কৃষক আন্দোলনে বাবা রামচন্দ্রের অবদান আলোচনা করো। |
ভূমিকা
১৯২০-র দশকের গোড়ায় মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে যে অসহযোগ ও খিলাফৎ আন্দোলন শুরু হয়েছিল, কৃষকদেরও তা স্পর্শ করেছিল। গান্ধিজির আশা ছিল গ্রাম পুনর্গঠন ও গ্রামোন্নয়ন এবং চরকা ও খাদি আন্দোলনের মাধ্যমে গ্রামবাসীরা অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন করুক। তিনি বাড়তি গুরুত্ব দিয়েছিলেন হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের উপর। যুক্তপ্রদেশের প্রতাপগড়, রায়বেরিলি, সুলতানপুর, ফৈজাবাদে কৃষকরা শোষণের বিরুদ্ধে সংগঠিত হচ্ছিল ঝিঙ্গুড়ি সিং এবং দুর্গাপাল সিং নামের স্থানীয় দুই কৃষক নেতার নেতৃত্বে। তবে বাবা রামচন্দ্র নামের একজন সন্ন্যাসী যুক্তপ্রদেশের কৃষক আন্দোলনে (১৯২০-‘২১ খ্রি.) নতুন এক গতির সঞ্চার করেন।
বাবা রামচন্দ্রের পরিচিতি
মহারাষ্ট্রনিবাসী ব্রাহ্মণ বাবা রামচন্দ্র ১৩ বছর বয়সে গৃহত্যাগ করেন এবং ফিজি দ্বীপে শ্রমিকের জীবনযাপন করার পর ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে যুক্তপ্রদেশের ফৈজাবাদে ফিরে আসেন। তাঁর কাজ ছিল গ্রামে গ্রামে ঘুরে রামায়ণ গান পরিবেশন করা। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে তিনি জৌনপুর ও প্রতাপগড় থেকে কয়েকজন কৃষককে সঙ্গে নিয়ে এলাহাবাদে গৌরীশঙ্কর মিশ্র ও জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড
ধর্মীয় আবেদনের সঙ্গে সঙ্গে বাবা রামচন্দ্র জাতপাতের জিগির তোলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ‘কুর্মী ক্ষত্রিয় সভা’ গঠন করেন। তাঁর আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল জোরজবরদস্তিমূলক কর আদায় বন্ধ করা বা করের পরিমাণ হ্রাস, বেগার প্রথার অবসান, বেদখলি জমি চাষ করতে অস্বীকার, অত্যাচারী ভূস্বামীদের সামাজিকভাবে বয়কট করা ইত্যাদি। স্বাভাবিকভাবেই তালুকদাররা এই কৃষক আন্দোলনকে ভালো নজরে দেখেনি।
বাবা রামচন্দ্রের কৃষক আন্দোলন ও কংগ্রেস
১৯২১ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি থেকে বাবা রামচন্দ্রের নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে এবং হিংসাত্মক হয়ে ওঠে। বিদ্রোহী কৃষকরা তালুকদারদের বাড়ি, ফসলের গোলা, হাটবাজার লুঠ করতে থাকে। গান্ধিজি বিদ্রোহী কৃষকদের এই কাজকে সমর্থন করেননি। সরকার বাবা রামচন্দ্রকে গ্রেফতার করলে কংগ্রেসি নেতারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।
মিথ্যা মামলায় বাবা রামচন্দ্র
বাবা রামচন্দ্রকে চুরির দায়ে গ্রেফতার করা হলে প্রতাপগড় জেলে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য চার-পাঁচ হাজার কৃষক জমায়েত হয়। অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে তাদের ফেরত পাঠানো হয়। এই সময় একটা গুজব রটে যায় যে, বাবা রামচন্দ্রের মুক্তির জন্য স্বয়ং গান্ধিজি আসছেন। এর ফলে কৃষকদের মধ্যে চরম উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখা দেয়। প্রায় ৬০,০০০ কৃষকের জমায়েত হয়। এই পরিস্থিতিতে ভীত হয়ে সরকার তাঁর বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেয় এবং বাবা রামচন্দ্র মুক্তিলাভ করেন। এই সময় কংগ্রেসে অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে যুক্তপ্রদেশ কিষানসভা ভেঙে যায় এবং ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে প্রতাপগড়ে অযোধ্যা কিষানসভা নামে অপর একটি কিষানসভা গড়ে ওঠে। জওহরলাল নেহরু, বাবা রামচন্দ্র মিশ্র, দেওনারায়ণ পাণ্ডে, কেদারনাথ প্রমুখ নেতা এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের তৎপরতায় ৩৩০টি কিষানসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। ডিসেম্বর মাসের শেষদিকে অযোধ্যা কিষানসভা অযোধ্যায় যে বিশাল সমাবেশ আহ্বান করেছিল তাতে প্রায় ১ লক্ষ কৃষক যোগ দেয়। কিষানসভা আন্দোলনের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল এই প্রতিষ্ঠানে উঁচু ও নীচু – উভয় জাতের কৃষকেরই ঠাঁই হয়েছিল।
মূল্যায়ন
যুক্তপ্রদেশের কিষানসভা আন্দোলন কিন্তু শেষপর্যন্ত শান্তিপূর্ণ থাকেনি। বস্তুত এইসব আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল স্থানীয় এলাকার সাধু, সন্ন্যাসী এবং সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত বিক্ষুব্ধ কিছু মানুষ। সরকারকে অবশ্য এই আন্দোলন দমন করতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। ব্যাপক ধরপাকড় করে ও লাঠি-গুলি চালিয়ে এই আন্দোলন ধ্বংস করা হয়। সরকার সংশোধিত অযোধ্যা আইন তৈরি করে প্রজাদের ক্ষোভের কিছুটা উপশম করার চেষ্টা করেছিল। তাতে প্রজারা খুব বেশি উপকৃত না হলেও তাদের মধ্যে কিছুটা আশার সঞ্চার হয়েছিল।