বিশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলনের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো

বিশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলনের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো
বিশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলনের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।

ভূমিকা

উনিশ শতকে মিশনারিদের উদ্যোগে এদেশে নারীদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার সূচনা হয়। ব্রাহ্মনেতাদের প্রচেষ্টায় বিভিন্ন বালিকা বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর নারীদের বিভিন্ন সামাজিক কুপ্রথার হাত থেকে রক্ষা করেন। এই উদ্যোগ ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও প্রসারিত হয়। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নারীদের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণের কথা প্রচারিত হতে থাকে। ফলে নারী আন্দোলনের প্রসার ঘটে।

নারী আন্দোলনের চরিত্র

উনিশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলনের যে সূচনা হয়েছিল বিশ শতকে তা পূর্ণতা লাভ করে। এই নারী আন্দোলনের চরিত্র ছিল–

উচ্চবর্গীয়:
বিশ শতকের নারী আন্দোলন সমাজের উচ্চস্তরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সমাজে যারা বিত্তবান ছিলেন, পাশ্চাত্য শিক্ষালাভের সুযোগ পেয়েছিলেন, তারাই এই আন্দোলনে যোগদান করেন। এইসব নারীরা তাদের শ্রেণিচেতনার বাইরে আসতে পারেননি। দেশের সমগ্র নারীসমাজের কল্যাণের কথা তারা চিন্তা করেননি। নারীদের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মনোভাব লক্ষ করা গেলেও তা ছিল নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ।

পর্দাপ্রথা: ভূপালের বেগমেরা পর্দাপ্রথার বিরোধিতা করে দৃষ্টান্ত গড়ে তোলেন। সমাজের অভিজাত নারীরাও পর্দাপ্রথার বিরোধিতা করেন। তাদের আন্দোলনের যুক্তি ছিল, নারীকে যদি সামাজিক জীবনের অগ্রগতিতে অংশ নিতে হয়, তাদের সন্তানদের শিক্ষাদানের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয় তাহলে পর্দাপ্রথাকে বিদায় জানাতে হবে।

বাল্যবিবাহ:
বিদ্যাসাগরের চেষ্টায় বিধবাবিবাহ আইন পাস (১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে) এবং বি এম মালবারির চেষ্টায় এজ অফ কনসেন্ট অ্যাক্ট (Age of Consent Act) (১৯১২ খ্রি.) পাস হলেও বিধবাবিবাহ তেমনভাবে চালু হয়নি বা বাল্যবিবাহও বন্ধ হয়নি। নারী আন্দোলনের ফলে চাইল্ড ম্যারেজ রেসট্রেন্ট অ্যাক্ট (Child Marriage Restraint Act) (১৯২৯ খ্রি.) পাস হয়। এর দ্বারা বিবাহের ন্যূনতম বয়স বাড়ানো হয়। ড. শুভলক্ষ্মী রেড্ডির চেষ্টায় সরকার ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে নারীদের পক্ষে একটি আইন পাস করে।

শিক্ষার অধিকার: বিভিন্ন মিশনারি সংস্থা, প্রগতিশীল পারসি সমাজ, অধ্যাপক কার্ভের মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় নারী শিক্ষাপ্রসারে বিশিষ্ট অবদান রাখে। নারীরাও উচ্চশিক্ষার দাবি জানায়। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে সারা দেশে ছাত্রীসংখ্যা ছিল ১২,৩০,০০০ জন। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে তা বেড়ে হয় ২৮,৯০,০০০ জন।

রাজনীতি: বিশ শতকের গণ আন্দোলনগুলিতে নারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। পিকেটিং, মিছিলে হাঁটা, কারাবরণ, লাঠি-গুলির আঘাত সহ্য করা সবক্ষেত্রেই মেয়েদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। সরোজিনী নাইডু, অরুণা আসফ আলি, বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত, কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়, নেলী সেনগুপ্ত, বাঈ আম্মান-এর নাম এক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এঁদের অনেকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে খ্যাতিলাভ করেন। সরোজিনী নাইডু নারীর ভোটাধিকারের দাবি জানান।

শ্রেণিসংগ্রাম: দরিদ্র, অশিক্ষিত নারীরাও কৃষক-শ্রমিক ধর্মঘটে, পথসভায় ও বিক্ষোভে অংশ নেন। কেউ কেউ কিষানসভা ও ট্রেড ইউনিয়নের সদস্যাও নিযুক্ত হন।

বৈশিষ্ট্য

শহরকেন্দ্রিকতা: এই নারী আন্দোলন ছিল প্রধানত শহরকেন্দ্রিক। গ্রামের বেশিরভাগ নারীর সঙ্গে এই আন্দোলনের কোনো যোগ ছিল না।

সীমাবদ্ধতা: এই আন্দোলন কেবল নিজ নিজ শ্রেণিস্বার্থে পরিচালিত হয়। দেশের সমগ্র সমাজকে তা সংযুক্ত করতে পারেনি। মুসলিম নারীদের কাছে টানতে পারেনি এই আন্দোলন।

পাশ্চাত্যধর্মী: এই আন্দোলন পাশ্চাত্যধর্মী ছিল। এর প্রেরণা, চিন্তাধারা ও আদর্শ দেশজ ছিল না।

মূল্যায়ন

সীমিত শহুরে শ্রেণিস্বার্থে পরিচালিত হলেও এই নারী আন্দোলন ছিল ব্রিটিশ ভারতের এক অভিনব ঘটনা। এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। নবজাগরণ ও নবভারত গঠনের ক্ষেত্রে এর এক ইতিবাচক অবদান ছিল।

Leave a Comment