নেপোলিয়নের পতনের কারণ গুলি আলোচনা করো

নেপোলিয়নের পতনের কারণ গুলি আলোচনা করো

নেপোলিয়নের পতনের কারণ গুলি আলোচনা করো
নেপোলিয়নের পতনের কারণ গুলি আলোচনা করো

ভূমিকা

নেপোলিয়ন অসামান্য প্রতিভাবলে একজন সামান্য সৈনিক থেকে ফ্রান্সের শাসক বা সম্রাট হয়েছিলেন। তিনি সমগ্র ইউরোপব্যাপী এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কিন্তু তাঁর সাম্রাজ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।

নেপোলিয়নের পতনের কারণ

নেপোলিয়নের অপরিমিত উচ্চাকাঙ্ক্ষা

নেপোলিয়ন ছিলেন অপরিমিত উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি। তিনি সামরিক শক্তির জোরে যতই সাম্রাজ্য বিস্তার করতে থাকেন ততই তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাড়তে থাকে। তিনি সমগ্র ইউরোপের অধীশ্বর হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু এই বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করার মতো রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি তাঁর ছিল না।

সাম্রাজ্যের দুর্বল ভিত্তি

নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যের ভিত্তি ছিল দুর্বল। সামরিক শক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত এই সাম্রাজ্যের প্রতি জনগণের সমর্থন ছিল না। তা ছাড়া তিনি যুদ্ধের মাধ্যমে যেসব জাতিকে ফ্রান্সের অন্তর্ভুক্ত করেন, সেসব জাতিও নেপোলিয়ন ও ফরাসি শাসনকে ঘৃণার চোখে দেখত।

স্বৈরাচারী শাসন

নেপোলিয়ন ফরাসি বিপ্লবের হাত ধরে ক্ষমতালাভ করেছিলেন। কারণ ফরাসি বিপ্লবের আদর্শে তিনি ইউরোপে বংশানুক্রমিক স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটানোর কথা বলেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি যে শাসন ইউরোপের উপর চাপিয়েছিলেন, তা ছিল আরও বেশি মাত্রায় স্বৈরাচারী। জাতীয়তাবাদের আদর্শ প্রচার করলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন জাতীয়তাবাদের বিরোধী। ইটালি, স্পেন ও জার্মানি-তে
তিনি তাঁর পুত্র এবং ভাইদের শাসক হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন।

মহাদেশীয় অবরোধ প্রথা

নেপোলিয়ন ইংল্যান্ডকে দুর্বল করার জন্য মহাদেশীয় অবরোধ প্রথা ঘোষণা করেছিলেন। এই ব্যবস্থা কার্যকর করার জন্য তিনি বিভিন্ন দেশের উপর বলপ্রয়োগ করতেও পিছপা হননি। ফলে রুষ্ট হয়ে ওইসব দেশ নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল এবং তাঁর সমস্ত পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করেছিল।

তা ছাড়া এই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য প্রয়োজনীয় নৌশক্তিও তাঁর ছিল না। তাই এই মহাদেশীয় অবরোধ প্রথা ছিল নেপোলিয়নের পতনের অন্যতম কারণ।

ধর্মীয় বিবাদ

নেপোলিয়নের সঙ্গে পোপ সপ্তম পায়াসের এক ‘ধর্মমীমাংসা চুক্তি’-র ফলে ফ্রান্সে ক্যাথলিক ধর্মকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এতে প্রোটেস্ট্যান্টরা ক্ষুব্ধ হয়। আবার পোপ মহােেদশীয় ব্যবস্থা মানতে অস্বীকার করায় নেপোলিয়ন পোপকে বন্দি করেন। এর ফলে সমগ্র ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীরা নেপোলিয়নের উপর ক্ষুব্ধ হয়।

স্পেন ও মস্কো নীতি

নেপোলিয়ন স্পেনের সিংহাসনে তাঁর ভাই জোসেফকে বসিয়ে স্পেনবাসীর আত্মমর্যাদায় আঘাত করেছিলেন। নেপোলিয়ন স্পেনের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান করলে স্পেনীয়রা সেই অভিযান ব্যর্থ করে দেয়। নেপোলিয়ন এ সম্পর্কে বলেছিলেন, “স্পেনীয় ক্ষতই আমাকে ধ্বংস করেছে” (“The Spanish ulcer ruined me.”)। নেপোলিয়নের পতনের অন্যতম কারণ ছিল দূরবর্তী ও ভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশের মস্কো অভিযান। এই অভিযানের সামরিক ব্যর্থতা তাঁর মর্যাদাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিল।

ইংল্যান্ডের বিরোধিতা

নৌশক্তিতে বলীয়ান ইংল্যান্ডের বিরোধিতা নেপোলিয়নের পতনকে সুনিশ্চিত করেছিল। ইংল্যান্ড নীলনদ ও ট্রাফালগারের যুদ্ধে নেপোলিয়নকে পরাস্ত করে এবং তাঁর মহাদেশীয় অবরোধ প্রতিহত করে। এ ছাড়া ইংল্যান্ড উপদ্বীপের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে নেপোলিয়নের শক্তিকে বিধ্বস্ত করেছিল।

জাতিসমূহের যুদ্ধ

নেপোলিয়নের রাশিয়া অভিযানের ব্যর্থতা ইউরোপের দেশগুলিকে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধভাবে লড়াইয়ে নামার প্রেরণা জোগায়। ইটালি, অস্ট্রিয়া, জার্মানি, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশে মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয় এবং চতুর্থ শক্তিজোট (ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, রাশিয়া, প্রাশিয়া) লিপজিগের বা জাতিসমূহের যুদ্ধে নেপোলিয়নকে পরাজিত করে।

উপসংহার

বহু যুদ্ধে জয়ী দুর্ধর্ষ সামরিক শক্তির অন্যতম অধিকারী নেপোলিয়ন ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে পরাজিত হয়ে ভূমধ্যসাগরের এলবা (Elba) দ্বীপে নির্বাসিত হন, কিন্তু পরের বছর তিনি আবার ফ্রান্সে এসে সিংহাসন দখল করেন। শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয় দেশগুলির মিলিত আক্রমণে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ জুন ওয়াটারলুর যুদ্ধে (Battle of Waterloo) তিনি চূড়ান্তভাবে পরাজিত হন এবং আটল্যান্টিক মহাসাগরের সেন্ট হেলেনা (Saint Helena) দ্বীপে নির্বাসিত হন। অবশেষে ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে এই দ্বীপেই নেপোলিয়নের মৃত্যু হয়।

আরও পড়ুন – ভারতে রেলপথ প্রবর্তনের উদ্দেশ্য ও প্রভাব আলোচনা করো

Leave a Comment