কেন এল না কবিতার বিষয়বস্তু ও নামকরণের সার্থকতা | keno elo na kobitar bishoybostu o naamkoroner sarthokota | hs 4th semester bengali

কেন এল না কবিতার বিষয়বস্তু
সুভাষ মুখোপাধ্যায় রচিত ‘কেন এল না’ কবিতাটি ১৯৬২ সালে { প্রকাশিত ‘যত দূরেই যাই’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। কবিতায় বর্ণিত সময়টাই ছিল একটা অস্থির সময়- একদিকে আন্দোলনে, প্রতিবাদে, প্রতিরোধে গর্জে ওঠা মানুষ, অন্যদিকে সেই আন্দোলন দমনের নামে নির্মম পুলিশি অত্যাচার, আন্দোলনের বৃহৎ ছবিটাই তখন ধরা পড়ছিল সকলের চোখ জুড়ে। কিন্তু এই সংগ্রামে যে কত ঘর শূন্য হচ্ছে, কত শত শত নিরপরাধ প্রাণের অপচয় হচ্ছে, মধ্যবিত্ত জীবনের চেনা ছন্দ উধাও হয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর অপ্রত্যাশিত আঘাতে – সেই অপূরণীয় ক্ষতির হিসেব রাখছিল না কেউ। সেই যুদ্ধবিদ্ধস্ত প্রতিটি সাধারণ মানুষের দুর্দশাগ্রস্ত জীবনের খোঁজই করেছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
এই কবিতায় আদ্যন্ত এক মধ্যবিত্ত পরিবারের চেনা ছবি এঁকেছেন কবি। গৃহকর্তা মাইনে নিয়ে ফিরলে পুজোর কেনাকাটা করতে যাওয়া হবে, তাই বাড়িতে অপেক্ষারত তার স্ত্রী ও ছেলে। বড়ো আনন্দ আজ ছেলেটির মনে। মধ্যবিত্ত জীবনের সীমিত সাধ আর সাধ্যের মধ্যে সংগতি রেখে চলতে গিয়ে সব আশা তো সবসময় পূরণ হয় না। তাই প্রত্যাশার পারদ চড়তে থাকে, হৃদয় কোনো যুক্তি মানে না। বাবা নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও বাড়ি না ফেরায়, মাকে প্রশ্নে প্রশ্নে ব্যস্ত করে তোলে ছেলেটি। এদিকে মায়ের কাছেও এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই, নানা দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন সে-ও। চারিদিকের অবস্থা ভালো নয়, দাঙ্গা-আন্দোলনের জেরে পুলিশের গুলিতে প্রত্যেকদিনই প্রাণ হারাচ্ছে বহু নির্দোষ সাধারণ মানুষ। তাই স্বামীর ফিরতে দেরি হওয়ায় যারপরনাই চিন্তিত স্ত্রী। আবার পুজোর কেনাকাটা নিয়েও আশাবাদী সে। স্বামী মাইনে নিয়ে ফিরলেই সপরিবারে বেরিয়ে পড়তে হবে, তাই দ্রুত রান্নার কাজ সারতে গিয়ে কড়াইয়ের গায়ে খুন্তির শব্দ খানিক অধিক মাত্রায় হয়ে যায়। অন্যমনস্কভাবে ফ্যান গালতে গিয়ে পা পুড়িয়ে ফ্যালে সে। গৃহকর্ত্রীর প্রতিদিনের কাজের ছন্দপতন ঘটে, ভীষণ উদ্বেগে আর চাপা উত্তেজনায় তার মন অশান্ত হয়ে ওঠে। ছেলেটির অবস্থাও একইরকম, সকাল থেকে অপেক্ষা করতে করতে তার উৎসাহে ভাটা পড়ে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও জানালার কাছে ইতিহাস বই খুলে বসে সে-তবে মন পড়ে থাকে জানালার বাইরে বাবার ফেরার পথের দিকে। কানে বাজে ঘড়ির টিকটিক, কলের জল পড়ার শব্দ, বিড়ালের গতিবিধি লক্ষ করেও সময় যেন ফুরোয় না- অপেক্ষা দীর্ঘতর হয়। বইয়ের পাতায় লেখা ইতিহাসের ঘটনা, সাল-তারিখ-বিবরণ তার মনের মতোই অবাধ্য, কিছুতেই বশ মানতে চায় না। ছেলেটির চোখ আর মন জুড়ে এখন কেবলই পুজোর নতুন জামার স্বপ্ন আর ঘ্রাণ। বাবা না আসা অবধি তাই কিছুতেই তার মন বসবে না পড়ায়। সব অক্ষর তার কাছে নিরর্থক, একগুঁয়ে, অবাধ্য। নিষ্ফল অপেক্ষায় অধীর হয়ে যখন মায়ের কাছেও কোনো সদুত্তর পায়না তখন অবুঝ ছেলেটি নিজেই দরজা খুলে বেরিয়ে যায় বাবাকে খুঁজতে। অন্যদিকে ঘরের সমস্ত কাজ সেরে উল বুনতে বসা মা-ও স্বামীর চিন্তায় উদ্গ্রীব হয়ে ছেলেকে বাধা দিতে ভুলে যায়।
পিতার জন্য অপেক্ষমান অবুঝ, অজ্ঞ বালকটি একেবারে রাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়ায়। দ্যাখে রাস্তার মোড়ে ভিড়, বাজি ফাটার শব্দ, একটা কালো গাড়ি- সে ভাবে বুঝি কোনো পুজো হচ্ছে। ঔৎসুক্য জাগে তার শিশুমনে, সেই ‘উৎসবের’ দিকে কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে যায় সে। তবে একরত্তি বালক বুঝতে পারে না যে সেই কালো গাড়ি আসলে আন্দোলন রুখতে আসা পুলিশের গাড়ি, শব্দের যে তাণ্ডব পাড়া কাঁপিয়ে দিচ্ছে তা আতসবাজি নয়- বোমা বিস্ফোরণের শব্দ। পুলিশের সঙ্গে ভয়ংকর সংঘর্ষ চলছে প্রতিবাদী জনতার। চলছে গুলি। এসব কিছু না বুঝেই সরল মনে সে তার পরিচিত পথ দিয়ে এগিয়ে চলে, অপরিচিত মৃত্যুফাঁদকে উপেক্ষা করে সেই সংঘর্ষের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ায় সে। তারপর অসহায় দিশেহারা ছেলেটির শেষ পরিণতির নির্মম ছবি আর আঁকেননি কবি, সচেতন পাঠক তা নিজেই অনুমান করে নেন। এরপর রাত বাড়লে পরিস্থিতি সাময়িকভাবে শান্ত হয়। তখন যার জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গুনছিল ছেলেটি, সেই বাবা অনেক গলি ঘুরে বারুদের গন্ধমাখা রাস্তা দিয়ে, মৃত্যুর থাবা এড়িয়ে নিরাপদে এসে পৌঁছাতে পারে বাড়িতে, কিন্তু ছেলেটি ফেরে না। দুঃসহ সময়ের অস্থিরতা কেড়ে নেয় একটি নিরপরাধ শিশুর প্রাণ।
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় এই কবিতায় কার্যত এই সমাজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখেন- ‘ছেলেটি কেন এল না’? যে পিতৃপ্রজন্মের আদর্শ হওয়া উচিত ছিল কিশোর প্রজন্মকে রক্ষা করা, যাদের দায় ছিল রাজনৈতিক দাঙ্গার আঁচ থেকে বাঁচিয়ে শিশুটিকে ভালোভাবে বড়ো করে তোলা, তাদেরই ব্যর্থতায় অকালে চলে যেতে হল ছেলেটিকে। আর নিরপরাধ, নিরপেক্ষ, নিষ্পাপ একটি শিশুর প্রাণ, রাজনৈতিক আদর্শ বা অধিকার বুঝে নেওয়ার শপথ-সংগ্রামের তুলনায় অনেক বেশি দামি মনে হয়েছিল কবির। তাই আন্দোলনমুখর, হত্যার রাজনীতির কারণে নিরপরাধ সাধারণ মানুষ এবং সর্বোপরি কিশোর প্রজন্মের অকালে প্রাণ হারানোর নির্মম ভাষ্য রচিত হয়েছে পাঠ্য কবিতাটিতে।
কেন এল না কবিতার নামকরণের সার্থকতা
ভূমিকা: সাহিত্যস্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য এবং অভিপ্রায় নামকরণের দ্বারাই পাঠকের কাছে প্রকাশ করেন। পাঠকও নাম দ্বারাই একটি পাঠের প্রতি প্রাথমিকভাবে আকৃষ্ট হন। নামকরণ তাই সাহিত্যের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। নামকরণ হতে পারে ভাবানুসারী বা বিষয়ভিত্তিক কিংবা ব্যঞ্জনাধর্মী। ‘কেন এল না’ কবিতাটির বিষয়ভিত্তিক নামকরণই করেছেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
বিশ্লেষণ: একটি জিজ্ঞাসাসূচক বাক্য দ্বারা কবিতাটির নামকরণ করা হয়েছে যা এক অনির্দিষ্ট সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে। একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার, গৃহকর্তা মাইনে নিয়ে ফিরলেই পুজোর কেনাকাটা করতে যাওয়া হবে সপরিবারে, তাই স্ত্রী ও ছেলেটি তার অপেক্ষায়। কিন্তু ‘বাবা কেন এল না’- এই প্রশ্নই কবিতাটিকে ধীরে ধীরে এক গভীর রাজনৈতিক ও মানবিক ট্র্যাজেডির দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। শিশুটি অপেক্ষায় অধৈর্য হয়ে ইতিহাস বইয়ের পাতা খুলে বসে, মা-ও অন্যমনস্কভাবে রান্না সেরে বসে উল বুনতে। শিশুটির অস্থিরতা, ইতিহাস বইয়ের হিজিবিজি অক্ষরগুলোর মতোই, ছুটে বেড়িয়ে যেতে চায়, অবশেষে ছেলেটি ঘরের দরজা খুলে বেরিয়েও যায় বাবাকে খুঁজতে। স্বামীর চিন্তায় একইরকম অধীরা মা তার ছেলেকে ঘরে আটকে রাখতে পারেনি। বাইরের পরিস্থিতি সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ, কৌতূহলী বালক সংঘর্ষের মুখে পড়ে, তারপর তার নামও অন্তর্ভুক্ত হয় অসংখ্য না-ফেরা মানুষের দলে। রাত আরও গভীর হলে ভয়ংকর বিপদ ও করাল মৃত্যুর ফাঁদ এড়িয়ে বাবা ফিরলেও, ছেলে ফেরে না। এটিই কবিতার সবচেয়ে মর্মান্তিক বাঁক, যেখানে পিতৃপ্রজন্ম তাদের সন্তানদের সুস্থ ভবিষ্যৎ রচনায় ব্যর্থ হয় এবং অগুনতি নামহীন কিশোরের লাশের ভিড়ে জায়গা হয় ছেলেটির।
সার্থকতা: ‘কেন এল না’- নামটি পুরো কবিতার কেন্দ্রীয় প্রশ্ন, যে প্রশ্নের উত্তর মেলেনি কবিতাজুড়ে। কবি কেবল সাধারণ মধ্যবিত্ত নিরপরাধ মানুষগুলোর ঘরে না ফেরার নির্মম সত্যটুকুই তুলে ধরেছেন কবিতায় আর সমগ্র সমাজের কাছে প্রশ্ন রেখেছেন তারা ‘কেন এল না?’- যে প্রশ্নের বিপরীতে রয়েছে তৎকালীন অস্থিরতার সময়, পুলিশি অত্যাচার, গণহত্যা যা ছেলেটির না ফেরার কারণ। কবিতার নামটি তাই কেবল একটি সাধারণ প্রশ্ন নয় বরং এক বেদনার্ত ক্রন্দন যা মানবতাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়। একটি নিষ্পাপ প্রাণ, যে রাজনৈতিক আন্দোলনের শরিক নয়, সরকারের সঙ্গে যার কোনো বোঝাপড়া নেই- সে কেন এলনা? কেন হারিয়ে গেল মৃত্যুর অতলে চিরতরে? এই প্রশ্ন কবিতার অন্তর্নিহিত বেদনাকে, সমাজের মানবতাহীন সত্তাটিকে আরও দৃঢ় করে পাঠকের সামনে তুলে ধরে। তাই কবিতার এই জিজ্ঞাসাসূচক নামকরণটি যথার্থ যা পাঠককে প্রশ্ন করতে শেখায়, একটি নিরন্তর প্রশ্নরূপে জেগে থাকে জিজ্ঞাসু পাঠকের মনে।
আরো পড়ুন : উচ্চমাধ্যমিক চতুর্থ সেমিস্টারের বাংলা প্রশ্ন উত্তর