বিশ্বায়নের রাজনৈতিক প্রভাব লেখো

রাজনৈতিক বিশ্বায়ন প্রকৃতিগত দিক থেকে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন থেকে স্বতন্ত্র। ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দের ওয়েস্টফেলিয়ার শান্তি চুক্তির পরবর্তী পর্ব থেকে ভূখণ্ডভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রাথমিক একক (Primary actor) বা ক্রিয়াকারী বলে গণ্য করা হয়ে থাকে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি, বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ এবং বিশ্ব বাজার দখলের মধ্য দিয়ে যে আর্থসামাজিক বিশ্বায়নের সূচনা হয়েছিল তার প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছিল। বিশেষ করে, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। তবে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিশ্বায়ন জাতিরাষ্ট্র ধারণার বিপরীতে অবস্থান করে। অবাধ পুঁজির মুনাফাকে গণতান্ত্রিক জাতিরাষ্ট্রগুলি কখনোই সমর্থন করেনি। আবার বিশ্বায়নের পাশ্চাত্যের প্রবক্তাগণ সম্পূর্ণরূপে জাতিরাষ্ট্রের বিলোপসাধন চান না, বরং তারা এমন এক বিশ্বব্যবস্থা আশা করেন যেখানে ধনতান্ত্রিক শ্রেণির স্বার্থে একচেটিয়া বাণিজ্যও রক্ষা পাবে আবার অপরপক্ষে স্বায়ত্তশাসনমূলক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলির অস্তিত্বও বজায় থাকবে। এই চিন্তার মূল উদ্দেশ্য হল-সর্বশক্তিসম্পন্ন জাতিরাষ্ট্রগুলি বৃহৎ পুঁজির সঙ্গে যতটা পাল্লা দিতে পারবে, স্বল্পক্ষমতাসম্পন্ন স্বায়ত্তশাসনমূলক প্রতিষ্ঠানগুলি তা পারবে না। তাই আঞ্চলিক স্তরে বৃহৎ পুঁজির অধীনে তারা চালিত হয়। এভাবে বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিকতা লক্ষ করা যায়। রাজনৈতিক বিশ্বায়নের বাস্তবায়ন দেখা যায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের মধ্য দিয়ে। বর্তমানে সারা বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন দেখা যায়। এই সমস্ত সংগঠনগুলি জাতির সীমানাকে ছাড়িয়ে বৈশ্বিক স্তরে বিকশিত হয়েছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (UNO), অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংগঠন (OECD), ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) ইত্যাদির কথা বলা যায়। ডেভিড হেল্ড, স্কট বার্চিল প্রমুখ আধুনিক তাত্ত্বিকগণ এই বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ করে রাষ্ট্রব্যবস্থার উপর বিশ্বায়নের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। এই প্রভাবগুলি হল-
বিশ্বায়নের ইতিবাচক প্রভাব
(i) তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব ও রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি : বিশ্বায়নের ফলে সারা বিশ্বব্যাপী যে তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব ঘটেছে তার ফলে নাগরিকদের মধ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে সচেতনতা আগের চেয়ে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে নাগরিকরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সঠিকভাবে অবগত হয়েছে এবং অধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কে বিভিন্ন ইস্যুতে সোচ্চার হয়েছে।
(ii) নাগরিক সমাজের আন্দোলনে নতুন গতিসঞ্চার: বিশ্বায়নের ফলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজের বা সিভিল সোসাইটির আন্দোলনে নতুন গতির সঞ্চার হয়েছে। বিশ্বের ধনী ও দরিদ্র দেশগুলির মধ্যে আর্থিক বৈষম্য, পরিবেশদূষণ, মানবাধিকার, মহিলাদের ক্ষমতায়ন ইত্যাদি নানান ইস্যুতে বিভিন্ন দেশে জাতীয় স্তরে এমনকি আন্তর্জাতিক স্তরেও নাগরিক সমাজের আন্দোলন গড়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে।
(iii) বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সংহতিসাধন: বিশ্বায়ন বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে নিবিড় সংহতি গড়ে তুলেছে। আধুনিক বিশ্বে কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে একাকী বিচ্ছিন্নভাবে টিকে থাকা সম্ভব নয়। বিশ্বায়ন এই বাস্তবতাকে তুলে ধরে রাষ্ট্রগুলির মধ্যে একটি অভিন্ন যোগসূত্র গড়ে তোলার সুযোগ করে দিয়েছে।
(iv) সক্ষমতা বৃদ্ধি : অনেকে মনে করেন, বিশ্বায়নের ফলে রাষ্ট্রগুলির সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। উন্নতমানের তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রগুলি প্রশাসনের কাজে দক্ষতা বৃদ্ধি করেছে। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ও উন্নত প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে সারা বিশ্বকে জানা ও বোঝার কাজও অনেক সহজ হয়ে গেছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশেষ করে বিদেশনীতি নির্ধারণের কাজে রাষ্ট্রের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
(v) আন্তর্জাতিক বাজারের ভূমিকা: বিশ্বায়নের ফলে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের বদলে আন্তর্জাতিক বাজারের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যাচ্ছে। রাষ্ট্রের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলি বেশকিছু ক্ষেত্রে বাজারের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। যেমন-আমাদের দেশ ভারতে বিশ্বায়ন পূর্ববর্তী সময়ে পেট্রোল, ডিজেলের দাম নির্ধারণে সরকারের ভূমিকা ছিল প্রধান, বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে পেট্রোল, ডিজেলের দাম নির্ধারণে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। এখন পেট্রোল, ডিজেলের দৈনিক দরের ওঠানামা আন্তর্জাতিক বাজারের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়।
(vi) শান্তি স্থাপন: বিশ্বায়ন যুদ্ধের ধ্বংসাত্মক পরিণতি সম্পর্কে সমস্ত জনগণকে সচেতন করে যুদ্ধের প্রতি জনগণের অনীহা বৃদ্ধি করেছে। যার ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলির মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা হ্রাস পেয়েছে এবং শান্তির পরিবেশ গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া সন্ত্রাসবাদ দমনের ক্ষেত্রে সমস্ত রাষ্ট্র ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।
বিশ্বায়নের নেতিবাচক প্রভাব
(i) জাতিরাষ্ট্রের সংকট: রাজনৈতিক দিক থেকে বিশ্বায়ন জাতিরাষ্ট্রের (Nation State) সংকট সৃষ্টি করেছে বলে অনেকে মনে করেন। জাতিরাষ্ট্রগুলির সাবেকি রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার ধারণা বিশ্বায়নের যুগে বহুলাংশে অচল হয়ে পড়েছে। বিশ্বায়নের যুগে রাষ্ট্রকে তার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতি নির্ধারণের আগে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নির্দেশিকার সঙ্গে ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অন্যান্য বিধিনিয়মের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে চলতে হয়। কাজেই চরম সার্বভৌমত্বের ক্ষমতা রাষ্ট্র এখন আর আগের মতো ভোগ করতে পারে না। শুধু তাই নয়, জাতীয় সীমানা অতিক্রমকারী পুঁজি (Transnational capital) বা লগ্নি পুঁজির (Finance Capital) চলাচল বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে রাজস্ব নীতি ও বণ্টন নীতির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ সার্বভৌম ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। অধ্যাপক হলটন তাঁর ‘Globalization and the Nation State’, শীর্ষক গ্রন্থে জাতিরাষ্ট্রের উপর বিশ্বায়নের প্রভাব আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, জাতিরাষ্ট্রগুলি যে পৃথিবীতে বাস করে তার পরিবর্তন ঘটে চলেছে। বিশ্বায়ন হল এই পরিবর্তনের একটি প্রধান উৎস। এই ধরনের পরিবর্তন নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যে রাষ্ট্রের চরম সার্বভৌম ক্ষমতার চিরাচরিত ধারণার অবসান ঘটাতে চলেছে।
(ii) বহুমুখী কার্য সম্পাদনে ব্যর্থতা: বিশ্বায়নের আগে রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে রাষ্ট্র তথা সরকার ছিল নাগরিকদের আশা-ভরসা, বহুমুখী কার্য সম্পাদনে সক্ষম একটি ব্যবস্থা। কিন্তু বিশ্বায়ন নাগরিকদের চাহিদা ও প্রয়োজনসমূহকে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি করেছে যার বিস্তার দেশীয় সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রসারিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র আর বহুমুখী কার্য সম্পাদনে সক্ষম প্রতিষ্ঠান রূপে গণ্য হয় না।
(iii) শৃঙ্খলাব্যবস্থা মান্য: বিশ্বায়নের পরিমণ্ডলে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শৃঙ্খলাব্যবস্থা (International and Regional Regime) গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই এই ব্যবস্থার অন্তর্গত রাষ্ট্রগুলি নিজের জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনেই শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আগ্রহী। এই ধরনের regime বা শৃঙ্খলাব্যবস্থার মধ্যে সামরিক ও প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য, পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নায়ন প্রতিরোধ ইত্যাদির উল্লেখ করা যায়। রাষ্ট্রসমূহ অভ্যন্তরীণ নীতি নির্ধারণের সময় সংশ্লিষ্ট শৃঙ্খলাব্যবস্থার গৃহীত প্রস্তাবসমূহ (resolutions) উপেক্ষা করতে পারে না।
(iv) রাষ্ট্রের সংকোচন: বিশ্বায়নের ফলে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ থেকে বাজারের মুক্তি ঘটেছে, যা রাষ্ট্রের সংকোচনের সূচক। মুক্ত বাজার ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে যুক্ত হতে বাধ্য হওয়ার ফলে বিশ্ব বাজারের ওঠা-নামা তথা অনিশ্চয়তা থেকে নাগরিকদের রক্ষা করতে পারে না। যেমন-অতি সম্প্রতি (চলতি মাসে) ইজরায়েল ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধের ফলে বিশ্ব বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ১০% বৃদ্ধি পেয়েছে, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে ভারতের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি (Inflation)-এর উপর। ভারতে প্রায় ৮৫% পেট্রোলিয়াম আমদানি করতে হয় বলে ভারত সরকারের পক্ষে সেই মূল্যবৃদ্ধি প্রতিরোধ করা অসম্ভব।
(v) নয়া এলিট শ্রেণি সৃষ্টি: বিশ্বায়নের একটি প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক ফসল হল-বিদেশের বহুজাতিক সংস্থাগুলির দেশীয় অংশীদারিত্ব সৃষ্টি। এক্ষেত্রে বহুজাতিক সংস্থাগুলি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে কর্পোরেট পুঁজিবাদের (Corporate Capitalism) ভিত্তি রচনা করে। এই নয়া এলিট শ্রেণি বর্তমানে অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশের রাষ্ট্র তথা রাজনীতির নির্ণায়ক।
(vi) সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বৃদ্ধি: বিশ্বায়নের স্রোতে সন্ত্রাসবাদের আতঙ্ক দেশ-বিদেশ নির্বিশেষে ছড়িয়ে পড়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতি, যে-কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অবাধে প্রবেশ এবং নতুন নতুন মারণাস্ত্রের সৃষ্টি বিশ্ববাসীর মনে ভয় ও ত্রাস বাড়িয়েছে।
উপসংহার: তবে মনে রাখা উচিত রবার্ট হলটন (Robert Holton)-সহ প্রমুখ তাত্ত্বিকরা মনে করেন, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের উপর সাম্প্রতিককালের বিধিনিষেধ কেবল বিশ্বায়নের ফসল নয়। ১৯৫০-এর দশক থেকেই ক্রমশ রাষ্ট্রীয় চরম ক্ষমতার ধারণা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। জগদীশ ভগবতীও মনে করেন নারী অনুন্নয়ন, শিশুশ্রম কিংবা অপুষ্টি যা উপ-সাহারীয় (Sub-Saharan) অঞ্চলগুলিতে প্রকট, সেগুলির জন্য বিশ্বায়ন দায়ী নয়। বরং বিশ্বায়ন এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার অনেক দেশে রাষ্ট্রকাঠামোর গণতন্ত্রীকরণের পরিবেশে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
আরো পড়ুন : একাদশ শ্রেণি দ্বিতীয় সেমিস্টার বাংলা প্রশ্ন উত্তর