|
মানুষ, প্রকৃতি ও শিক্ষার সমন্বয় বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। |
ভূমিকা
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাচিন্তায় প্রকৃতি, মানুষ ও শিক্ষার সমন্বয় ঘটেছিল। তিনি শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করে প্রকৃতি, মানুষ ও শিক্ষা বিষয়ে হাতেকলমে পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা চিন্তার প্রাথমিক ধারণা
১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে ‘শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের যে শিক্ষাভাবনার সূচনা হয়, ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ‘ছাত্রসম্ভাষণ’-এ তার পরিসমাপ্তি ঘটে। প্রায় ৪৪ বছর ধরে রবীন্দ্রনাথ ২৩টি প্রবন্ধ, আলোচনা, ভাষণ, অভিভাষণ ও সমালোচনায় শিক্ষার তাত্ত্বিকতা ও প্রয়োগগত সমস্যার কথা সুশৃঙ্খল যুক্তির দ্বারা আলোচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের মতে, শিশু ও বালকের শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হবে তাদের স্বাভাবিক বুদ্ধি ও কল্পনার বিকাশের সুযোগ দান করা। তিনি প্রাচীন ভারতের আশ্রম ও গুরুকুল প্রথাকে আধুনিক জীবনে আনতে চেয়েছিলেন। তিনি মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং কাজেও তা করে দেখিয়েছেন। তিনি মনে করতেন, বিজ্ঞান শুধু পরীক্ষাগারের চার দেয়ালের মধ্যে নেই, তার স্থান ক্লাসঘরের বাইরে, হাটে-মাঠে-মাটিতে। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, পল্লিচর্চা ও পল্লিসংগঠন ছাড়া ভারতীয় শিক্ষা অসম্পূর্ণ।
মানুষ, প্রকৃতি ও শিক্ষার সমন্বয়সাধন
রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির খোলামেলা পরিবেশে শিক্ষাদানের উপর গুরুত্ব দিতেন। শিশুর জীবনের সঙ্গে বিশ্বপ্রকৃতির যোগ তার প্রাণ ও মনের বিকাশের পক্ষে অত্যন্ত মূল্যবান। প্রকৃতির সংস্পর্শেই শিশুর দেহ-মন সুসংগঠিত হয়। তার পরম সত্তাকে সে নিবিড়ভাবে যাতে অনুধাবন করতে পারে সেজন্য শিশুর সুকোমল বৃত্তিগুলির সুষম বিকাশসাধনের উপর সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘শিক্ষা সমস্যা’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, শিক্ষাপ্রাঙ্গণে অবশ্যই কিছুটা জমি থাকবে যেখানে ছাত্ররা চাষ করবে, গোপালন করবে এবং বাগানের পরিচর্যা করবে। এইভাবে প্রকৃতির সঙ্গে মানবমনের অপূর্ব মেলবন্ধনের কথা তিনি বলেছেন।
ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা
রবীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রবল সমালোচক ছিলেন। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে ‘শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধে তিনি বলেন, ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা, পাশ্চাত্যের প্রগতিশীল চিন্তাধারা ও জ্ঞানকে সঠিকভাবে আত্মস্থ করা হয়নি। তিনি সমাজের সমস্ত সমস্যার মূলে অশিক্ষা ও কুশিক্ষাকে দায়ী করেছেন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা সংক্রান্ত চিন্তাভাবনার মধ্য দিয়ে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার কিছু কিছু সমালোচনার পূর্বাভাস দেখতে পাওয়া যায়। যেমন- পাঠ্যপুস্তকের অভাব, একমাত্র ইংরেজি ভাষার মধ্য দিয়েই পাশ্চাত্যের চিন্তাভাবনা ও আদর্শকে বোঝার চেষ্টা প্রভৃতি। তবে তথাকথিত ভদ্রলোকদের সঙ্গে সাধারণ জনগণের ব্যবধানজনিত সমস্যার বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ বরাবরই উল্লেখ করেছেন। তিনি মনে করতেন যে, ঔপনিবেশিক কাঠামোয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি কার্যত জ্ঞানভিক্ষার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে যা জাতীয় সম্মানবোধকে ক্ষুণ্ণ করে। অনুকরণের বদলে বিভিন্ন ধারার সমন্বয়ের উপরেই তিনি বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন, ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থায় মানুষের চারিত্রিক বলিষ্ঠতা, মনের প্রসারতা ও বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে। তাই তিনি ঔপনিবেশিক ও প্রথাগত শিক্ষার বিকল্পস্বরূপ একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তাঁর এই উপলব্ধি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠা ও তার উদ্দেশ্য
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর বিশ্বভারতী পরিকল্পনা তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, যত্র বিশ্বম ভবত্যেকনীড়ম অর্থাৎ যেখানে বিশ্ব একটি নীড়ে পরিণত হবে। এই আদর্শের ভিত্তিতে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রকৃতির সঙ্গে থেকে প্রকৃত শিক্ষালাভে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাসী ছিলেন। এইজন্য তিনি শান্তিনিকেতনের প্রকৃতির মধ্যে তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃতির কাছে থেকে আদর্শ প্রাকৃতিক পরিবেশে শিশু ও কিশোরদের বড়ো হতে সাহায্য করা। তাই বিশ্বভারতীতে ছাত্রদের ক্লাস হত আকাশ ও গাছের তলায়। মানুষের সঙ্গে শিক্ষার সমন্বয়ের জন্য পল্লিগ্রামের সঙ্গেও শান্তিনিকেতনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। শান্তিনিকেতন লাগোয়া কিছু গ্রামের মানুষের তৈরি প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিক্রির ও সকলের মিলনের ক্ষেত্র হিসেবে ‘পৌষমেলা’-র আয়োজন করা হয়। এই মেলায় আশপাশের গ্রামের মানুষেরা তাদের ঘরোয়া সামগ্রী, যেমন- মাটির হাঁড়ি, বেতের তৈরি ধামা, কুলো, লোহার তৈরি কড়াই, হাতা প্রভৃতি বিক্রি করে। তা ছাড়া জমিতে উৎপন্ন ফসলও তারা বিক্রির জন্য নিয়ে আসে। অর্থাৎ বিশ্বভারতীয় শিক্ষা ছিল মানবতাবোধের শিক্ষা, মূল্যবোধের শিক্ষা- যে শিক্ষা আজকের সমাজের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
মূল্যায়ন
যে শিক্ষা মনুষ্যত্ববোধের জন্ম দেয়, সেই শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা- এটাই হল রবীন্দ্র শিক্ষাদর্শনের মূল কথা। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন ভাবনা শুধু বাংলা বা ভারতে নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে এক দিকচিহ্ন হয়ে আছে। তিনি বিশ্বভারতীকে যথার্থই বিশ্বজাতির মহামিলনের ক্ষেত্রে পরিণত করতে পেরেছিলেন।