১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ কি সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া ছিল? যুক্তি-সহ লেখো।

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ কি সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া ছিল? যুক্তি-সহ লেখো
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ কি সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া ছিল? যুক্তি-সহ লেখো।

ভূমিকা

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রকৃতি সম্বন্ধে ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। বিদ্রোহের উদ্দেশ্য, ঘটনা প্রবাহ, নেতৃত্ব, অংশগ্রহণ, পরিণতির দিক থেকে বিচার করে অনেক ঐতিহাসিক এই ঘটনাকে ‘সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া’ বা ‘সনাতনপন্থীদের বিদ্রোহ’ বলেছেন।

সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া

১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার নবাব সিরাজ উদ-দৌলাকে পরাজিত করে। অতঃপর কোম্পানি নৃপতি স্রষ্টায় (King Maker) পরিণত হয়ে পরপর মিরজাফর, মিরকাশিম, মিরজাফরের পুত্র নজম উদ-দৌলাকে নবাব মনোনীত করে। অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি, যুদ্ধজয় এবং স্বত্ববিলোপ নীতির দ্বারা বহু দেশীয় রাজ্য (ঝাঁসি, উদয়পুর, করৌলী, সাতারা, জয়িতপুর, তাঞ্জোর, সুরাট) গ্রাস করে। কুশাসনের অভিযোগে দখল করে অযোধ্যা রাজ্য। এর ফলে বহু রাজা-রানি নিজ রাজ্য হারান। সেখানকার অভিজাত, রাজকর্মচারী ও সৈনিক সবাই কর্মচ্যুত ও বেকার হয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবে এইসব শ্রেণি ইংরেজদের প্রতি বিক্ষুব্ধ ছিল। যে-কোনোভাবে তারা ইংরেজ রাজত্ব উৎখাত করতে বদ্ধপরিকর হয়। সিপাহিদের দ্বারা বিদ্রোহ শুরু হলে এইসব বিক্ষুব্ধ শ্রেণি সেই বিদ্রোহে যোগদান করে এবং নিজেদের পুরোনো পদমর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন।

অযোধ্যার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্তি: ইংরেজদের পররাজ্যগ্রাস নীতির নির্লজ্জ উদাহরণ ছিল অযোধ্যা দখল। অযোধ্যা দখলের ফলে অযোধ্যার নবাব, রাজকর্মচারী, অভিজাত, তালুকদার, কৃষক- সব শ্রেণি ইংরেজবিরোধী হয়ে ওঠে। সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হওয়ার মাত্র ১০ দিনের মধ্যে অযোধ্যায় ইংরেজ শাসন লোপ পায়। একইভাবে অযোধ্যাবাসী, যারা ইংরেজ বাহিনীতে সিপাহি ছিলেন তারাও বিক্ষুব্ধ ও বিদ্রোহী হন। অযোধ্যার তালুকদাররা (জমিদার) বিদ্রোহে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

বিস্তার: ব্যারাকপুর সেনাছাউনিতে সিপাহি বিদ্রোহের সূচনা হলেও (২৯ মার্চ, ১৮৫৭ খ্রি.) মিরাট সেনাছাউনির বিদ্রোহ (১০ মে, ১৮৫৭ খ্রি.) প্রকৃত বিদ্রোহের রূপ ধারণ করে। এরপর দিল্লি (১১ মে), আলিগড় (২০ মে), লখনউ (৩০ মে), বেরিলি (৩১ মে), কানপুর (৪ জুন), ঝাঁসি (৬ জুন), ফৈজাবাদ (৭ জুন), হায়দরাবাদ (১৮ জুলাই), দানাপুর (২৫ জুলাই), আরা (২৯ জুলাই), কোলাপুর (৩১ জুলাই), মুলতান (১৭ সেপ্টেম্বর), চট্টগ্রাম (১৮ নভেম্বর), ঢাকা (২২ নভেম্বর) ও অন্যান্য স্থানে সিপাহি বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। এইসব স্থানে বিদ্রোহী সিপাহিরা স্থানীয় জনগণের সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় সহানুভূতি পেয়েছিল। আবার কোথাও দেশীয় শাসক বা জমিদারদের সহযোগিতা লাভ করেছিল। বিদ্রোহী সিপাহিরা মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করলেও তাদের সমর্থক ও নেতৃত্বে ছিলেন দেশীয় শাসকবৃন্দ।

নেতৃত্ব : বিদ্রোহী সিপাহিরা দিল্লি দখল করে বৃদ্ধ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ‘হিন্দুস্তানের সম্রাট’ বলে ঘোষণা করে। কানপুরের পেশায়ার দত্তকপুত্র নানাসাহেব, ঝাঁসিতে রানি লক্ষ্মীবাঈ, অযোধ্যায় বেগম হজরত মহল বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। বিহারের জগদীশপুরের জমিদার কুনওয়ার সিং বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এ ছাড়া বিভিন্ন জমিহারা তালুকদার, ক্ষতিগ্রস্ত ভূস্বামী বিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিলেন।

সংঘর্ষ: এইসব নেতৃবৃন্দের প্রভাবে বিদ্রোহী সিপাহি ও সাধারণ মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে। দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের পক্ষে বকৎ খান দিল্লিতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। ঝাঁসির রানি ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেন। নানাসাহেবের পক্ষে তাঁতিয়া তোপি ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। কুনওয়ার সিং নিজে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন।

পরিণতি: বিদ্রোহ দমনের পর বৃদ্ধ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে রেঙ্গুনে নির্বাসিত করা হয়। তাঁর পুত্র ও পৌত্রদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। রানি লক্ষ্মীবাঈ যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেন। তাঁতিয়া তোপি ও হজরত মহল নেপালে পালিয়ে যান। আরা জেলা ও জগদীশপুরে গণহত্যা চলে।

মূল্যায়ন

ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, ড. সুরেন্দ্রনাথ সেন, তালমিজ খালদুন, রজনীপাম দত্ত প্রমুখ এই বিদ্রোহকে সামন্তদের বিদ্রোহ বলেছেন। রমেশচন্দ্র মজুমদার এই ঘটনাকে ক্ষয়িফ্লু অভিজাত ও মৃতপ্রায় সামন্তদের ‘মৃত্যুকালীন আর্তনাদ’ বলে অভিহিত করেছেন। তালমিজ খালদুন-এর মতে, রাজ্যহারা রাজা-রানি, জমিহারা ভূস্বামী ও কৃষক, কর্মচ্যুত কর্মচারী ও সৈনিক তাদের আগের অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য এই বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল।

Leave a Comment