বাংলার মুদ্রণের ইতিহাসে জেমস অগাস্টাস হিকির অবদান সংক্ষেপে আলোচনা করো। এ ব্যাপারে শ্রীরামপুরের মিশনারিদের অবদান আলোচনা করো |
ভূমিকা
জার্মানির গুটেনবার্গ ছাপাখানা আবিষ্কার করলে ইউরোপে মুদ্রণ জগতে বিপ্লব ঘটে। এর প্রায় শতবর্ষ পরে পোর্তুগিজদের মাধ্যমে ভারতের গোয়ায় ছাপাখানার প্রচলন হয় (১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ)। এরও প্রায় ২০০ বছর পর কলকাতায় ছাপাখানা তৈরি হয়।
হিকির অবদান
জেমস অগাস্টাস হিকি ছিলেন একজন আইরিশ। ছাপাখানার বিকাশে তিনি ছিলেন অন্যতম অগ্রণী ব্যক্তিত্ব।
ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা
প্রথম জীবনে জাহাজ ব্যাবসাতে লিপ্ত অগাস্টাস হিকি প্রচুর লোকসান করেন। প্রচুর ঋণের জন্য তিনি শাস্তির সম্মুখীন হন। এরপর ২০০০ টাকা সংগ্রহ করে কলকাতায় ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে একটি কাঠের ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন।
কার্যাবলি
এই ছাপাখানায় হিকি প্রথমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন বিল এবং ব্যাবসাবাণিজ্যের বাট্টা (Discount) সংক্রান্ত কাগজগুলি ছাপাতে থাকেন। কোম্পানির কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজকর্মের বিষয়ে হিকির প্রায়ই বিবাদ হওয়ায় কোম্পানির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
পত্রিকা প্রকাশ
হিকি ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি বেঙ্গল গেজেট নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই পত্রিকাটি ছিল বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষে প্রথম ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী, লাটসাহেব সকলের কাজকর্মের সমালোচনা ও কেচ্ছাকাহিনি এই পত্রিকায় ছাপা হত। ব্যাবসাবাণিজ্যের সংবাদ এবং কিছু বিজ্ঞাপনও প্রকাশিত হত এই পত্রিকায়। কলকাতার ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা এই পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন।
কিছুকাল পত্রিকা প্রকাশনার পর পত্রিকাটি সরকারের রোষে পড়ে। ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মার্চ পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও স্বীকার করতে হয় হিকির এই প্রচেষ্টা ছিল প্রশংসনীয় এবং অভিনব। এই পথ ধরে পরে অনেকে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন। বহু মানুষের কাছে বই এবং পত্রপত্রিকা পৌঁছে যায়। পেশায় সাংবাদিক না হয়েও জেমস অগাস্টাস হিকি ছিলেন ‘ভারতীয় সাংবাদিকতার জনক’।
শ্রীরামপুর মিশনারিদের ভূমিকা
ব্যাপটিস্ট মিশন প্রতিষ্ঠা
পঞ্চানন কর্মকারের ভূমিকা
শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে শুধু বাংলা হরফে ৩৬টি পুস্তক, একটি সংস্কৃত পুস্তক এবং এইসব মুদ্রিত পুস্তকের আরও ১২টি সংস্করণ প্রকাশ করে। মিশন প্রতিষ্ঠার অল্পদিনের মধ্যেই উইলিয়ম কেরি বাংলা হরফের অন্যতম কারিগর পঞ্চানন কর্মকারকে শ্রীরামপুর মিশনে নিয়ে আসেন। পঞ্চানন কর্মকার হরফ খোদাই ও ঢালাই-এর কাজে দক্ষ ছিলেন। তাঁর দক্ষতা মিশন প্রেসে যোগদানের আগেই প্রমাণিত হয়েছিল। কেন-না তিনিই ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে নতুন বাংলা হরফ তৈরি করেন এবং নিউ টেস্টামেন্ট ছাপার জন্য প্রয়োজনীয় হরফও প্রস্তুত করেন।
গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের ভূমিকা
শ্রীরামপুর মিশন প্রেসের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এমন অপর একজন ব্যক্তিত্ব হলেন মিশন প্রেসের কম্পোজিটর গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য। তাঁর সম্পাদনায় ‘বাঙ্গাল গেজেটি’ প্রকাশিত হয়। তিনি পরে নিজেও ছাপাখানার মালিক হয়েছিলেন।
মিশন প্রেসের কার্যাবলি
১৮০০ থেকে ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দ এই ৩৮. বছরে বাংলা মুদ্রণের ইতিহাসকে পুষ্ট করেছে মিশনের প্রকাশনা। এই মিশন প্রেসের উদ্যোগেই সংস্কৃত থেকে বাংলায় প্রকাশিত হয়েছিল রামায়ণ, মহাভারত, হিতোপদেশ, বত্রিশ সিংহাসন প্রভৃতি। এর সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় ছাপা হয় বিভিন্ন ভাষার বাইবেল ও বিভিন্ন খ্রিস্টান ধর্মগ্রন্থও। কেরির মাধ্যমে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের সঙ্গে শ্রীরামপুর মিশনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে একাধিক পুস্তক ছাপাতে দেয়। আবার মিশন প্রকাশিত পুস্তকের অনেকগুলি কিনে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে। শ্রীরামপুর মিশন থেকে ভূগোল, পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ের উপর বই ছাপা হয়েছিল। উইলিয়ম কেরির পুত্র ফেলিক্স কেরি ছিলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ক রচনার অন্যতম পথপ্রদর্শক।
শ্রীরামপুর প্রেসের অবদান
১৮০০ খ্রিস্টাব্দের পর শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশনের উদ্যোগেই বাংলায় মুদ্রিত বইয়ের অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়। এইভাবে শুধুমাত্র যে দেশীয় শিক্ষা প্রসারেই সহায়ক হয়েছিল তা নয়, শ্রীরামপুর মিশনের উদ্যোগে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় এমনকি গ্রাম ও পশ্চাৎপদ অঞ্চলগুলিতেও তার প্রভাব অনুভূত হয়েছিল। মূলত উইলিয়ম কেরি এবং তাঁর পুত্র ফেলিক্স কেরির দেখানো পথ ধরেই পরবর্তীকালে দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থা অনেক দূর অগ্রসর হয়েছিল।