জাতীয় শিক্ষা পরিষদ সম্পর্কে আলোচনা করো

সূচিপত্র

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ সম্পর্কে আলোচনা করো
জাতীয় শিক্ষা পরিষদ সম্পর্কে আলোচনা করো।

ভূমিকা

ব্রিটিশ আমলে বিদেশি শিক্ষানীতির দোষত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অনেকেই অবগত ছিলেন। তাই দেশের পণ্ডিতমহল বিদেশি শিক্ষানীতির বিকল্পরূপে দেশীয় প্রগতিশীল শিক্ষানীতি গড়ে তোলার জন্য উনিশ শতক থেকেই সচেষ্ট ছিলেন। তাদের প্রচেষ্টার ফলে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশি ধাঁচে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়। ‘জাতীয় শিক্ষা’ কথাটি সম্ভবত প্রথম ব্যবহার করেছিলেন প্রসন্নকুমার ঠাকুর।

প্রতিষ্ঠা ও প্রতিষ্ঠাতা

১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় ৯২ জন সদস্য নিয়ে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গড়ে ওঠে। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন- আশুতোষ চৌধুরী, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সুবোধচন্দ্র মল্লিক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ গুণীজন।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠনের উদ্দেশ্য হল–

[1] স্বদেশি ধাঁচে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা।

[2] বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান করা।

[3] বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটানো।

[4] শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশাত্মবোধক মনোভাব জাগিয়ে তোলা।

[5] স্বদেশিমন্ত্রে দীক্ষিত ছাত্রদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠার পটভূমি

জাতীয় শিক্ষানীতির আদর্শ প্রচার করার জন্য সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তিনি তাঁর ‘ডন’ পত্রিকা’-য় জাতীয় শিক্ষানীতির সমর্থনে লেখা প্রকাশ করতেন। উনিশ শতকে জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন কোনো সুস্পষ্ট রূপ ধারণ করেনি। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশি-বয়কট আন্দোলন জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের পথ প্রশস্ত করেছিল।

ছাত্রবিরোধী সার্কুলার ও ছাত্র বহিষ্কার: স্বদেশিমন্ত্রে দীক্ষিত অনেক ছাত্র বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। অনেকে আবার বিদেশি শিক্ষা বর্জন করেছিল। ব্রিটিশ সরকার আন্দোলনে যোগদানকারী ছাত্রদের বিরুদ্ধে কার্লাইল সার্কুলার, লিয়ন সার্কুলার-সহ বিভিন্ন সার্কুলার জারি করে। এতে বলা হয়েছিল ছাত্ররা আন্দোলনে যোগ দিলে স্কুল-কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হবে। ফলস্বরূপ অনেক ছাত্র স্কুল-কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিল।

জাতীয় শিক্ষানীতি গ্রহণে অনুষ্ঠিত সভা : স্বদেশি আন্দোলনে যুক্ত ছাত্রদের দমননীতির পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় শিক্ষানীতি গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে ব্রিটিশ শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে একটি সভা আহূত হয়। এই সভায় সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্বরা জাতীয় শিক্ষার সপক্ষে বক্তব্য রাখেন।

অর্থসাহায্য : 
জাতীয় শিক্ষার জন্য অনেক ধনী ব্যক্তি অকাতরে অর্থদান করেন। গৌরীপুরের জমিদার ব্রজকিশোর রায়চৌধুরী ৫ লক্ষ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। ময়মনসিংহের জমিদার সূর্যকান্ত আচার্য ২১%, লক্ষ টাকা ও সুবোধচন্দ্র মল্লিক ১ লক্ষ টাকা দান করেছিলেন।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠন

পণ্ডিত, জমিদার ও জাতীয়তাবাদী প্রভৃতি বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের আন্তরিক সাহায্য ও সহযোগিতায় ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের পরিচালনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপিত হয়।

জাতীয় পরিষদের অধীনস্থ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠনের অল্পকালের মধ্যেই কলাবিদ্যা, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা কোন্টিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে এই নিয়ে মতপার্থক্য শুরু হয়। ফলে দুটি প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।

[1] বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ ও স্কুল: ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট কলকাতার বৌবাজারে বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ (Bengal National College) খোলা হয়। এখানে কলাবিদ্যা, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা দেওয়া হত। অরবিন্দ ঘোষ এর প্রথম অধ্যক্ষ নিযুক্ত হয়েছিলেন। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের উদ্যোগে বিভিন্ন জায়গায় স্কুল খোলা হয়।

[2] বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট: ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জুলাই তারকনাথ পালিত কারিগরি শিক্ষার প্রসারের জন্য বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (Bengal Technical Institute) প্রতিষ্ঠা করেন।

বাংলায় জাতীয় শিক্ষার বিস্তার

কলকাতার পর ঢাকা, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মালদহ প্রভৃতি স্থানে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধীনে বহু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলায় ২৫টি মাধ্যমিক ও ৩০০টিরও বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে ওঠে।

বাংলার বাইরে জাতীয় শিক্ষার বিস্তার

বাংলার বাইরে বোম্বাই, মাদ্রাজ, যুক্তপ্রদেশ, পাঞ্জাব, বেরার প্রভৃতি স্থানে জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রভাবে ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে মসুলিপত্তনমে একটি জাতীয় কলেজ ও অন্ধ্রে একটি জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই জাতীয় শিক্ষার জনপ্রিয়তা বজায় ছিল।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ব্যর্থতার কারণ

বিভিন্ন কারণে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ব্যর্থ হয়েছিল।

[1] জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ও তার অধীনস্থ স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। ফলে জাতীয় শিক্ষার বিস্তার ভারতীয় নেতাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল না।

[2] সরকারের বিরোধিতার ফলে জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা ছাত্রদের চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না।

[3] অনেক শিক্ষার্থী জাতীয় শিক্ষাগ্রহণ অপেক্ষা ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষাগ্রহণেই বেশি আগ্রহী ছিল।

[4] তা ছাড়া এর পতনের অন্যতম কারণ ছিল সরকারের প্রবল বিরোধিতা ও আর্থিক অনটন।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদের গুরুত্ব

উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করতে না পারলেও জাতীয় শিক্ষা পরিষদের গুরুত্বকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না।

[1] জাতীয় শিক্ষা পরিষদ জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে প্রথম কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল।

[2] জাতীয় শিক্ষা পরিষদ মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান ও কারিগরি শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছিল।

[3] রাসবিহারী ঘোষ, তারকনাথ পালিত, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী প্রমুখ ব্যক্তিরা শিক্ষাপ্রসারের মহান আদর্শ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, যা উচ্চ প্রশংসার দাবি রাখে।

মূল্যায়ন

জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রশংসা করে অধ্যাপক সুশোভন সরকার বলেছেন যে, ‘সেদিন যতটা পাওয়া গেল তাই বা উপেক্ষা করি কোন্ যুক্তিতে?’ তাই পরাধীন ভারতে জাতীয় শিক্ষাপ্রসারের এই উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়। তা ছাড়া বর্তমান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বসূরি ছিল এই জাতীয় শিক্ষা পরিষদ।

FAQs on জাতীয় শিক্ষা পরিষদ সম্পর্কে আলোচনা করো।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ১৯০৬ )- এর প্রথম সভাপতি ছিলেন কে?

রাসবিহারী ঘোষ ছিলেন জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রথম সভাপতি।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ কেন প্রতিষ্ঠিত হয়?

১. জাতীয় আদর্শের ভিত্তিতে ভাষা , সাহিত্য, বিজ্ঞান ও কারিগরী শিক্ষার ব্যবস্থা করার জন্য ।
২. শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশসেবার মনোভাব গড়ে তোলার জন্য ।
৩. নৈতিক শিক্ষার প্রসার ঘটানোর জন্য ।
৪. মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার প্রসার ঘটানোর জন্য ।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ কে কত সালে প্রতিষ্ঠা করেন?

সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় 1906 সালের 15ই আগস্ট জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদের সভাপতি ছিলেন কে?

রাসবিহারী ঘোষ ছিলেন জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রথম সভাপতি।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রথম সম্পাদক কে ছিলেন?

রাসবিহারী ঘোষ।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদের সঙ্গে কারা যুক্ত ছিলেন?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখ এই পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

Leave a Comment