কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশনের তাৎপর্য

কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশনের তাৎপর্য

কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশনের তাৎপর্য
কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশনের তাৎপর্য

আদিপর্বের কংগ্রেস নেতাদের নরমপন্থী বা আবেদন-নিবেদন-এর রাজনীতি বহু কংগ্রেস সদস্যেরই মনঃপূত ছিল না। বিপিনচন্দ্র পাল, লালা লাজপত রায়, বাল গঙ্গাধর তিলক প্রমুখ মনে করতেন যে, নরমপন্থী কর্মসূচি দ্বারা ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের দুর্গ ভাঙা সম্ভব হবে না। এজন্য চাই আগ্রাসী আন্দোলন। এরকম এক জটিল পরিস্থিতিতে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ঘটে যায় সুরাট বিচ্ছেদ। জাতীয় রাজনীতিতে উদ্ভব ঘটে চরমপন্থার-যা ছিল ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের মধ্যে মতাদর্শ এবং কর্মপন্থার পার্থক্য ছিল বিস্তর। নরমপন্থীদের উদ্দেশ্য ছিল ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন লাভ। কিন্তু চরমপন্থীদের লক্ষ্য ছিল পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন। এই আন্দোলনের প্রকৃতি সম্পর্কে হয়তো সবাই একমত ছিলেন না, কিন্তু নরমপন্থীদের আবেদন-নিবেদন নীতি যে আদৌ কার্যকরী নয়, এই বিষয়ে প্রায় সবাই সহমত ছিলেন। সাম্রাজ্যবাদী ভাইসরয় লর্ড কার্জন (১৮৯৯-১৯০৫ খ্রি.)-এর প্রতিক্রিয়াশীল নীতি নরমপন্থী নীতির অসাড়তা স্পষ্ট করে দেয়। কার্জন কর্তৃক বাংলাকে ভাগ করার চক্রান্ত অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা কংগ্রেস নেতাদের মতভেদ প্রকাশ্যে নিয়ে আসে। আবেদন-নিবেদন রাজনীতির বিরোধী পক্ষ আবার পরিচিত হন চরমপন্থী নামে। উভয়পক্ষের মতাদর্শগত বিরোধ সুরাট অধিবেশনে (১৯০৭ খ্রি.) এক চূড়ান্ত রূপ নেয়।

মতভেদের প্রথম প্রকাশ

কংগ্রেসে মতাদর্শের বিরোধ ও সংঘাত প্রথম প্রকাশ্যে আসে জাতীয় কংগ্রেসের বেনারস অধিবেশনে (১৯০৫ খ্রি.)। বিশিষ্ট নরমপন্থী নেতা দাদাভাই নৌরজি কংগ্রেসের অভ্যন্তরস্থ এই সংঘাতের কথা আঁচ করে সুদূর লন্ডন থেকে বাল গঙ্গাধর তিলক-কে একটি চিঠি লিখে বলেন যে, আদর্শগত পার্থক্য যেন কোনোভাবেই জাতীয় কংগ্রেস সংগঠনের পক্ষে ক্ষতিকারক না হয়ে ওঠে। অতঃপর লর্ড কার্জন কর্তৃক বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সর্বসম্মতভাবে নিন্দা প্রস্তাব গৃহীত হয়। কিন্তু আন্দোলনের পদ্ধতির প্রশ্নে উভয়পক্ষের মতভেদ বৃদ্ধি পেতে থাকে। চরমপন্থীরা রাজনৈতিক হাতিয়াররূপে বয়কট আন্দোলনের উপর জোর দিয়ে এই আন্দোলনকে দেশের নানা অংশে ছড়িয়ে দিতে চান। একই সঙ্গে তাঁরা বয়কট-কে ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের পাশাপাশি ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে যুক্ত সবকিছুর সম্পর্ক ও সহযোগিতা বর্জনের দিকে নিয়ে যেতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু নরমপন্থীরা বয়কট-কে নেতিবাচক আদর্শ আখ্যা দিয়ে তা কেবল বাংলার মধ্যেই সীমিত রাখতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। শেষপর্যন্ত পরোক্ষভাবে এই অস্ত্র প্রয়োগের প্রস্তাব নেওয়া হয়।

সমঝোতার চেষ্টা

বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হলে (১৬ অক্টোবর, ১৯০৫ খ্রি.) নরমপন্থী রাজনীতির অসাড়তা আরও স্পষ্ট হয়। সারা বাংলা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে। জানা যায় যে, স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও নরমপন্থীদের রাজনীতিকে নৈরাশ্যের ক্রন্দন বলে অভিহিত করে আত্মশক্তি গঠনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। বরোদা থেকে বাংলায় এসে চরমপন্থী রাজনীতির গুরুত্ব প্রচার করেন অরবিন্দ ঘোষ। বাল গঙ্গাধর তিলক, লালা লাজপত রায় প্রমুখ বাংলার প্রতিবাদ আন্দোলনকে সমর্থন জানান। এমন পরিস্থিতিতে কলকাতা অধিবেশন আহৃত হয় (১৯০৬ খ্রি.)। চরমপন্থীরা তিলক-কে সভাপতি করার জন্য জোরকদমে প্রচার চালান। চরমপন্থীদের প্রয়াস ব্যর্থ করার জন্য নরমপন্থীরা (বিশেষত ফিরোজ শাহ মেহতা) লন্ডন প্রবাসী দাদাভাই নৌরজিকে কলকাতা অধিবেশনে সভাপতি করার প্রস্তাব দেন। সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতার সভাপতিত্ব চরমপন্থীরাও মেনে নেন। সভাপতির ভাষণে তিনি স্বরাজ অর্জনের দাবি সমর্থন করেন। শেষপর্যন্ত কলকাতা অধিবেশনে বয়কট, স্বদেশি, জাতীয় শিক্ষা ও স্বরাজ – এই চারটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। তবে চরমপন্থীরা বয়কট আন্দোলনের মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ (Passive Resistance) জোরালো করার দাবিতে অনড় থাকেন। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে চরমপন্থীরা ভাবতে শুরু করেন যে, ভারতীয় জনগণ স্বাধীনতা সংগ্রামের উপযুক্ত হয়ে উঠেছেন। অন্যদিকে, নরমপন্থীরা নিশ্চিত ছিলেন যে, সরকারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘাত ভারতে রাজনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনবে। কিন্তু তিলক ও ফিরোজ শাহ মেহতা নিজ নিজ সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন।

সুরাট অধিবেশন ও চূড়ান্ত বিচ্ছেদ পর্ব

এক সংঘাতময় পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনের আয়োজন শুরু হয়। এসময় ফিরোজ শাহ মেহতা পরবর্তী অধিবেশন স্থল নাগপুর থেকে সরিয়ে সুরাটে নিয়ে যান। সভাপতি নির্বাচনের বিষয়টি নিয়েও দেখা দেয় মতভেদ। চরমপন্থীরা লালা লাজপত রায়-কে সভাপতি পদে বরণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। অন্যদিকে নরমপন্থীরা সভাপতিরূপে নির্বাচিত করেন রাসবিহারী ঘোষ-কে। অতঃপর নরমপন্থী নেতা রাসবিহারী ঘোষ-এর সভাপতিত্বে সুরাট অধিবেশন (২৬ ডিসেম্বর, ১৯০৭ খ্রি.)-এর সূচনা ঘটে। চরমপন্থীরা দাবি তোলেন যে, পূর্ববর্তী অধিবেশনে গৃহীত চারটি প্রস্তাব সমর্থন করা হোক। কিন্তু নরমপন্থীরা উক্ত চারটি প্রস্তাবের আলোচনা এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেন। সৃষ্টি হয় এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির। চেয়ার ভাঙা বা জুতো ছোঁড়াও বাদ যায় না। সংখ্যাগরিষ্ঠ নরমপন্থীরা পুলিশ ডেকে অবস্থা সামাল দেন। চরমপন্থীদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। ইতিহাসে এই ঘটনা সুরাট বিচ্ছেদ (Surat Split) বা সুরাট ভাঙন নামে পরিচিত। এই ঘটনায় আনন্দিত হয়ে লর্ড মিন্টো ভারত-সচিব লর্ড মর্লে-কে একটি পত্রে লেখেন ‘সুরাটে কংগ্রেসের ভাঙন আমাদের মহাবিজয়।’

এরপর ব্রিটিশ সরকার বেশকিছু সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে একদিকে নরমপন্থীদের সন্তুষ্ট রাখা ও অন্যদিকে নিপীড়ন দ্বারা চরমপন্থীদের বিচ্ছিন্ন করার নীতি (সাধারণত এটি Carrot and Stick Policy নামে পরিচিত) অনুসরণ করে চলতে থাকে। এলাহাবাদ কনভেনশন (এপ্রিল, ১৯০৮ খ্রি.)-এ সংবিধান-সংশোধনের মাধ্যমে কংগ্রেসে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন চালানোর নীতি সরকারিভাবে গৃহীত হয়।

কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশনের গুরুত্ব

১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত সুরাট অধিবেশন ইতিহাসে বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ সরকার এর দ্বারা উপকৃত হওয়ার পাশাপাশি এই অধিবেশনের আরও কয়েকটি গুরুত্ব পরিলক্ষিত হয়। যথা-

① কংগ্রেসের ভাবমূর্তির ক্ষতি: এর ফলে কংগ্রেসের ভাবমূর্তি মলিন হয়েছিল। কংগ্রেসের নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের মধ্যে প্রকাশ্য বিরোধ কংগ্রেসের ভাবমূর্তিকে বিনষ্ট করে।

② চরমপন্থীদের ক্ষমতা হ্রাস: সুরাট অধিবেশনের পরবর্তীতে অরবিন্দ ঘোষ রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছিলেন এবং বিপিনচন্দ্র পাল সাময়িক অবসর নিয়েছিলেন। তিলক ৬ বছরের জন্য মান্দালয় জেলে কারারুদ্ধ হন এবং লালা লাজপত রায় বিদেশযাত্রা করেন (১৯০৮ খ্রি.)। ফলে চরমপন্থী নেতাদের অভাবে আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে।

③ নরমপন্থীদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা: চরমপন্থীদের জন্য নরমপন্থী নেতাদের জনসমর্থন হ্রাস পেয়েছিল। চরমপন্থী নেতাদের বহিষ্কার করে নরমপন্থী নেতারা কংগ্রেসে পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তবে তাঁদের সংগ্রাম-বিরোধী চরিত্র জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

(4)সশস্ত্র বিপ্লববাদের উদ্ভব: সুরাট ভাঙনের ফলে সশস্ত্র বিপ্লববাদের জন্ম হয়েছিল। চরমপন্থীদের ব্যর্থতা যুবসমাজকে হতাশ করেছিল, তারা কংগ্রেসের প্রতি আস্থা হারিয়ে বিপ্লবী আন্দোলনের মাধ্যমে মুক্তির পথ খোঁজে।

সুরাটে কংগ্রেসের চরমপন্থী নেতারা পরাজিত হলেও পরবর্তীকালে তাঁদের নীতি ও আদর্শ, যেমন- স্বদেশি, বয়কট ও স্বরাজ জাতীয় কংগ্রেস গ্রহণ করেছিল। বলাবাহুল্য, কংগ্রেস নেতাদের এই বিরোধ স্থায়ী হয়নি। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের লখনউ অধিবেশনে নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের পুনর্মিলন ঘটলে কংগ্রেসি আন্দোলন পুনরায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

আরো পড়ুন : একাদশ শ্রেণি দ্বিতীয় সেমিস্টার বাংলা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment