অসহযোগ আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকা আলোচনা করো। |
ভূমিকা
উনবিংশ শতকের ভারতে শ্রমিকশ্রেণি এক আলাদা সামাজিক শ্রেণি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাদের বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠন ও একটি সর্বভারতীয় কেন্দ্রীয় সংগঠন (AITUC) গড়ে উঠেছিল। বিভিন্ন মতাদর্শ থাকলেও শ্রমিকশ্রেণির উপর কংগ্রেসের প্রভাবই ছিল বেশি। তা ছাড়া গান্ধিজির আঞ্চলিক সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রভাব শ্রমিকশ্রেণির উপর পড়েছিল। তাই অসহযোগ আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
পরিস্থিতি
অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে। এর আগে পাঞ্জাবে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল (১৩ এপ্রিল, ১৯১৯ খ্রি.)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে সৈন্যবাহিনীতে বেকারত্ব, শ্রমিকদের বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্যসংকট পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলেছিল। ব্রিটিশ সরকার এই সময় দমনমূলক ‘রাওলাট আইন’ পাস করলে দেশবাসী চরম অসন্তুষ্ট হয়। শ্রমিকশ্রেণির উপর এর প্রভাব পড়ে।
শ্রমিক ধর্মঘট
১৯২১ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজির নেতৃত্বে সারা দেশব্যাপী অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। শ্রমিকশ্রেণি স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনে যোগ দেয়। কারণ গান্ধিজির উপর শ্রমিকশ্রেণির আস্থা ছিল। সুমিত সরকারের দেওয়া এক হিসাব থেকে জানা যায়, ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে মোট ৩৯৬টি শিল্পশ্রমিক ধর্মঘট হয়েছিল। এই ধর্মঘটগুলিতে মোট ৬,০০,৩৫১ জন শ্রমিক অংশগ্রহণ করে। এর ফলে মোট ৬৯,৯৪,৪২৬টি শ্রমদিবস নষ্ট হয়।
বাংলাদেশ
বাংলার প্রধান শিল্প ছিল পাটকল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে মন্দার কারণে পাটকলগুলিতে উৎপাদন হ্রাস, শ্রমিক ছাঁটাই, মজুরি হ্রাস অব্যাহত থাকে। ফলে শ্রমিকদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে বাংলায় ইউরোপীয় মালিকানাধীন পাটকলের শ্রমিকেরা ধর্মঘট করে। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে পাটশিল্পে মোট ১৩৭ বার ধর্মঘট হয়। ১,৮৬,৪৭৯ জন শ্রমিক এই ধর্মঘটে অংশ নেয়। কর্তৃপক্ষ এইজন্য শ্রমিকদের জরিমানা ধার্য করে ও মজুরি বন্ধ করে দেয়। এর প্রতিবাদে হাওড়ার সেন্ট্রাল জুটমিল, গার্ডেনরিচ ক্লাইভ এবং সাউথ ইন্ডিয়ান জুটমিল-এর শ্রমিকেরা বিক্ষোভ প্রদর্শন ও ধর্মঘট করে।
স্বামী বিশ্বানন্দ ও স্বামী দর্শনানন্দের নেতৃত্বে রানিগঞ্জ, ঝরিয়া অঞ্চলের কয়লাখনির শ্রমিকেরা সংগঠিত হয়ে সেখানে ধর্মঘট করে। যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত রেলপথ ও জলপথে স্টিমার পরিবহণের কর্মীদের সংগঠিত করেন এবং ধর্মঘট পালিত হয়। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট অ্যাসোসিয়েশন গড়ে ওঠে। ৫০০০ শ্রমিক গান্ধিটুপি পরে কাজ করতে গেলে ইংরেজ সুপারভাইজার শ্রমিকদের টুপি খোলার নির্দেশ দেয়। এই নির্দেশের প্রতিবাদে শ্রমিকেরা ধর্মঘট করে।
অন্যান্য রাজ্য
অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউ আসামেও পৌঁছেছিল। এখানকার চা বাগানের শ্রমিকেরা অধিকাংশই ছিলেন বিহারের অধিবাসী। তারা গান্ধিজির আহূত আন্দোলনে যোগদানের জন্য চা বাগান ছেড়ে বিহারে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে। তখন চা বাগানের মালিকপক্ষের ইন্ধনে পুলিশ শ্রমিকদের উপর নির্যাতন চালায়।
মাদ্রাজে ইংরেজ মালিকানাধীন বাকিংহাম এবং কর্ণাটকে টেক্সটাইল মিল-এর শ্রমিকেরা ধর্মঘট করে (২২ অক্টোবর, ১৯২১ খ্রি.)। থিরু ভিকা ছিলেন এখানকার কংগ্রেস নেতা। তিনি ধর্মঘটি শ্রমিকদের সমর্থন করেন।
মূল্যায়ন
যদিও গান্ধিজি শ্রমিক ধর্মঘটকে অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করতে চাননি এবং তিনি লিখেছিলেন, ‘ধর্মঘট অহিংস অসহযোগের পরিকল্পনার আওতায় পড়ে না’, তথাপি অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে কংগ্রেসি নেতারা শ্রমিক ধর্মঘটের আয়োজন করে। শ্রমিকশ্রেণি তাদের শ্রেণিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। এই আন্দোলনে কৃষকশ্রেণি কোথাও কোথাও হিংসাত্মক হয়ে উঠলেও শ্রমিকেরা তা হয়নি। গান্ধিজির মতাদর্শের প্রতি তারা যথোচিত সম্মান প্রদর্শন করেছিল।