নানা রঙের দিন নাটকের বিষয়বস্তু ও নামকরণের সার্থকতা | nana ronger din natoker bishoybostu o namkoroner sarthokota

নানা রঙের দিন নাটকের বিষয়বস্তু
একদা পেশাদারি থিয়েটারের বিখ্যাত অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় প্রৌঢ় বয়সেও থিয়েটারের জগতে সক্রিয়। এখন তাঁর বয়স প্রায় আটষট্টি বছর, নিয়মিতভাবে এখনও তিনি অভিনয় করে চলেছেন। এক রাতে অভিনয়ের শেষে, অতিমাত্রায় মদের নেশায় তিনি গ্রিনরুমেই ঘুমিয়ে পড়েন। অন্যান্য চরিত্রাভিনেতারা তখন একে একে গ্রিনরুম ছেড়ে চলে গিয়েছে। বৃদ্ধ রজনীকান্তকে তারা কেউই ডেকে দেয়নি। নিজেই ঘুম ভেঙে উঠে রজনীকান্ত বিস্মিত হয়ে পড়েন। হাঁকডাক করে রামব্রিজের সাড়াশব্দ না পেয়ে মঞ্চের নিঝুম অন্ধকারে একাকী বসে থাকেন তিনি।
তারপর প্রায় নাটকীয়ভাবে মদ্যপ রজনীকান্ত নিজেই নিজের সঙ্গে কথা, বলে চলেন অনর্গল। একসময় তিনি অনুভব করতে পারেন যে তাঁর বয়স হয়েছে, এখন আর আগেকার মতো শরীরে সব ধকল সয় না, অভিনয়ের দক্ষতায় ভাটা পড়ছে নিত্যদিন। চুলে যতই কলপ করে নিজের বয়স লুকোনোর চেষ্টা করুন-না-কেন, তিনি জানেন তাঁর মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে। মৃত্যুদূত এসে দাঁড়িয়েছে জীবন-নাট্যমঞ্চের উইংসের ধারে। এরকম সময় এককভাবে নানান কথা চিন্তা করতে করতে মঞ্চে হঠাৎই দেখতে পান কালো চাদর গায়ে দেওয়া এক ব্যক্তিকে। ভয় পেয়ে, চমকে গিয়ে রজনীবাবু চিৎকার করে উঠলে সেই ব্যক্তি নিজেকে প্রম্পটার কালীনাথ সেন বলে উল্লেখ করে। কালীনাথের শোয়ার জায়গা না থাকায় সে থিয়েটার মালিকের অজান্তে প্রায়শই গ্রিনরুমে ঘুমোয়।
নিঝুম এই রাত্রিতে কথা বলার মতো একজন সঙ্গী পেয়ে নিঃসঙ্গ রজনীবাবু ডুব দেন অতীতের স্মৃতিতে। পূর্বের খ্যাতি, প্রেম, ভালোবাসা, বিচ্ছেদ-বেদনাতাড়িত জীবনে আটষট্টি বছরের বৃদ্ধ অভিনেতা রজনীকান্ত বড়োই একা। এই একাকিত্বের জন্যই ঘরে ফেরার আকর্ষণ তাঁর আর নেই।
কম বয়সে তাঁর জীবনে প্রেম আসলেও সে প্রেমের পরিণতিতে ছিল শর্ত – প্রেমের পরিবর্তে নাট্যজীবন ছেড়ে দেওয়ার শর্ত। কিন্তু জীবনকে কোনো শর্তে বাঁধার ইচ্ছা রজনীর ছিল না, তাই শিল্পের সঙ্গে বিচ্ছেদের শর্ত মেনে নিতে পারেননি রজনী। সেই কারণে নাট্যজীবনের সঙ্গে বিচ্ছেদের পরিবর্তে ব্যক্তিজীবনে প্রেমিকার সঙ্গে বিচ্ছেদকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন। সেখানে ধনী, সুন্দরী প্রেমিকাকে হারাতেও দ্বিধাবোধ করেননি রজনী। কোনো শর্তেই তিনি অভিনয়জীবন থেকে দূরে থাকতে চাননি- এমনকি অভিনয়ের জন্য পুলিশ বিভাগের স্থায়ী সরকারি চাকরিও ছেড়ে দিতে দ্বিধান্বিত হননি। স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছিলেন একজন থিয়েটারকর্মীর অনিশ্চিত জীবন।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কালের নিয়মেই তাঁর জীবনের সুসময় অতিক্রান্ত হয়। রজনীকান্তের গলার কাজ নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। চরিত্রকে নতুন করে বোঝার, ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা কমে আসে। বয়সজনিত কারণেই মূল চরিত্র থেকে তাঁকে সরে আসতে হয়। তবুও থিয়েটারের মঞ্চে যে-কোনো চরিত্রেই স্বমহিমায় উপস্থিত থাকতে দেখা যায় রজনীকান্তকে। মূল চরিত্র না পাওয়ার অতৃপ্তি তাঁকে নাট্যমঞ্চ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেনি। অভিনয়ের দক্ষতা ক্রমশ হারিয়ে ফেলতে থাকলেও একদা জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা রজনীকান্তের পার্শ্বচরিত্র অভিনয়েরও প্রশংসা করেন দর্শকমণ্ডলী। কিন্তু একজন সুদক্ষ অভিনেতা হিসেবে নিজের অভিনয়ের ত্রুটিবিচ্যুতি স্বয়ং উপলব্ধি করতে পারেন রজনী। কোনো দ্বিতীয় শ্রেণির অভিনয় দিয়ে রজনীকান্তের মতো প্রথম শ্রেণির অভিনেতা দর্শকমণ্ডলীর মন ভরাতে চান না। নিঃসঙ্গ, নিস্তব্ধ রাত্রিতে তাই তাঁর আজীবনের এই অপ্রাপ্তিগুলির আবেগঘন প্রকাশ ঘটে প্রম্পটার কালীনাথের কাছে।
এই কথোপকথন চলাকালীন কালীনাথ তাঁকে শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু রজনী চাটুজ্জের মাথায় তখন একের পর এক চরিত্রের আনাগোনা চলছে। কখনো-বা ‘রিজিয়া’ নাটক থেকে বক্তিয়ারের সংলাপ, কখনো বা ‘সাজাহান’ নাটকে ঔরঙ্গজেব ও মহম্মদের কথোপকথন। সেখান থেকেই ঔরঙ্গজেবের সিংহাসন নিষ্কণ্টক করার পর প্রবল অন্তর্দ্বন্দ্বের সময়কালীন স্বগতোক্তি। কখনো-বা তিনি নিজের সঙ্গে মিল খুঁজে পেতে থাকেন ওথেলো, ম্যাকবেথ, রাজা রিচার্ডের- যে চরিত্রগুলোতে তিনি এককালে সাবলীলভাবে অভিনয় করেছেন। দীর্ঘদিনের সঙ্গী কালীনাথ তাঁকে আশ্বাস দেওয়ার চেষ্টা করে বলে- রজনীকান্তের নাট্যপ্রতিভা আজও অমলিন।
রজনীকান্ত মনে করেন, শিল্পকে যে মানুষ ভালোবাসে তার বার্ধক্য নেই। শিল্পী ও শিল্পের মৃত্যু হয় না। কালের নিয়মে মানবজীবনে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী কিন্তু একজন শিল্পীর কৃতিত্ব চির অম্লান। জীবনসত্যের এই বার্তার মাধ্যমেই নাটকটির পরিসমাপ্তি ঘটে।
নানা রঙের দিন নাটকের নামকরণের সার্থকতা
ভূমিকা: সাহিত্যের ক্ষেত্রে নামকরণ একটি অপরিহার্য অংশ। নামকরণের মাধ্যমে পাঠক সাহিত্য উপাদানটির মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারে। নাটক এমন একটি সাহিত্যিক উপাদান যার পাঠ্যরূপ ও দৃশ্যরূপ উভয় ক্ষেত্রেই নামকরণ পাঠক ও দর্শকের কাছে তার পরিচয় বহন করে। নাটকের ক্ষেত্রে নাট্যকার সাধারণত কোনো কেন্দ্রীয় চরিত্র, বিষয় বা ভাবনাকে কেন্দ্র করে শিরোনাম তৈরি করেন। আলোচনার মাধ্যমে জেনে নেওয়া যাক পাঠ্য ‘নানা রঙের দিন’ নাটকটির নামকরণ কতখানি সার্থকতা লাভ করেছে।
পাঠ্য নাটকটি প্রখ্যাত নাট্যকার আন্তন চেকভের ‘The Swan Song’ নাটকটির ভারতীয়করণ। বিদেশি লোককথা অনুসারে শোনা যায়- সোয়ান অর্থাৎ রাজহাস নাকি মৃত্যুর ঠিক আগে অত্যন্ত সুরেলা মূর্ছনায় গান করে, যদিও এই বিশ্বাসের কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। চেকভের ‘The Swan Song’ নাটকে একজন প্রবীণ নাট্যাভিনেতা ভাসিলি তাঁর জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মত্ত অবস্থায় শূন্য প্রেক্ষাগৃহে একাকী নিজের যৌবনকালের স্মৃতি রোমান করেন। এই একই কাহিনিকে ভারতীয় প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করেছেন নাট্যকার অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, বৃদ্ধ অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের জীবনের নানা ঘাতপ্রতিঘাত বর্ণনার মাধ্যমে।
বিশ্লেষণ: এক্ষেত্রে নাটকের প্রারম্ভে মঞ্চের পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। রাত্রি, অন্ধকার, পুরোনো মঞ্চসজ্জা, ওলটানো টুল, শূন্যতা, বিষাদ – সব কিছুই যেন রজনীকান্তের বর্তমান জীবনের হাহাকার ও দৈন্যকে প্রকাশ করেছে যা তাঁর রঙিন জীবনের ফিকে হয়ে আসার ইঙ্গিত বহন করে। অথচ অভিনেতার সুচারু সংলাপ বলার দক্ষতা শুনে পাঠক তথা দর্শক বুঝতে পারেন একসময় তিনি ছিলেন রঙ্গমঞ্চের অন্যতম প্রাণপুরুষ। দর্শকদের ভালোবাসায়, প্রশংসায় তাঁর জীবন ছিল বর্ণময়। সেইসব রঙিন দিনে তাঁর জীবনে প্রেম ছিল, খ্যাতি ছিল, জনপ্রিয়তা ছিল,
আর্থিক নিরাপত্তা ছিল। কিন্তু কালের নিয়মে রজনীকান্তের জীবনের সেইসব ও রঙিন দিন আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে এসেছে। বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তিনি আর যে-কোনো চরিত্রকে অনায়াসে ফুটিয়ে তুলতে পারেন না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এক শূন্যতা গ্রাস করেছে তাঁকে। তাই মদের নেশায় ডুবে রজনীকান্ত ফিরে যেতে চান তাঁর জীবনের বর্ণময় সেইসব অতীতের দিনগুলোয়। অবসন্ন রজনীকান্ত তাই শূন্য মঞ্চেই বলে যেতে থাকেন পূর্বে অভিনীত একের পর এক নাটকের সংলাপ। জীবনের সব যন্ত্রণা, গ্লানি, হতাশা কাটিয়ে প্রম্পটার কালীনাথের কাছে তিনি প্রমাণ করতে চান অভিনেতা রজনীকান্ত ফুরিয়ে যাননি। নাট্যমঞ্চের ন্যায় জীবনের রঙ্গমঞ্চেও তিনি এখনও স্বমহিমায় উজ্জ্বল।
নামকরণের সার্থকতা: সমগ্র নাটকজুড়ে অভিনেতা রজনীকান্তের ব্যক্তিজীবন ও অভিনয়জীবনের বহুমাত্রিকতাকে প্রকাশ করেছেন নাট্যকার। যৌবনের স্পর্ধার রং, জনপ্রিয়তার উজ্জ্বল রং এবং পাশাপাশি একাকিত্বময় বার্ধক্যের রং থেকে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষার কালো রং- সবই রজনীকান্তের জীবনকে কেন্দ্র করে নাটকে উপস্থিত। তাই বলা যেতে পারে, রজনীকান্তের ঘাতপ্রতিঘাতপূর্ণ জীবনের নানা রং নিয়ে গড়ে ওঠা আলোচ্য নাটকের ব্যঞ্জনাধর্মী ‘নানা রঙের দিন’ নামকরণটি সার্থক ও যথোপযুক্ত।
আরো পড়ুন : উচ্চমাধ্যমিক চতুর্থ সেমিস্টারের বাংলা প্রশ্ন উত্তর