নেপোলিয়নের অভ্যন্তরীণ সংস্কারগুলির বর্ণনা দাও

নেপোলিয়নের অভ্যন্তরীণ সংস্কারগুলির বর্ণনা দাও

নেপোলিয়নের অভ্যন্তরীণ সংস্কারগুলির বর্ণনা দাও
নেপোলিয়নের অভ্যন্তরীণ সংস্কারগুলির বর্ণনা দাও।

ভূমিকা

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ‘কনসাল’ (Consul) রূপে ফ্রান্সের শাসনভার গ্রহণ করেন। ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি নিজেকে ফ্রান্সের সম্রাট’ বলে ঘোষণা করেন এবং ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ছিল তাঁর রাজত্বকাল। তাঁর রাজত্বকালে তিনি সুশাসক, সংস্কারক ও সংগঠক হিসেবে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। নেপোলিয়নের অভ্যন্তরীণ সংস্কার প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ফিশার (Fisher) বলেছেন যে, তাঁর সংস্কারগুলি গ্রানাইট পাথরের শক্ত ভিত্তির উপর স্থায়ীভাবে নির্মিত (his civilian work in France was built upon granite.”)

নেপোলিয়নের সংস্কারের উদ্দেশ্য

নেপোলিয়নের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের উদ্দেশ্য ছিল- ফ্রান্সে জনকল্যাণকর কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা, ফ্রান্সের অর্থনীতি, আইন, বিচার, শিক্ষা প্রভৃতি ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি।

নেপোলিয়নের সংস্কার

শাসনতান্ত্রিক সংস্কার

বিপ্লবজনিত কারণে দীর্ঘদিন ধরে ফ্রান্সে বিশৃঙ্খলা চলছিল। শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার একমাত্র পথ হিসেবে নেপোলিয়ন শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রীকরণ করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন।

  • এই উদ্দেশ্যে শাসনকার্যের সুবিধার জন্য সমগ্র ফ্রান্সকে ৮৩টি প্রদেশে বিভক্ত করে প্রতিটি প্রদেশের শাসক হিসেবে প্রিফেক্টদের নিয়োগ করেন।
  • প্রাদেশিক ও পৌরসভাগুলির স্বায়ত্তশাসনের অধিকার হ্রাস। করা হয়।
  • নির্বাচনের মাধ্যমে কর্মচারী নিয়োগের প্রথা বাতিল করে নিজের পছন্দমতো কর্মচারী নিয়োগ শুরু করেন।

অর্থনৈতিক সংস্কার

দেশের অর্থনৈতিক সংকট দূর করার উদ্দেশ্যে নেপোলিয়ন বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। যথা-

  • তিনি আর্থিক বিপর্যয়কে সামাল দেওয়ার জন্য ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা Bank of France প্রতিষ্ঠা করেন।
  • ব্যাবসাবাণিজ্যের উন্নতির জন্য তিনি নতুন রাস্তাঘাট নির্মাণ, স্টক এক্সচেঞ্জ গঠন, বন্দরের সংস্কার করেন।
  • ফ্রান্সের অর্থব্যবস্থাকে মজবুত করার জন্য সোনা ও রুপোর নতুন মুদ্রা চালু করেন।
  • তিনি সরকারি দপ্তরের ব্যয়সংকোচ ও অডিট প্রথা চালু করেন।
  • সবাইকে আয়কর প্রদানে বাধ্য করেন।
  • নতুন কর না চাপিয়ে পুরোনো কর আদায়ের উপর জোর দেন।

কোড নেপোলিয়ন আইন ও বিচার সংস্কার

নেপোলিয়নের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হল ২২৮৭টি ধারাযুক্ত ‘আইন সংহিতা’ বা ‘কোড নেপোলিয়ন’ (Code Napoleon) সংকলন। নেপোলিয়ন ফ্রান্সের ৪ জন বিশিষ্ট আইনবিদের সহায়তায় ৪ বছর (১৮০০-১৮০৪ খ্রি.) ধরে ৮৪টি অধিবেশনে অক্লান্ত পরিশ্রম কবে এই ‘আইন সংহিতা’ সংকলন করেন। এই সংহিতা তিন ভাগে বিভক্ত- দেওয়ানি আইন, ফৌজদারি আইন, এবং বাণিজ্যিক আইন। এই আইন সংহিতা অনুসারে—

  • আইনের দৃষ্টিতে সকলের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়।
  • যোগ্যতার ভিত্তিতে সরকারি চাকুরিতে নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়।
  • ব্যক্তিস্বাধীনতা স্বীকৃত হয়।

শিক্ষা সংস্কার

নেপোলিয়ন ফ্রান্সের প্রকৃত উন্নতির জন্য শিক্ষাক্ষেত্রেও সংস্কার সাধন করেন-

  • তিনি প্রতি কমিউনে (পৌরসভা) একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
  • সামরিক শিক্ষাদানের জন্য ২৯টি লাইসি (Lycee) বা সরকারি আবাসিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
  • ইঞ্জিনিয়ারিং, চিকিৎসাবিদ্যা, শিক্ষক-শিক্ষণ প্রভৃতি অনেক বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
  • ফরাসিদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য তিনি ‘ইম্পিরিয়াল ইউনিভার্সিটি অফ ফ্রান্স’ (Imperial University of France) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে।

ধর্মীয় সংস্কার

নেপোলিয়ন যে-কোনো মূল্যে পোপের সঙ্গে বিরোধের অবসান চেয়েছিলেন। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে পোপ সপ্তম পায়াসের (Pius VII) সঙ্গে তিনি কনকর্ডাট (Concordat) বা ধর্মমীমাংসা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুপ্তিতে বলা হয়-

  • গির্জা ও তার বিষয়-সম্পত্তির জাতীয়করণকে পোপ মেনে নেবেন।
  • রোমের ক্যাথলিক ধর্ম ও চার্চগুলিকে ফ্রান্সের সরকার স্বীকৃতি দেবে।
  • সরকার কর্তৃক মনোনীত যাজকদের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবেন পোপ।
  • ফ্রান্স ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা পাবে।
  • ফ্রান্সের জনগণ ধর্মীয় স্বাধীনতা লাভ করবে।

অন্যান্য সংস্কার

  • নেপোলিয়ন যোগ্য ও গুণী ব্যক্তিকে সম্মানিত করার জন্য ‘লিজিয়ন অফ অনার’ (Legion of Honour) খেতাব প্রবর্তন করেন এবং
  • তিনি ফ্রান্সের ‘ল্যুভর মিউজিয়াম’ (Louvre Museum)-কে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মিউজিয়ামে পরিণত করেন।

মূল্যায়ন

সামরিক বিজেতা হিসেবে নেপোলিয়ন যেমন অসামান্য কৃতিত্ব ও প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন, তেমনি শাসক হিসেবেও তিনি অনবদ্য নজির রেখেছিলেন। নেপোলিয়ন তাঁর সংস্কার কার্যাবলির দ্বারা বিপ্লব-বিধ্বস্ত ফ্রান্সে শান্তি ও সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনেন। নানা সংস্কারের মধ্য দিয়ে তিনি ফরাসি বিপ্লবের সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শ দুটিকে প্রতিষ্ঠিত করলেও স্বাধীনতাকে অবহেলা করেন।

আরও পড়ুন – ভারতে রেলপথ প্রবর্তনের উদ্দেশ্য ও প্রভাব আলোচনা করো

Leave a Comment