঙ্গল পাণ্ডের বিদ্রোহের (২৯ মার্চ, ১৮৫৭ খ্রি.) মাধ্যমে।
অযোধ্যার সিপাহিদের অসন্তোষ
বেঙ্গল আর্মির বেশিরভাগ সিপাহি ছিলেন অযোধ্যা রাজ্যের মানুষ। অযোধ্যা রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হলে এইসব সিপাহিরা প্রবল অসন্তুষ্ট হয়। তারা এর প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে।
সূচনা ও বিস্তার
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৬ ফেব্রুয়ারি বহরমপুর সেনাছাউনিতে প্রথম সিপাহিরা বিদ্রোহী হয়। ইংরেজরা সহজেই এই বিদ্রোহ দমন করে। এরপর ব্যারাকপুর সেনাছাউনিতে বিদ্রোহ ঘটে (২৯ মার্চ)। তারপর মিরাট (১০ মে), দিল্লি (১১ মে), আলিগড় (২০ মে), লখনউ (৩০ মে), বেরিলি (৩১ মে), কানপুর (৪ জুন), ঝাঁসি (৬ জুন), ফৈজাবাদ (৭ জুন), হায়দরাবাদ (১৮ জুলাই), দানাপুর (২৫ জুলাই), আরা (২৯ জুলাই), কোলাপুর (৩১ জুলাই), মুলতান (১৭ সেপ্টেম্বর), চট্টগ্রাম (১৮ নভেম্বর), ঢাকা (২২ নভেম্বর) ইত্যাদি সেনাছাউনিতে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহী সিপাহিরা কোথাও স্থানীয় জনগণের সমর্থন পেয়েছিল আবার কোথাও পায়নি। যেখানে তারা জনসমর্থন পেয়েছিল সেখানে তারা ব্রিটিশ প্রশাসনের চিহ্ন ধ্বংস করে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। এভাবে উত্তর ভারতের এক বিস্তীর্ণ অংশে বিদ্রোহের বিস্তার ঘটে।
সংঘর্ষ
বিদ্রোহী সিপাহিরা স্থানীয় এলাকায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। ইংরেজ বাহিনী তাদের দমনে অগ্রসর হলে তারা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। দিল্লি, লখনউ, কানপুর, আরা প্রভৃতি স্থানে ব্যাপক যুদ্ধ হয়। ভারী অস্ত্র, রাইফেল ও দক্ষ সেনাপতির অভাবে বিদ্রোহী সিপাহিরা পরাজিত হয়। দেশীয় রাজাদের সমর্থনপুষ্ট হয়ে ইংরেজরা শেষপর্যন্ত জয়ী হয়।
মূল্যায়ন
স্যার জন লরেন্স, স্যার জন সিলি, চার্লস রেক্স, চার্লস রবার্টস প্রমুখ ব্রিটিশ ঐতিহাসিকগণ এবং সমকালীন বিশিষ্ট ভারতীয় অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, কিশোরীচাঁদ মিত্র, হরিশচন্দ্র মুখার্জি, দাদাভাই নৌরজি, সৈয়দ আহমদ খান, রাজনারায়ণ বসু, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখও এই ঘটনাকে সামরিক বিদ্রোহ বলেছেন। ভারতের সীমিত অঞ্চলে এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে ছিল। শিক্ষিত শ্রেণি বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিল। অধিকাংশ দেশবাসী, অধিকাংশ সৈন্য এবং দেশীয় রাজারা বিদ্রোহ দমনে সাহায্য করে। তাই এই ঘটনাকে সিপাহি বিদ্রোহ বলাই যুক্তিযুক্ত বলে তাঁরা মনে করছেন।