ভারতে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনের উদ্ভব ও বিকাশ সম্বন্ধে আলোচনা করো। |
ভূমিকা
প্রাচীনকাল থেকে ভারতে শ্রমিকশ্রেণির অস্তিত্ব থাকলেও ব্রিটিশ আমলে আধুনিক শিল্প প্রতিষ্ঠা বা ফিনান্স পুঁজির বিকাশ হলে শ্রমিকশ্রেণির উদ্ভব ঘটে। মজুরি বৃদ্ধি, কাজের সময়সীমা হ্রাস ইত্যাদি দাবির কারণে তারা প্রথমে ধর্মঘট শুরু করে এবং পরে আঞ্চলিক ও সর্বভারতীয় শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলে। পৃথক শ্রেণি হিসেবে শ্রমিকেরা আন্দোলন পরিচালনা করতে থাকে।
আধুনিক শিল্প ও শ্রমিকশ্রেণি
ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকার বাতিল হলে ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা এদেশে ‘ফিনান্স পুঁজি’ বিনিয়োগ করে। নীল, চা, কফি প্রভৃতি বাগিচা শিল্পের পাশাপাশি পাট, সুতো, বস্ত্রশিল্প ও লৌহ-ইস্পাত শিল্প গড়ে তোলে। এসময় খনিশিল্পের বিকাশ ঘটে এবং প্রতিষ্ঠিত হয় রেলপথ। ফলে এক আধুনিক শিল্পব্যবস্থা এবং তার সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকশ্রেণির উত্থান ঘটে।
শ্রমিকশ্রেণির দুরবস্থা
এই শ্রমিকদের বেতন খুব কম ছিল। তাদের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে হত। তাদের শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। কাজের সময় ছিল গড়ে ১২ ঘণ্টা। নারী ও শিশুশ্রমিকদের মজুরি খুব কম ছিল। তাদের জীবনের কোনো নিরাপত্তা ছিল না।
কারখানা আইন
সরকার শ্রমিককল্যাণের জন্য কয়েকটি কারখানা আইন পাস করে। যেমন- ১৪ বছরের কমবয়স্ক শ্রমিকদের নিয়োগ না করা, নারী ও শিশুশ্রমিকদের কাজের সময় হ্রাস করা, কারখানার বিপজ্জনক যন্ত্রপাতি নিরাপদে রাখা, কারখানা পরিদর্শক নিয়োগ করা প্রভৃতি। তবে এই সকল বিধান থাকলেও শ্রমিকেরা তার কোনো সুফল পায়নি। রাজনৈতিক নেতারা ইউরোপীয় মালিকানাধীন শিল্পের শ্রমিকদের প্রতি সহানুভূতি দেখালেও দেশীয় শিল্পের শ্রমিকদের দুরবস্থার প্রতি সম্পূর্ণ নীরব ছিলেন।
বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের উদ্ভব
ক্রমে শ্রমিকেরা সংগঠিত হতে থাকে। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার রেলওয়ের (GIPR) সিগন্যাল কর্মীরা ধর্মঘট করে। বিচ্ছিন্নভাবে আরও ধর্মঘট হয়। কিছু মানবতাবাদী নেতা (বি পি ওয়াদিয়া, দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ, বাতিস্তা) শ্রমিকদের দুর্দশা লাঘবের চেষ্টা করেন। এন এম যোশি ইংল্যান্ডের অনুকরণে ভারতে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে সচেষ্ট হন। চিত্তরঞ্জন দাশ, লালা লাজপত রায়, জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু জাতীয় আন্দোলনে শ্রমিকদের যুক্ত করতে সচেষ্ট হন। গান্ধিজিও স্বতন্ত্র ধারায় শ্রমিকদের সংগঠিত করতে মজদুর মহাজন সংঘ ও আহমেদাবাদ শ্রমিক সমিতি গড়ে তোলেন। এরপর লালা লাজপত রায়-এর সভাপতিত্বে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (All India Trade Union Congress) বা AITUC।
শ্রমিক আন্দোলন
AITUC-র শাখা বিভিন্ন রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। BPTUC-র উদ্যোগে বাংলার পাটকলে ১৩৭টি এবং কয়লাখনিতে ১৯৬টি ধর্মঘট হয় (১৯২১ খ্রি.)। ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়েতে ধর্মঘট হয় ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে। আহমেদাবাদের বস্ত্রশিল্পে এবং মাদ্রাজ লেবার ইউনিয়নের নেতৃত্বে মাদ্রাজ বস্ত্রশিল্পেও ধর্মঘট হয়। বোম্বাই শিল্পাঞ্চলে গিরনি-কামগড় ইউনিয়নও ব্যাপক ধর্মঘটে শামিল হয় ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে।
মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা
রুশ বিপ্লব, ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা, সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার প্রসার হলে ব্রিটিশ সরকার আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ৩৩জন কমিউনিস্ট নেতাকে গ্রেফতার করে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করলে শ্রমিক আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে।
AITUC-র ভাঙন
শ্রমিক আন্দোলনে কমিউনিস্টদের বর্ধিত প্রভাব শ্রমিক সংগঠন AITUC-তে প্রতিফলিত হয়। ফলে কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীর সঙ্গে কমিউনিস্টদের মতভেদ ঘটে। পরিণামে AITUC ভেঙে রেড ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (Red Trade Union Congress) গড়ে ওঠে (১৯৩২ খ্রি.)। পরে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের চেষ্টায় পুনরায় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
CSP প্রতিষ্ঠা
১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি (CSP) প্রতিষ্ঠিত হলে শ্রমিক আন্দোলনে গতি আসে। বিশ্বমন্দার প্রভাব কমতে থাকে। ব্রিটিশ সরকার এসময় কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করলে শ্রমিক আন্দোলন আবার দুর্বল হয়ে পড়ে।
মূল্যায়ন
এইভাবে পৃথক শ্রেণি হিসেবে শ্রমিকেরা নানা ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সংগঠিত হয়। দাবি আদায়ের জন্য তারা ধর্মঘট করে। সরকার যদিও শ্রমিককল্যাণের জন্য কারখানা আইন, হুইটলি কমিশন গঠন করেছিল, তথাপি প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থাও (Trade Dispute Bill, Public Safety Bill) বজায় ছিল। ভারতের স্বাধীনতা লাভ পর্যন্ত এই অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি।