রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতাবাদ ক্লাস 12 দর্শন চতুর্থ সেমিস্টার (Exclusive Answer)

সূচিপত্র

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতাবাদ ক্লাস 12 দর্শন চতুর্থ সেমিস্টার (Exclusive Answer)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতাবাদ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতাবাদ

১। রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদের মূল বক্তব্য ব্যক্ত করো।

রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদের মূল বক্তব্য

মানবতাবাদের মূল অর্থ হল মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা। ব্যক্তি, জাতি, ধর্ম ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য করাই হল মানবতাবাদের মূল পরিচয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলেন সমসাময়িক ভারতীয় দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর রচনাবলির মধ্যে দিয়ে তিনি মানবধর্ম তথা মানবতাবাদ (humanism)-কেই অত্যন্ত জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর জীবনব্যাপী সাধনার উদ্দেশ্য ছিল মানবধর্মের জয় গান। ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে ও ‘Religion of Man’ গ্রন্থে মানবতাবাদ সম্পর্কে তাঁর ধ্যানধারণাকে তিনি অত্যন্ত যুক্তিনিষ্ঠভাবে তুলে ধরতে চেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথই হলেন প্রথম চিন্তানায়ক, যিনি মানবতাবাদকে মানুষের প্রকৃত ধর্ম হওয়া উচিত বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের আগে অনেকেই মানবতাবাদের ধ্বজা তুলে ধরলেও রবীন্দ্রনাথই প্রথম যুক্তিনিষ্ঠভাবে মানবতাবাদকেই আধুনিক মানুষের ধর্ম হওয়া উচিত বলে মনে করেছেন এবং যুক্তিনিষ্ঠভাবে বিষয়টিকে প্রমাণ করেছেন। সেকারণেই তিনি মানুষকে দেবতার অপার মহিমায় প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং মানুষকে জীবনদেবতা রূপে উল্লেখ করেছেন।

২। রবীন্দ্রনাথের মতে মানুষের দুটি সত্তা কী?

রবীন্দ্রনাথের মতে মানুষের সত্তা

রবীন্দ্রনাথ তাঁর দার্শনিক চিন্তনে মানবতাবাদের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের মধ্যে দুটি সত্তাকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। এই দুটি সত্তার একটি হল জীবসত্তা এবং অপরটি হল মানবসত্তা। তিনি তাঁর ‘মানুষের ধর্ম’ নামক প্রবন্ধে এই দুটি সত্তাকে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন।

জীবসত্তা’র ধারণা: রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন যে, মানুষ জীবরূপে বাঁচতে চায় তার বিভিন্নপ্রকার জৈবিক কামনা-বাসনা নিয়ে। মানুষের জীবসত্তা তাই তার ব্যাবহারিক কামনা-বাসনা এবং স্বার্থসিদ্ধিকেই সূচিত করে। অর্থাৎ, স্বার্থ জড়িত কামনা-বাসনাই হল তার জীবসত্তা।

‘মানবসত্তা’-র ধারণা: জীবসত্তাই কিন্তু মানুষের একমাত্র পরিচায়ক নয়। এই জীবসত্তার বাইরেও মানুষের একটা দুর্লভ পরিচয় আছে-যার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে জন্ম লাভ করে ‘মনুষ্যত্ববোধ’। মানুষ তাই শুধু তার জীবসত্তা নিয়েই বাঁচতে চায় না, সে বাঁচতে চায় তার অনেক বড়ো ও মহান পরিচয় নিয়ে। আর এই অনেক বড়ো পরিচয়ের আকাঙ্ক্ষাই তার উত্তরণ ঘটায় মানবসত্তায়-যার প্রকাশ ঘটে মানবতাবাদের মাধ্যমে। মানুষের এই মানবসত্তাই মানুষের স্বার্থের বন্ধন শিথিল করে এবং আত্মত্যাগ ও আত্মোপলব্ধিতে উদ্বুদ্ধ করে।

৩। মানুষের জীবনে ধর্মের প্রভাব কী?

মানুষের জীবনে ধর্মের প্রভাব

মানুষের জীবন ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, মানুষের জীবনে ধর্মের ব্যাপারটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ, এমন কোনো মানবগোষ্ঠী আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি, যেখানে ধর্মের কোনো ভূমিকাই নেই। মানুষের জীবনে ধর্ম তাই এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়রূপেই গণ্য হয়। সৃষ্টির আদি যুগ থেকে আজ পর্যন্ত যত মানবগোষ্ঠীরই উত্থান-পতন হোক-না-কেন, সমাজের যতই পরিবর্তন হোক-না-কেন, এ কথা যথার্থ যে প্রত্যেকটি সমাজে, প্রত্যেকটি মানুষের মনে ধর্মের একটা প্রভাব আছে। ধর্ম তাই ভালো ও খারাপ দু-দিক দিয়েই মানুষকে বেঁধে রেখেছে, যাকে অতিক্রম করা মানুষের পক্ষে অত্যন্ত কষ্টকর। অবশ্য এ কথা সত্য যে, বিভিন্ন সমাজে ধর্মের অর্থ ও প্রকৃতি কখনোই এক নয়। বিভিন্ন সমাজে তাই ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন রূপ লক্ষ করা যায়। সেকারণে মনুষ্যজাতি সম্পর্কে জানতে গেলে, তার ধর্মের দিকটিকেও জানতে হয়। ম্যাক্সমুলার (Maxmuller)-কে অনুসরণ করে তাই বলা যায় যে, মানুষের প্রকৃত ইতিহাস হল ধর্মের ইতিহাস।

৪। রবীন্দ্রনাথের মতে ধর্ম কী?

রবীন্দ্রনাথের মতে ধর্ম

রবীন্দ্রনাথের মতে ধর্ম কী-তা সংক্ষেপে আলোচনা করা হল-

[1] পূর্ণতা প্রদানই ধর্মের প্রকৃত অর্থ: ধর্ম সর্বোচ্চ শুদ্ধ নৈতিক সত্তার প্রতি অনুরাগকে সূচিত করে। ধর্মের তাৎপর্য তাই অত্যন্ত ব্যাপক। ধর্ম কোনো দেশে, কালে এবং সমাজে আবদ্ধ থাকতে পারে না। ধর্ম মানবীয় সত্তা হিসেবে মানুষকে পূর্ণতা প্রদান করে। রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ প্রমুখ মনীষীগণ তাই ধর্ম বলতে ‘মানবধর্ম’-কেই বুঝিয়েছেন।

[2] মানবতাবাদই একমাত্র ধর্ম: রবীন্দ্রনাথের কাছে মানবধর্মের অর্থ হল মানবতাবাদ। রবীন্দ্রনাথই হলেন প্রথম চিন্তানায়ক যিনি মানবতাবাদকে মানুষের প্রকৃত ধর্ম হওয়া উচিত বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাঁর আগে অনেকেই মানবতাবাদের কথা বললেও, মানবতা যে সব মানুষেরই একমাত্র ধর্ম হওয়া উচিত-তা বোধহয় রবীন্দ্রনাথের আগে কেউই বলেননি। ধর্ম বলতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতাবাদ এবং স্বামী বিবেকানন্দের কর্মযোগ তাই মানবতাকেই সূচিত করেছেন। তিনি তাঁর ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে এবং ‘Religion of Man’ গ্রন্থে অত্যন্ত যুক্তিনিষ্ঠভাবে মানবতাকে মানুষের ধর্ম হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

[3] আত্মোপলব্ধির সহায়করূপে ধর্ম: ধর্মই মানুষকে মানবসত্তার সর্বোচ্চ শিখরে প্রতিষ্ঠা করে এবং আত্মত্যাগ ও আত্মোপলব্ধিতে সাহায্য করে। তাই রবীন্দ্রনাথ বলেন যে, ধর্ম নেই কোনো মন্দিরে, মসজিদে অথবা গির্জায়; আছে শুধু মানুষেরই অন্তরে। ধর্ম মানুষের মনে মানবতার দ্বারকে উন্মুক্ত করে তাকে হাজির করে বিশ্বচেতনায়। এ যেন চন্ডীদাসের ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নেই’ বাণীরই প্রতিধ্বনি। ধর্ম হিসেবে মানবতাবাদ তাই অবশ্যই সাবেকি ধর্মচেতনা থেকে স্বতন্ত্র এবং মানব চেতনায় উদ্বুদ্ধ।

৫। রবীন্দ্রনাথের মতে জীবভাব ও বিশ্বভাব কী?

স্বার্থযুক্ত জীবভাব, আদর্শযুক্ত বিশ্বভাব: জীবভাবযুক্ত মানবসত্তা মানুষের নিজস্ব স্বার্থকে কেন্দ্র করেই বাঁচে। এর মধ্যে থাকে না কোনো অন্তরের আহ্বান বা আদর্শের নির্দেশ। এ শুধু নিজেকে নিয়ে নিজেই মত্ত থাকা। এ যেন ডিমের ভিতরে পাখির ছানার আবদ্ধ থাকা এবং তাতেই মত্ত থাকা। কিন্তু বিশ্বভাব নিয়ে যে মানবসত্তা বিরাজমান তা অন্তরের নির্দেশে, আদর্শের আলোকে উদ্ভাসিত। এই বিশ্বভাব কখনোই ডিমের অন্তঃস্থিত দুর্বল ডানাবিশিষ্ট পাখির সঙ্গে তুলনীয় নয়। এই ভাব নির্দেশ করে পাখীর ডানার প্রকৃত সক্ষমতাকে-যা আমাদেরকে ক্ষুদ্র স্বার্থচেতনার সীমা অতিক্রম করে পরমসত্তার সীমানায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

বিশ্বভাবের বিকাশে জীবভাবের অবদান: মানুষের জীবভাবও কিন্তু কখনোই উপেক্ষিত নয় কারণ মানুষের বিশ্বভাব উৎসারিত হয় এই জীবভাব থেকেই। মানুষের মধ্যে জীবভাব আছে বলেই, তার মধ্যে বিশ্বভাবের আকাঙ্ক্ষা জাগরিত হয়। আগে তাই ব্যক্তিমানুষের ধারণা আসে, তার পরেই আসে বিশ্বমানুষের ধারণা। এই বিশ্বমানবের প্রেরণাতেই ব্যক্তিমানুষ এমন কিছু কাজে প্রবৃত্ত হয়, যার সাহায্যে সে তার ক্ষুদ্র স্বার্থ সংবলিত জীবনের সীমাকে অতিক্রম করে অগ্রসর হয় আত্মার পরিপূর্ণ তৃপ্তির দিকে। এরূপ বোধের ফলেই মানুষের মধ্যে মহামানবের আবির্ভাব ঘটে, যার সত্তার কোনো সীমা নেই, যা অনন্ত দেবতার মহিমার অধিকারী। রবীন্দ্রনাথ এই ভাবেরই প্রকাশ ঘটিয়েছেন তাঁর গানের মধ্য দিয়ে-

"সীমার মাঝে অসীম তুমি, বাজাও আপন সুর, 
আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর।"

৬। রবীন্দ্রনাথের মতে মানবতাবাদ কী?

রবীন্দ্রনাথের মতে মানবতাবাদ

যে মতবাদ মানুষের সামগ্রিক মঙ্গলের ধারণাকে সূচিত করে এবং মানবসমাজের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি ও কল্যাণের বিষয়টি প্রচার করে, সেই মতবাদকেই বলা হয় মানবতাবাদ (humanism)। চোদ্দো থেকে সতেরো শতকের মধ্যে ইতালিতে প্রথম যে মানবকেন্দ্রিক আদর্শের জন্ম হয়, তা-ই মানবতাবাদ নামে পরিচিত। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সংস্কৃতির প্রভাবে এর প্রসার ঘটলেও ক্রমশ এই আদর্শ নিজস্বতা অর্জন করে। প্রাচীন ভারতবর্ষের আদর্শে ও মধ্যযুগে সুফি ও ভক্তিবাদী দর্শনেও মানবতাবাদের কথা বলা হয়েছে। আধুনিক ভারতের মনীষী রবীন্দ্রনাথের ভাষায় মানবতাবাদ-ই হল মানবধর্ম।

৭। আধুনিক ধর্মরূপে মানবতাবাদ কি যথার্থ?

আধুনিক ধর্মরূপে মানবতাবাদের যথার্থতা

মানবধর্মের আকার হিসেবে মানবতাবাদের বিষয়টি বর্তমানে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হচ্ছে। কারণ, বর্তমান ধারণা অনুযায়ী ধর্ম বলতে বোঝায় সর্বজনীন বা বিশ্বজনীন ধর্মকে, যা মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ সূচিত করে। ধর্ম ক্রমান্বয়ে আদিম উপজাতীয় স্তর থেকে উত্তরণের মাধ্যমে বিশ্বজনীন ধর্মের দিকে অগ্রসর হয়েছে। আদিম অন্ধ কুসংস্কারের জাল ছিন্ন করে, ধর্ম হয়ে উঠেছে বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী। এরূপ যুক্তির আলোকেই ধর্ম তার অন্ধগলি থেকে প্রশস্ত রাজপথে এসে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে মানুষ উপলব্ধি করতে সমর্থ হয়েছে যে, ধর্ম কোনো ব্যক্তিগত বিষয় নয়, গোষ্ঠীগত সম্পত্তিও নয়, অথবা কোনো নির্দিষ্ট জাতির বিষয়রূপেও গণ্য নয়। ধর্ম হল বিশ্বজনীন বা সর্বজনীন, ধর্ম হল সমগ্র মানবসমাজের।

৮। মানুষের সসীমসত্তার দিকটি কী?

স্বার্থ সম্বলিত মানবসত্তাই সসীম সত্তা: মানুষ হল মূলত প্রাণীজগতের অংশীদার। অর্থাৎ, মানুষ প্রথমে একটি জীব বা প্রাণী হিসেবেই গণ্য হয়। একটি জীব বা প্রাণী হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য তাকে অহরহ বিভিন্ন বিষয়ে সংগ্রাম করতে হয়। সংগ্রামরত দৈনন্দিন জীবনযাত্রার প্রেক্ষাপটে মানুষ তখন তার স্বার্থ সম্বলিত ক্রিয়াকলাপের মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে পড়ে। এই স্বার্থের গন্ডির বাইরে মানুষ তাই আর-এক পাও এগিয়ে যেতে পারে না। স্বার্থের সীমানায় আবদ্ধ হয়ে পড়াই হল মানুষের সসীম সত্তার দিক। এরূপ সত্তার পরিপ্রেক্ষিতেই মানুষ অন্যান্য পশুর মতোই আচরণ করে। পশুর মতো মানুষও তখন তার কামনা-বাসনা পরিতৃপ্তির জন্য জৈবিক সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। এটিই মানবচরিত্রের সসীম সত্তা তথা সীমাবদ্ধতার দিক।

৯। মানুষের অসীম সত্তাটি কী?

অহংভাবের বিনাশকরূপে অসীম সত্তা: অসীমের প্রতি মানুষের আকর্ষণ তার অহংভাবকে ধ্বংস করে। সে অনুভব করতে পারে যে, দেহসর্বস্ব প্রকৃতিই কিন্তু মানুষের সব কিছু নয়। দৈহিক প্রকৃতির বাইরেও তার আরও একটি সুমহান পরিচয় আছে। এই গুণের সাহায্যেই মানুষের মধ্যেকার আধ্যাত্মিক দিকটিকে উন্মোচিত করা যায়। এই দিকটি ছাড়া মানুষ আসলে শুধুই দেহসর্বস্ব জীব, যা তার জৈবিক চাহিদাকে পূরণ করে মাত্র। এই জৈবিকতা বা পাশবিকতা ও সসীম সত্তার বাইরেও যে কিছু পাওয়ার আছে, এরূপ উপলব্ধি যখন মানুষের হয়, তখন সে এক-পা, এক-পা করে অসীম সত্তার দিকেই এগিয়ে যায়।

বিশ্বচেতনার দীপশিখায় অসীম সত্তা: মানবপ্রকৃতির অসীমতার দিকটি প্রদীপের শিখার সঙ্গেই তুলনীয়। কারণ, শিখা শুধু নিজেকেই প্রকাশ করে না, তা তার বৃত্তের বাইরে অপরাপর বস্তুগুলিকেও প্রকাশ করে। মানুষের চেতনা যখন নিজেকে ছাপিয়ে, তার বাইরে যাত্রা করে, তখন তার মনে প্রজ্জ্বলিত হয় বিশ্বচেতনার দীপশিখা। এরূপ চেতনার দীপশিখায় মানুষের অহংবোধ পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এভাবেই মানুষ নিজেকে জানতে পারে, অসীম বিশ্বকে চিনতে পারে। এভাবেই সামগ্রিকভাবে মানবাত্মাকে সে বুঝতে পারে। মানুষ তখন যথার্থ মানুষ হয়ে উঠতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে মানুষ মানবতার পূজারি হয়ে ওঠে। এভাবেই সে ‘সোহম্’ বাণী বহন করে সকল মানুষকে ঐক্যমন্ত্রে দীক্ষিত করতে পারে। এরূপ বৃহত্তর চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়াই মানুষের প্রকৃত ধর্ম।

১০। রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদী ভাবনার কয়েকটি উৎস উল্লেখ করো।

রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদী ভাবনার উৎসমূহ

রবীন্দ্রনাথের দর্শনকে মূলত মানবতাবাদী দর্শনরূপে উল্লেখ করা হয়। কারণ, রবীন্দ্রনাথ প্রদত্ত দর্শনে মানবতাবাদের বিষয়টিই দারুণভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর মতে এই মানবতাবাদের বিষয়টি বিভিন্ন উৎস থেকে হাজির হয়েছে। মানবতাবাদী দর্শনের মূল উৎসগুলি এখানে উল্লেখ ও ব্যাখ্যা করা হল-

[1] মানবতাবাদী দর্শনের মূল উৎস হিসেবে অদ্বৈত বেদান্ত: মানবতাবাদের মূল কথাই হল জীবরূপে সকল মানুষের ওপরই গুরুত্ব দেওয়া, সকল মানুষকেই ভালোবাসা। মানুষের সামগ্রিক মঙ্গল চিন্তা তাই মানবতাবাদ থেকেই নিঃসৃত। রবীন্দ্রনাথ অদ্বৈত বেদান্তের ভাবধারায় এক ও অদ্বিতীয় ব্রহ্মের প্রকাশ হিসেবে মানুষের ওপরই সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। মানুষের অস্তিত্ব ও মর্যাদা তাই তাঁর কাছে সবার উর্ধ্বে। অদ্বৈত বেদান্ডের মূলকথাই হল-জীব ব্রহ্মস্বরূপ। সেকারণেই তিনি যেখানেই মানুষ ও মনুষ্যত্বের অবমাননা দেখেছেন, সেখানেই তিনি প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন।

[2] মানবতাবাদী দর্শনের উৎসে ধর্মীয় ভিত্তি: মানুষের জীবন ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ধর্মের বিষয়টি মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এমন কোনো মনুষ্যসমাজ সমাজ দেখা যায় না, যেখানে ধর্মের বিষয়টি একেবারেই অনুপস্থিত। মানুষ এবং মানুষের সমাজকে জানতে গেলে তাই ধর্মের ইতিহাসটিও জানা দরকার। প্রখ্যাত পাশ্চাত্য দার্শনিক ম্যাক্সমুলারকে অনুসরণ করে বলা যায়-মানুষের প্রকৃত ইতিহাস হল ধর্মের ইতিহাস। রবীন্দ্রনাথও মানুষের জীবন থেকে ধর্মের বিষয়টিকে বাদ দিতে চাননি। তবে তিনি ধর্ম বলতে চিরাচরিত বা প্রথাগত ধর্মকে না বুঝিয়ে ধর্ম হিসেবে মানবতাবাদের বিষয়টিকেই সূচিত করেছেন। সুতরাং বলা যায় যে, রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদী দর্শনের ক্ষেত্রে এক ধর্মীয় ভিত্তিও উপস্থিত।

[3] মানবতাবাদী দর্শনের উৎসরূপে মানুষের জীবভাব ও বিশ্বভাব: মানবতাকে মানুষের ধর্মরূপে উল্লেখ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে দুটি সত্তার উল্লেখ করেছেন। এই দুটি সত্তার একটি হল জীবসত্তা এবং অপরটি হল মানবসত্তা। জীবসত্তা থেকে উৎসারিত হয় জীবভাব এবং মানবসত্তা থেকে উৎসারিত হয় বিশ্বভাব। স্বার্থযুক্ত মানুষের চিন্তাই হল তার জীবভাব। কিন্তু স্বার্থযুক্ত চিন্তাকে অতিক্রম করে সামগ্রিকভাবে মানুষের চিন্তার মধ্যেই ফুটে ওঠে তার বিশ্বভাব। জীবভাবকে অতিক্রম করে বিশ্বভাবের মাধ্যমেই মানুষ মানবতাবাদের পূজারিরূপে গণ্য হতে পারে।

১১। রবীন্দ্রনাথ তাঁর মানবতাবাদী ভাবনায় মানুষের মধ্যে কীরূপ দ্বৈততা (duality)-র কথা উল্লেখ করেছেন?

দ্বিবিধভাবে মানুষের দ্বৈততা

রবীন্দ্রনাথ তাঁর মানববাদী ভাবনায় মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধতা বা সসীমতা ও অসীমতা বা অসীমাবদ্ধতার একত্র অবস্থানরূপ দ্বৈততা (duality)-র কথা উল্লেখ করেছেন। এরূপ দ্বৈততা তাঁর জীবভাব ও বিশ্বভাবের মধ্যেও ফুটে ওঠে। কারণ, মানুষের জীবভাবে তাঁর স্বার্থ সমন্বিত সসীম ভাবটি যেমন প্রকটিত হয়, তেমনই আবার তাঁর বিশ্বভাবে অসীমতা তথা অসীমাবদ্ধতার দিকটিও প্রতিফলিত হয়।

স্বার্থের মধ্যেই স্বার্থশূন্যতার অবস্থান: রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘Religion of Man’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, মানুষ প্রাথমিক পর্যায়ে নিজেকে নিয়ে মত্ত থাকলেও এতে মানুষ কিন্তু শেষপর্যন্ত সন্তোষ লাভ করতে পারে না। কারণ, মানুষ চায় তার স্বার্থের গন্ডির বাইরে এসে স্বার্থশূন্যতার আলোকে আলোকিত হতে। তাই মানুষ চায় তার নিজস্ব মত্ততার বাইরে এসে অসীমতার স্বাদ পেতে। এর জন্য মানুষ সবসময় সক্রিয় থাকে। মানুষের মধ্যে যখন এরূপ ভাব জাগরিত হয়, তখন কোনো বাধাই তাকে বেঁধে রাখতে পারে না। মানুষের অন্তঃস্থিত এরূপ সত্তাকে তাই দমিয়ে রাখা যায় না। তাই সে জানার আকুতি নিয়ে অজানাকে জানতে চায়, অচেনাকে চিনতে চায়। আর যা কিছু অজানা, অচেনা তা হল মানুষের স্বার্থ সম্বলিত সীমাবদ্ধতার বাইরে। সীমাবদ্ধতার মধ্যেই তার অসীমতার অবস্থান। সীমাবদ্ধ সত্তাই তাই অসীমাবদ্ধতার প্রকাশ ঘটায়। এই অসীম সত্তাকেই সসীম মানুষ উপলব্ধি করার চেষ্টা করে চলেছে অহরহ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর মানবতাবাদী ধারণায় মানুষের মধ্যে এরূপ দ্বৈততাকে উপলব্ধি করেছেন।

আরো পড়ুন : একাদশ শ্রেণি দ্বিতীয় সেমিস্টার বাংলা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment