প্রার্থনা কবিতার বিষয়বস্তু ও নামকরণের সার্থকতা

প্রার্থনা কবিতার বিষয়বস্তু
রবীন্দ্রসাহিত্য চিরকাল মানবজাতিকে উৎকৃষ্ট জীবনযাপনের সন্ধান দিতে চেয়েছে। এর পাশাপাশি সেখানে গুরুত্ব পেয়েছে সমাজ এবং রাষ্ট্রগঠনের মৌলিক কিছু ধারণা। ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থের ৭২ সংখ্যক কবিতায় তথা আমাদের পাঠ্য ‘প্রার্থনা’ কবিতায় মানুষের স্বাধীন চেতনা এবং তার বহুমুখী কর্মজীবনকে যথাযথ মর্যাদায় ধারণ করতে পারে এমন একটি স্বর্গরাজ্যের স্বপ্ন কবি দেখেছেন। সেখানে মানুষের মন সমস্ত আশঙ্কা থেকে মুক্ত হয়ে সসম্মানে মাথা উঁচু করে আত্মপরিচয় খুঁজে নিতে পারবে। সেখানে অগ্রাধিকার পাবে শিক্ষা- কোনো সংকীর্ণতাই জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রকে সীমাবদ্ধ করতে পারবে না। কেননা এই বিরাট পৃথিবীকে যদি গৃহের আঙিনার পরিসরে আবদ্ধ করা হয় তাহলে মানুষের প্রাপ্তির পরিসরও সংকুচিত হয়ে যায়। ব্যক্তিসত্তা হোক বা জাতিসত্তা- যে-কোনো রকম ক্ষুদ্রতার মাঝেই তার পূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। এ ছাড়া কবি এ কথাও উল্লেখ করেছেন যে, পরাধীন ভারতবর্ষ এবং সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনে আহত পৃথিবীকে রক্ষা করার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হল বাক্সাধীনতা। নিজের অধিকার রক্ষার পাশাপাশি পৃথিবীর বৃহৎ কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণ করে সাফল্যের পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিই কবি উৎসাহ দেখিয়েছেন। তিনি বুঝেছিলেন, যুগ যুগ ধরে প্রচলিত অনধ কুসংস্কার এবং আচারসর্বস্বতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে আমাদের মনোজগৎ। তিনি চেয়েছিলেন আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থায় একজন নাগরিক যেন তার মুক্ত, যুক্তিবাদী চিন্তাশক্তির দ্বারাই পরিচালিত হয়, অন্ধ কুসংস্কার যেন কোনোভাবেই তাকে প্রভাবিত না করে। এ ছাড়াও তিনি চেয়েছেন সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রশক্তির আস্ফালন যেন জনসাধারণের সাহস ও সততাকে শতখণ্ডে ভেঙে না দেয়। আর কবিতার এই পর্যায়ে এসেই রবীন্দ্রনাথ বিশ্বপিতার দ্বারস্থ হয়েছেন। কবির প্রার্থনা, জগদীশ্বর যেন তাঁর নিষ্ঠুর আঘাতে চূর্ণ করে দেন সমস্ত বাধা, অন্ধকার, রাষ্ট্রশক্তির স্পর্ধাকে। তাঁর প্রদর্শিত পথ ধরেই কবির প্রিয় জন্মভূমি এবং পৃথিবী উন্নতির শিখরে পৌঁছোবে এবং তখনই কবির কল্পিত স্বর্গরাজ্য বাস্তবায়িত হবে। দেশকালনিরপেক্ষ মানবজাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন-সম্ভাবনাকে ধারণ করে রেখেছে এই কবিতা। কবিতাটির নির্মাণের মধ্যেও রয়েছে বিস্ময়কর শৃঙ্খলা এবং গাম্ভীর্য। সবমিলিয়ে সনেটের সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোচ্য কবিতাটি যেন হয়ে উঠেছে সারা পৃথিবীর সংক্ষিপ্ততম সর্বজনীন মহাকাব্য।
প্রার্থনা কবিতার নামকরণের সার্থকতা
ভূমিকা: সাহিত্য সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা তৈরিতে নামকরণের ভূমিকা অন্যতম প্রধান। বিশেষত, কবিতার নামকরণের ক্ষেত্রে কবিতার অন্তর্নিহিত কোনো ভাবনা ছাড়াও কবির জীবনদর্শন, সমাজচেতনার সূত্র ধরে মানবতা এবং মূল্যবোধের পরিচয় পাওয়া যায়।
প্রার্থনা’ কবিতার নামকরণ: ‘প্রার্থনা’ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থের ৭২ সংখ্যক কবিতা। এই কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত একশোটি কবিতাই সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে ‘সঞ্চয়িতা’-য় ‘নৈবেদ্য’-র ১৮টি সনেট সংকলিত হলে দেখা যায় প্রতিটিরই শিরোনাম রয়েছে। সেখানে ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ কবিতাটির নামকরণ করা হয়েছে ‘প্রার্থনা’। ১৯৩১ সালে প্রকাশিত ‘সঞ্চয়িতা’-র প্রতিটি কবিতা কবি নিজে নির্বাচন করেছিলেন এবং নামকরণও কবি তখনই করেছিলেন। ‘সঞ্চয়িতা’ প্রকাশের একজন অন্যতম পুরোধা ছিলেন চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (‘রবি-রশ্মি’ গ্রন্থের প্রণেতা)। কবির ‘প্রার্থনা’ নামকরণকে তিনিও সমর্থন করেছিলেন।
নামকরণের সার্থকতা: ‘রবীন্দ্র-কাব্য-পরিক্রমা’ গ্রন্থে উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য লিখেছেন যে, ‘নৈবেদ্য’-র প্রায় সমস্ত কবিতাই প্রার্থনা। পরাধীন ভারতবর্ষের নাগরিকদের সার্বিক অবক্ষয় দেখে ব্যথিত মনে কবিগুরু বিশ্ববিধাতার কাছে তাঁর দেশের জন্য প্রার্থনা করেছেন আদর্শ রাষ্ট্রের সামগ্রিক গুণাবলি যা কবির স্বদেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দেবে। তাই কোনো খণ্ডতাবোধে নয়, যে প্রগতিশীল স্বদেশ নির্মাণের স্বপ্ন তিনি দেখতেন তার মূলে প্রতিষ্ঠিত ছিল উপনিষদের পূর্ণতার তত্ত্ব। ভারতবর্ষের প্রাচীন আধ্যাত্মিক আদর্শই একদিন পরাধীন, আত্মবিশ্বাসহীন ভারতবাসীর মনে পুনরায় দৃঢ় প্রত্যয়ের সঞ্চার করবে- এই ছিল কবির বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস থেকেই তিনি বিশ্বপিতার কাছে প্রার্থনা করেছেন, তিনি যেন তাঁর নিষ্ঠুর আঘাতে ভারতবাসীর হতোদ্যম অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে ভারতবর্ষের হারিয়ে যাওয়া গৌরব পুনরুদ্ধার করার উদ্দীপনা দেশবাসীর মধ্যে সঞ্চার করেন, তাঁর প্রিয় জন্মভূমি যেন উন্নতির শিখরে পৌঁছোয়। সংহত আবেগে, ভাবের গভীরতায় যেমন দেশকাল নিরপেক্ষ মানবজাতির আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, সম্ভাবনাকে ধারণ করে রেখেছে এই কবিতা তেমনই বিশ্বস্রষ্টার চরণে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে কবির প্রত্যাশা। তাই কবিতার অন্তর্নিহিত মূল সুরটি কবির প্রার্থনাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। সেই কারণে কবিতার বিষয়ানুসারী নামকরণটি সার্থক এবং তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছে।
আরো পড়ুন : উচ্চমাধ্যমিক চতুর্থ সেমিস্টার বাংলা প্রশ্ন উত্তর