বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও

বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও
বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।

ভূমিকা

বাংলায় ইংরেজ শাসন ও পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। পাশ্চাত্য শিক্ষার সূত্র ধরে এদেশে পেশাগত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে কারিগরি শিক্ষার সূচনা হয়। বাংলা তথা ভারতের কারিগরি শিক্ষার বিকাশে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ও বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট-এর অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়।

পূর্বকথা

বাংলায় আধুনিক কারিগরি শিক্ষার বিকাশ ঘটে ব্রিটিশ আমলে। এর আগে ভারতে কারিগরি শিক্ষা ছিল মূলত বংশানুক্রমিক। ভারতে ব্রিটিশদের আগমনের পর প্রয়োজনের তাগিদে কয়েকটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। পরবর্তীকালে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে কলেজটি হাওড়ার শিবপুরে স্থানান্তরিত হয়। এ ছাড়া পুণা ও মাদ্রাজেও কয়েকটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।

বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশ

বিংশ শতকে বাংলায় আধুনিক কারিগরি শিক্ষার বিকাশে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ও বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন পর্বে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ নভেম্বর পার্ক স্ট্রিটে অনুষ্ঠিত এক সভায় স্বদেশি শিক্ষার প্রসারের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ৯২ জন সদস্য নিয়ে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ, রাজা সুবোধ মল্লিক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ। 

প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল–

[1] স্বদেশি ধাঁচে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা,

[2] বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটানো ইত্যাদি।

জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধীনস্থ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধীনে দুটি প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। যথা–

[1] বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ ও স্কুল: ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট কলকাতার বৌবাজারে বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। অরবিন্দ ঘোষ এর প্রথম অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। এখানে কলা, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা দেওয়া হত। এর উদ্যোগে অনেক জায়গায় স্কুল খোলা হয়।

[2] বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (BTI): ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জুলাই আপার সার্কুলার রোডে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট বা BTI প্রতিষ্ঠিত হয়।

BTI-এর পাঠ্যক্রম

BTI-এর প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন প্রমথনাথ বসু। এতে প্রথমদিকে দু-ধরনের পাঠ্যক্রম চালু করা হয়। একটি তিন বছরের অপরটি চার বছরের পাঠ্যক্রম।

এখানে যেসকল বিষয়ে পাঠ দেওয়া হত তা হল- i যন্ত্রবিজ্ঞান ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রবিজ্ঞান, ⅱ ফলিত রসায়ন ও iii ভূবিদ্যা। তবে পাঠ্যক্রমের প্রথমপর্বে পদার্থবিদ্যা, গণিত, ইংরেজি ও চিত্রাঙ্কন বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হত।

BTI-এর অগ্রগতি

এই প্রতিষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন প্রমথ দত্ত, শরৎ বসু, প্রফুল্ল মিত্র, ভূপাল ঘোষ প্রমুখ প্রখ্যাত শিক্ষকগণ। এই প্রতিষ্ঠানের অগ্রগতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল তারকনাথ পালিত মহাশয়ের। জাতীয় বিজ্ঞান পরিষদ প্রযুক্তিবিদ্যাকে সময়োপযোগী ও আধুনিক করে তোলার জন্য উপযুক্ত পাঠ্যক্রম নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল। এই উদ্দেশ্যেই BTI-এর কয়েকজন প্রতিভাবান ছাত্র বিদেশে গিয়ে হাভার্ড, ইয়েল, মিচিগান ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। এই প্রতিষ্ঠানটি ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তির চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছিল। এখান থেকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়।

ছাত্রসংখ্যাবৃদ্ধি

১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে BTI-এর ছাত্রসংখ্যা ছিল ১২৪ জন. ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে তা বেড়ে হয়েছিল ৫২০ জন।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে যাদবপুরে ১০০ বিঘা জমি নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি স্থানান্তরিত হয়। পরে এটি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামে বিখ্যাত হয়।

উপসংহার

বাংলায় কারিগরি শিক্ষা জাতীয় শিক্ষা পরিষদ, বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (BTI) ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে পথ চলা শুরু করে। বাংলা তথা ভারতের প্রযুক্তিবিদ্যার ইতিহাসে এদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। যদিও সমকালে অনেকে এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে মিস্তিরি তৈরির কারখানা বলে উপহাস করেছেন।

Leave a Comment