বামপন্থার বিকাশে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের অবদান লেখো। |
ভূমিকা
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রুশ বিপ্লবের সাফল্য আন্তর্জাতিক স্তরে একটা আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল। এই ঘটনা ভারতেও গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। ১৯২০-র দশক থেকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বামপন্থী সাম্যবাদী মতাদর্শের প্রভাব ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে। এদেশে বামপন্থী ভাবধারা ও আন্দোলন প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন মানবেন্দ্রনাথ রায় বা এম এন রায়।
বামপন্থী মতাদর্শ
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বামপন্থীদের ভূমিকা ও অবদান সম্পর্কে বিতর্কের অন্ত নেই। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, মত ও পথ কঠোরভাবে সমালোচিত হয়েছে। তবে কংগ্রেসের জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বোস প্রমুখ প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ বামপন্থী আন্দোলন দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন।
মানবেন্দ্রনাথ রায়
ভারতে সাম্যবাদী আন্দোলনের জনক ছিলেন নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ওরফে মানবেন্দ্রনাথ রায়। এই দ্বিতীয় নামেই তিনি অধিক পরিচিত ছিলেন। প্রথমে মানবেন্দ্রনাথ পূর্ব বাংলার অনুশীলন দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারত ত্যাগ করেন, উদ্দেশ্য ছিল জার্মানি থেকে অস্ত্রসংগ্রহ। বিভিন্ন দেশ ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে তিনি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে আসেন এবং সেখানে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। এখানেই নরেন্দ্রনাথ ‘মানবেন্দ্রনাথ’ নামগ্রহণ করেন। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে পালিয়ে তিনি মেক্সিকো যান এবং সেখানেই তিনি মার্কসবাদে দীক্ষিত হন। মেক্সিকোতে থাকাকালীন তিনি ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে মিখাইল বোরোদিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর তিনি ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে লেনিনের আমন্ত্রণে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় কংগ্রেসে যোগদান করার জন্য রাশিয়া যান। এই সমাবেশে ঔপনিবেশিক দুনিয়ায় বিপ্লব সফল করার জন্য কমিউনিস্টরা কী ভূমিকা গ্রহণ করবে, সেই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে তাঁর সঙ্গে লেনিনের তীব্র মতভেদ দেখা দেয়।
এই কংগ্রেসে লেনিন ‘উপনিবেশগুলির আশুকর্তব্য’ বা Colonial Thesis নামক খসড়া পেশ করেন, যাতে ভারতের ক্ষেত্রে ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম’ বলতে জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বের কথা বলা হয়। মানবেন্দ্রনাথ এর বিরোধিতা করে একটি পরিপূরক তত্ত্ব পেশ করেন। শেষপর্যন্ত অবশ্য লেনিন কিছুটা হলেও তাঁর সঙ্গে সহমত হন। ফলে পরিমার্জিত ‘ঔপনিবেশিক তত্ত্ব’ উপনিবেশগুলিতে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দিকনির্দেশিকা হয়ে ওঠে।
রাশিয়ায় ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা
১৯২০ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে মানবেন্দ্রনাথ রায়, অবনী মুখার্জি ও খিলাফৎ নেতা মহম্মদ আলি ও মহম্মদ সাফিক একত্রে রাশিয়ার তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের গোড়ায় আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে তাঁদের ভারতে প্রবেশের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। অতঃপর ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে মানবেন্দ্রনাথ রায় বার্লিনে আসেন এবং সেখান থেকে ‘Vanguard of Indian Independence’ নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই সময়েই তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘India in Transition’ প্রকাশিত হয়। এই সময় যে-সমস্ত প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবী মার্কসবাদে আকৃষ্ট হন, তাঁদের মধ্যে বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ও বরকতউল্লাহ-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বামপন্থায় এম এন রায়ের প্রভাব
সাম্যবাদী আন্দোলনের সূচনা ভারতের বাইরে হলেও ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে এই আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে মানবেন্দ্রনাথ অত্যন্ত তৎপর ছিলেন। তিনি নলিনী গুপ্ত ও শওকত ওসমানিকে ভারতীয় বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার জন্য ভারতে পাঠান। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় একটি কমিউনিস্ট গোষ্ঠী স্থাপিত হয়। এর দায়িত্বে ছিলেন মুজফ্ফর আহমেদ। কলকাতার মতো বোম্বাইতেও একটি কমিউনিস্ট গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে ডাঙ্গে, নিম্বকার, নাদকার্ণি, দেশপান্ডে, জোগলেকার প্রমুখ নেতারা গান্ধিবাদী নেতৃত্বে হতাশ হয়ে মার্কসবাদের দিকে ঝোঁকেন। ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের একজন অন্যতম পথিকৃৎ হলেন এস এ ডাঙ্গে। পশ্চিম ভারতের কমিউনিস্ট নেতাদের মধ্যে তিনিই ছিলেন অগ্রগণ্য। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ডাঙ্গে ‘গান্ধি বনাম লেনিন’ নামে ইংরেজিতে একটি পুস্তিকা রচনা করেন। এই পুস্তিকায় তিনি গান্ধি ও লেনিনের মধ্যে তুলনা করে গান্ধির আন্দোলন পদ্ধতির কঠোর সমালোচনা করেন। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি বোম্বাই শহরে ‘Socialist’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। তাঁর সঙ্গে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ক্রমশ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কমিউনিস্ট আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
এম এন রায়-এর সংযোেগবার্তা
১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ২ নভেম্বর মানবেন্দ্রনাথ রায় ডাঙ্গেকে একটি চিঠি লিখে আন্দোলনের পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁর অভিমত জানান। তিনি চান আন্দোলন পরিচালিত হবে দুটি স্তরে। তাঁর মতে, প্রথম স্তরে যে আন্দোলন পরিচালিত হবে, তার চরিত্র হবে জাতীয়তাবাদী, অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা হবে এর কর্মসূচি। অপর কাজটি চলবে গোপনে ও কিছুটা বে-আইনি পথে। এর কাজ হবে শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে সাম্যবাদী বাণী ও আদর্শ প্রচার করে বিপ্লবের জন্য তাদের তৈরি করা। বস্তুত এই ধরনের প্রস্তাব এর আগেই ডাঙ্গে তাঁর Socialist পত্রিকার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কমিউনিস্টরা কংগ্রেসের মত ও পথ নিয়ে সমালোচনা করলেও জাতীয় আন্দোলনের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হননি। কংগ্রেসের বাৎসরিক অধিবেশনে যোগদানকারী সদস্যদের মধ্যে কমিউনিস্ট কর্মসূচি প্রচারের উদ্দেশ্যে এম এন রায় ইস্তাহার রচনা করতেন। এমনকি গান্ধিজির সমালোচনা করা হলেও সাধারণ অত্যাচারিত মানুষের প্রতি তাঁর গভীর মমতার কথাও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। কংগ্রেসের জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে ডাঙ্গে, সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার ও জোগলেকারের হৃদ্যতার সম্পর্ক ছিল।
বামপন্থার প্রসার
কমিউনিস্টদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি অবশ্যই সরকার সুনজরে দেখেনি। মানবেন্দ্রনাথ রায় যেসব কমিউনিস্টকে ভারতে সাম্যবাদী আদর্শ প্রচারের জন্য বা সংগঠন কার্যে নিযুক্ত করার জন্য ভারতে পাঠিয়েছিলেন, তাদের অনেককেই ভারতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা হয়। এদের পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়, সেই মামলা ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলেছিল। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে মুজফ্ফর আহমেদ, ডাঙ্গে, শওকৎ উসমানি ও নলিনী গুপ্তকে কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত করে কারারুদ্ধ করা হয়। এইসব ব্যবস্থা গ্রহণ সত্ত্বেও কিন্তু কমিউনিস্ট আন্দোলন থমকে দাঁড়ায়নি।
কানপুরে কমিউনিস্ট পার্টির সূচনা
১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে কানপুরে কমিউনিস্ট পার্টির একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। কানপুর সম্মেলনেই ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় বলে মনে করা হয়। এই সময় ভারতে কয়েকটি শ্রমিক-কৃষক সংগঠনের জন্ম হয়। ১৯২৫-২৬ খ্রিস্টাব্দে মুজফ্ফর আহমেদ বাংলায় Peasants and Workers Party গঠন করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কুতুবউদ্দিন আহমেদ এবং একদা চিত্তরঞ্জনের সচিব হেমন্ত কুমার সরকার।
মূল্যায়ন
একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকে মানবেন্দ্রনাথ রায় স্মরণীয় হয়ে আছেন। কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মতান্তর ও কংগ্রেস ত্যাগের পর তিনি তৈরি করেন র্যাডিকাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। ভারতে কমিউনিস্ট ভাবধারা প্রচার এবং গোড়ার দিকে কমিউনিস্ট আন্দোলনের নীতি-পদ্ধতি নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন মানবেন্দ্রনাথ। কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থরক্ষার আন্দোলনে তাই তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।