বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশে কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের ভূমিকা আলোচনা করো। |
ভূমিকা
বাংলাদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের সূত্রে বিজ্ঞান শিক্ষার সূচনা হয়। হিন্দু কলেজ (১৮১৭ খ্রি.) ও শ্রীরামপুর কলেজে (১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ) বিজ্ঞান পড়ানোর ব্যবস্থা হয়। তবে তা ছিল সীমিত অর্থে। এর প্রায় শতবর্ষ পরে বাংলাদেশে বিজ্ঞানচর্চার জন্য পৃথক একটি কলেজ গড়ে ওঠে, যা কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ নামে পরিচিত হয়।
কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের প্রতিষ্ঠা
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলেও ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের আগে সেখানে বিজ্ঞান কলেজ খোলা হয়নি। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৭ মার্চ ব্রিটিশ সরকারের কোনোরকম সাহায্য ছাড়াই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে ‘ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’ (University College of Science and Technology) গড়ে ওঠে। এই বিজ্ঞান কলেজ গড়ে উঠেছিল ব্যারিস্টার স্যার তারকনাথ পালিত ও ব্যারিস্টার স্যার রাসবিহারী ঘোষের আর্থিক সহায়তায়। ৯২ নম্বর আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডে অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠান ‘রাসবিহারী শিক্ষাপ্রাঙ্গণ’ নামে পরিচিত হয়। কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের শিক্ষকদের মধ্যে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ছিলেন। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, স্যার চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন, শিশির কুমার মিত্র, বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ বিজ্ঞান কলেজকে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
পঠনপাঠন
বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলেও সেখানে। পদার্থবিদ্যা ও ভৌত রসায়ন বিভাগে কার্যত কোনো যন্ত্রপাতি ছিল না। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে কাশিমবাজারের মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নিজের কলেজের যন্ত্রপাতি কলকাতা বিজ্ঞান কলেজকে দান করেন। শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপক কুলও কিছু যন্ত্রপাতি ধার দিয়েছিলেন। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে একটি ‘কনডাক্টিভিটি’ যন্ত্র ধার নেওয়া হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম রসায়ন বিভাগ শুরু হলেও বিশুদ্ধ পদার্থবিদ্যা বিভাগের সূচনা হয় ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে ফলিত গণিত বিভাগ শুরু হওয়ার পরে মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু এখানে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। ১৯১৮ এবং ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে যথাক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা এবং প্রাণীবিদ্যা বিভাগ শুরু হয়।
অগ্রগতি
রাসবিহারী ঘোষ এবং তারকনাথ পালিত ছাড়াও রানি বাগেশ্বরী এবং গুরুপ্রসাদ সিং এই সংস্থার জন্য প্রভূত অর্থ দান করেছিলেন। এই অর্থ দিয়েই ফলিত গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও উদ্ভিদবিদ্যা প্রভৃতি ক্ষেত্রে অধ্যাপক পদের সৃষ্টি করা হয়। এ ছাড়া মেধাবী ছাত্রদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়। এইভাবে বিজ্ঞান কলেজ মেধাবী বিজ্ঞানমনস্ক ছাত্রদের বিজ্ঞান গবেষণার এক সুবর্ণ সুযোগ করে দিয়েছিল। এই প্রতিষ্ঠানে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় যেসব বিজ্ঞানীদের একত্রিত করেছিলেন তাঁরা বিজ্ঞানের গবেষণার বিষয়টিকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার আন্তর্জাতিক খ্যাতিও লাভ করেছিলেন। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের তৎপরতায় জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখার্জি, মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু বিজ্ঞান কলেজে যোগ দেন। রসায়ন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের অধীনেই পি সি মিত্র, পি রায়, জে সি ঘোষ প্রমুখ বৈজ্ঞানিক রসায়ন বিভাগের গবেষণার অগ্রগতি ঘটিয়েছিলেন।
অবদান
পরাধীন ভারতে বিজ্ঞানচর্চার পরিকাঠামো তৈরিতে ব্রিটিশ সরকার সহযোগিতা না করলেও বঙ্গভঙ্গ ও তার পরবর্তী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে পদার্থবিদ্যা ও রসায়নে দিকপাল বিজ্ঞানীরা এই কলেজ অলংকৃত করেছিলেন। পদার্থবিদ্যার অন্যতম পথিকৃৎ মেঘনাদ সাহার শ্রেষ্ঠ কীর্তি সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স (Saha Institute of Neuclear Physics) ভারতের বিজ্ঞানচর্চায় অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। এইভাবে কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ বাংলা তথা সমগ্র ভারতে বিজ্ঞানশিক্ষার বিকাশে এক অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল।