বিংশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো

বিংশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো
বিংশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো।

ভূমিকা

বিংশ শতকের ভারতে জাতীয় আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল বিভিন্ন আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ। এই সময় জাতীয়তাবাদীরা দেশকে মাতৃরূপে কল্পনা করে। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বিংশ শতকের সূচনায় নারী আন্দোলন (স্বদেশি আন্দোলনে নারী)

বিংশ শতকের শুরুতে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে বাংলায় যে বঙ্গভঙ্গবিরোধী (স্বদেশি-বয়কট) আন্দোলন হয়েছিল তাতে নারীরা অংশগ্রহণ করেন। এই আন্দোলনে যুক্ত নারীরা সামাজিক পীড়ন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে দৃঢ় সংগ্রামী মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আহ্বানে রাখিবন্ধন উৎসবে মহিলারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেন। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ‘অরন্ধন দিবস’ পালন করার আবেদন জানালে নারীরা ঘরে ঘরে অরন্ধন পালন করে। বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করার দিনে (১৯০৫ খ্রি.-এর ১৬ অক্টোবর) আনন্দমোহন বসু হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রতীক হিসেবে আপার সার্কুলার রোডে মিলন মন্দির বা ফেডারেশন হলের ভিত্তি স্থাপন করলে নরনারী নির্বিশেষে ভাবাবেগে আপ্লুত হয়।

আন্দোলনের পরবর্তী পর্বে যখন বিদেশি দ্রব্য বর্জন করে স্বদেশি দ্রব্য গ্রহণের আন্দোলন শুরু হয় তখন বাংলার নারীরা তাতেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেন। সরলাদেবী চৌধুরাণী প্রতিষ্ঠিত ‘স্বদেশি ভাণ্ডার’ স্বদেশি দ্রব্য বিপণনের একটি প্রধান কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ নামে স্বদেশি দ্রব্য উৎপাদন সংস্থা এবং ‘বীরাষ্টমী ব্রত’ উদ্যাপন স্বদেশি চেতনা জাগ্রত করতে সাহায্য করেছিল। স্বদেশি আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কুমুদিনী মিত্র, লীলাবতী মিত্র, নির্মলা সরকার, হেমাঙ্গিনী দাস, ভগিনী নিবেদিতা প্রমুখ।

তবে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময় নারী আন্দোলন মূলত উচ্চবর্ণ, ধনী, বুর্জোয়া, শহুরে নারীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

১৯২০-র দশকে নারী আন্দোলন (অসহযোগ আন্দোলনে নারী)

১৯২০ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজির নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা হয়। গান্ধিজির নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ অনেক বেশি বেড়ে যায়।

গান্ধিজি তাঁর আন্দোলনে নারীদের জন্য সীমিত কর্মসূচি গ্রহণ করেন। নারীদের স্বদেশি দ্রব্য গ্রহণ ও বিদেশি দ্রব্য বয়কট করার কথা বলা হয়। নারীরা এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

এই আন্দোলনে নারীরা পিকেটিং-এ অংশগ্রহণ করেন।

১৯২১ খ্রিস্টাব্দে প্রিন্স অফ ওয়েলস ভারত ভ্রমণে এলে হাজার হাজার নারী বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।

নারীরা ‘তিলক স্বরাজ তহবিল’-এ টাকা ও গয়না দান করেন। তারা চরকায় সুতো কেটে ও কাপড় বুনে স্বদেশি কর্মসূচি পালন এবং ‘খাদি আন্দোলন’-কে জোরদার করে তোলেন।

১৯২২ খ্রিস্টাব্দে স্টিমার ধর্মঘটে নেলী সেনগুপ্ত নেতৃত্ব দেন।

১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে লতিকা ঘোষের নেতৃত্বে ও সুভাষচন্দ্র বসুর মা প্রভাবতী বসুর সভাপতিত্বে মহিলা রাষ্ট্রীয় সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে কলকাতায় স্বেচ্ছাসেবিকা বাহিনী গঠিত হয়।

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় নারী সত্যাগ্রহ সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। 

১৯৩০-এর দশকে নারী আন্দোলন (আইন অমান্য আন্দোলনে নারী)

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজির নেতৃত্বে পরিচালিত আইন অমান্য আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ আরও বেশিমাত্রায় লক্ষ করা যায়। গান্ধিজির লবণ সত্যাগ্রহে, ডান্ডি অভিযানে হাজার হাজার নারী স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগদান করেন। নারীরা বিভিন্নভাবে আইন অমান্য, সভা-সমাবেশ, পিকেটিং প্রভৃতি ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

এই পর্বের আন্দোলনে পশ্চিম গোদাবরী ও মহারাষ্ট্রের দেবদাসীরা এবং বাংলার পতিতা মহিলারা নিজেদের গায়ের গয়না ও ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ত্যাগ করেছিলেন।

‘ভারতের বুলবুল’ নামে পরিচিত সরোজিনী নাইডু ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে ধরসনা লবণগোলা দখল অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

১৯৩০-৩২ খ্রিস্টাব্দে ভারতের নানা প্রান্তে যেসব নারী সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বাসন্তী দেবী, কমলা নেহরু, আশালতা সেন, ইন্দুমতী গোয়েঙ্কা, ফুলবাহার বিবি প্রমুখ।

বিপ্লবী আন্দোলনে নারী: বাংলায় যে বিপ্লবী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল তাতেও শিক্ষিত নারীরা অংশগ্রহণ করেন। এক্ষেত্রে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, বীণা দাস, শান্তি ঘোষ, সুনীতি চৌধুরী, সুহাসিনী গাঙ্গুলির নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

১৯৪০-এর দশকে নারী আন্দোলন (ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারী)

১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে ভারত ছাড়ো আন্দোলন হয় তাতে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল আরও বেশি সক্রিয়। অরুণা আসফ আলি, সুচেতা কৃপালিনি, ঊষা মেহতা সক্রিয়ভাবে এতে অংশগ্রহণ করেন। ঊষা মেহতা গোপনে কংগ্রেসের বেতারকেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতেন।

বাংলার মেদিনীপুরের তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারে মহিলারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এখানে নারী স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে ভগিনী সেনা গঠিত হয়।

‘গান্ধিবুড়ি’ নামে পরিচিত মাতঙ্গিনী হাজরা তমলুক থানা আক্রমণ করার সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হন। তা ছাড়া আসামের ১০ বছরের কিশোরী কনকলতা বড়ুয়া, পাঞ্জাবের যোগেশ্বরী ফুকোননীর নামও এক্ষেত্রে স্মরণীয় হয়ে আছে।

সুভাষচন্দ্র বসু যে আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠন করেছিলেন তাতেও নারীদের অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। এই বাহিনীতে ঝাঁসির রানি ব্রিগেডের নেত্রী ছিলেন লক্ষ্মী স্বামীনাথন। প্রায় ১৫০০ নারী এই বাহিনীতে যোগদান করেছিলেন।

মূল্যায়ন

ভারতের জাতীয়তাবাদী ও বিপ্লবী আন্দোলনের সর্বক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ লক্ষ করা যায়। তা ছাড়া তেভাগা, তেলেঙ্গানা আন্দোলনেও নারীরা অংশগ্রহণ করেন। তেভাগা আন্দোলনে নারীরা ‘ঝাঁটা বাহিনী’, ‘বঁটি বাহিনী’ গড়ে তোলেন। নারীদের অংশগ্রহণের ফলে ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন গণ আন্দোলনের রূপ ধারণ করে।

Leave a Comment