হারুন সালেমের মাসি গল্পের বিষয়বস্তু ও নামকরণের সার্থকতা

হারুন সালেমের মাসি গল্পের বিষয়বস্তু ও নামকরণের সার্থকতা

হারুন সালেমের মাসি গল্পের বিষয়বস্তু ও নামকরণের সার্থকতা
হারুন সালেমের মাসি গল্পের বিষয়বস্তু ও নামকরণের সার্থকতা

হারুন সালেমের মাসি গল্পের বিষয়বস্তু

বঞ্চিত, অবহেলিত, হতদরিদ্র মানুষের করুণ জীবনের বাস্তবচিত্র ফুটে উঠেছে ‘হারুন সালেমের মাসি’ গল্পে। প্রত্যন্ত গ্রামের দুজন নারী গৌরবি ও আয়েছা বিবি- ধর্মে তারা আলাদা হলেও দারিদ্র্য, বঞ্চনা, জীবনযন্ত্রণা ও মাতৃত্ববোধ তাদের একসূত্রে বেঁধেছিল। আর আয়েছার সাত বছরের ছেলে হারুন সালেম ওরফে হারা এই দুই হতভাগ্য নারীর মধ্যে মাতৃত্বের সেতু রচনা করেছিল।

এই গল্পের মূল চরিত্র গৌরবি একজন বিধবা নারী, তার একখানা পা জন্মখুঁতো। গৌরবির দুই সন্তান- নিবারণ ও পুঁটি। দুই সন্তানের মা হওয়া সত্ত্বেও তাদের কাছে আশ্রয় পায়নি গৌরবি, নিবারণ স্বভাবে আর পুঁটি অভাবে মাকে ভাত দেয়নি। অবশেষে মুকুন্দ অর্থাৎ তার এক ভাইপোর দয়ায় তারই ভিটেয় মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছিল গৌরবির। নিঃস্ব গৌরবির পক্ষে জীবন চালানো যখন অসম্ভব হয়ে পড়েছিল সেই সময়ই হারার মায়ের সাহচর্যে নিজের পেট চালানোর সংস্থানটুকু করে নিতে পেরেছিল সে। হারার মায়ের নামটা জানার আগেই তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে যায় গৌরবির, পরে সে জানতে পারে তার আর আয়েছা বিবির সমাজ আলাদা। তবুও তারা একসঙ্গে শাকপাতা সংগ্রহ করে যশিকে দিয়ে শহরে বেচতে পাঠায়, তাতে দোষ হয় না কারণ প্রকৃতির দানে সকলের সমান অধিকার। হারার মায়ের বুদ্ধিতেই নারকেল গাছের কাঠি দিয়ে ঝাঁটা বানিয়ে দিনের অনেকটা সময় কাটিয়ে দেয় গৌরবি, উঠোনে হারার মায়ের সঙ্গে বসে বসে কেটে যায় দিনের বাকিটা। গৌরবির নিঃসঙ্গ জীবন এভাবেই ভরিয়ে দিয়েছিল বিধর্মী, অপরিচিতা আয়েছা বিবি ও তার ছোট্ট ছেলেটি। কিন্তু, যেমন হঠাৎ করে গৌরবির জীবনে এসে পড়েছিল হারার মা তেমন হঠাৎ করেই এক অঘ্রানের ভোরে চলেও যায় সে, চিরকালের মতো। রেখে যায় অস্ফুটে কথা বলা, সব কথা মনে রাখতে না পারা, হতভাগ্য হারাকে। হারার মায়ের মৃত্যুতে গৌরবি বুঝতে পারে তার জীবন যতটা নিঃসঙ্গ ছিল ঠিক ততোটাই একাকী ছিল হারার মাও। তার স্বামীও অকালে মারা গিয়েছিল সাপের কামড়ে। এক হতদরিদ্র, অভাগা, স্বজনহীন বিধবা নারী আয়েছাই আর এক অসহায় বিধবা গৌরবির দুঃখ বুঝেছিল- একে অপরকে আঁকড়ে ধরেছিল তারা, তাই অকস্মাৎ এই সঙ্গীবিয়োগে বিমর্ষ হয়ে পড়েছিল গৌরবি। আর মাকে হারিয়ে হারা এসে জুটেছিল ‘মাসি’ গৌরবির কাছে। সাতকুলে হারার কেউ ছিল না তাই গৌরবির উঠোনেই পড়ে থাকে হারা। এই ঘটনায় বিপাকে পড়ে গৌরবি, সে তার নিজেরই অন্নসংস্থান করতে অপারগ এদিকে হারার ক্ষুধা নিবারণের দায়িত্বও এসে পড়ে হতদরিদ্র গৌরবির উপর। উপরন্তু হারা তার ধর্মেরও নয়। যশি বারংবার সাবধান করে দেয় গৌরবিকে। বিধর্মী এক অনাথ ছেলেকে গৌরবি তার কাছে এনে রেখেছে তা জানতে পেরে নিবারণ, মুকুন্দ উভয়ই আপত্তি জানায়। তবে, হারা মা-এর পর নিজের বলতে জানে মাসি গৌরবিকেই, তাদের ঘরে থাকা শেষ খাদ্যসামগ্রী মেটে আলুখানি সে গৌরবির হাতে তুলে দেয়, সারাদিন কাঠ কুড়িয়ে একটু কেরোসিন এনে দেয় মাসিকে, গৌরবির ভর্ৎসনায় বাড়ি ছেড়ে নিজের ঘরে গিয়ে বসে থাকলেও অন্ধকারে ভয় পেয়ে মাসিকেই ফের আঁকড়ে ধরে হারা। গৌরবিকে এমন নিখাদ ভালোবাসা কেউ কখনও দেয়নি, এমন আপন করে নেয়নি তার নিজের ছেলেও। তাই হারার মায়া কাটাতে পারেনি গৌরবি।

হারাকে শহরে ছেড়ে আসলে নিবারণের কাছে আশ্রয় পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল গৌরবির, কিন্তু তার মাতৃহৃদয় তা মেনে নিতে পারেনি। গৌরবির মনে যেন হারার মা পর্যবসিত হয়েছে, হারাকে সবার থেকে আড়াল করে বুকে টেনে রাখতে চেয়েছে সে। শেষপর্যন্ত যখন মুকুন্দও গৌরবিকে ভিটেছাড়া করার ভয় দেখিয়েছে তখন হারার হাত ধরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে সে। পরের দয়ায় পাওয়া স্বস্তির আশ্রয়ের চেয়ে ‘স্বজন’ গৌরবির কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই যে একরত্তি শিশুটি তাকে জীবনের সর্বস্ব বলে মেনেছে তার হাত ধরেই গৌরবি এগিয়ে যেতে পেরেছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। গৌরবি চিরকাল একজন নিজের মানুষের প্রত্যাশা করেছিল যার হাত থেকে মৃত্যুর পর সে আগুন পাবে। পরের ছেলে হারা-ই হয়ে উঠেছে গৌরবির সেই স্বজন। নিবারণের আশ্রয়ে থেকে, তার মা ডাক শোনার সুযোগ প্রত্যাখ্যান করে গৌরবি আঁকড়ে ধরেছে হারাকে। হারার ‘মাসি’ ডাকের মধ্যে যে নিখাদ ভালোবাসা, আন্তরিকতা আছে তার কোনো বিকল্প খুঁজে পায়নি গৌরবি। তাই হারার হাত ধরে সে শহরের দিকে রওনা দিয়েছে, মিশে যেতে চেয়েছে জনসমুদ্রে। যেখানে তাদের ভিন্ন ধর্মপরিচয়কে কেউ কটাক্ষ কবে না, তাদের পরিচয় জানবে না কেউ, হারুন সালেমের মাসি সে- এটুকুই হবে তার পরিচয়। ছোট্ট ছেলেটাকে পাশে নিয়ে ফুটপাথে শোবে গৌরবি, ভিক্ষে করে একসঙ্গে খাবে- এই তো গৌরবির স্বর্গ, তার বহুকাঙ্খিত সুখের জীবন।

হারুন সালেমের মাসি গল্পে নামকরণের সার্থকতা

ভূমিকা: গল্পের মূলভাবটি সুপ্ত থাকে শিরোনামের মধ্যে। তাই নামকরণ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চরিত্রধর্মী, ঘটনাধর্মী বা ব্যঞ্জনাধর্মী নামকরণই সাধারণত দেখা যায়। মহাশ্বেতা দেবী রচিত ‘হারুন সালেমের মাসি’ গল্পের শিরোনামটিতে দুটি চরিত্রের উল্লেখ থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা একটি চরিত্রকেই নির্দেশ করছে। সাত বছর বয়সি হারার পুরো নাম হারুন সালেম। মাসি গৌরবি আসলে হারার মায়ের বান্ধবী। নিজের মাসি না হয়েও গ্রামীণ সমাজের ধর্মীয় সংস্কারের উর্ধ্বে উঠে গৌরবি কীভাবে তার আপন সন্তান নিবারণের ‘মা’ থেকে পরের ছেলে, হারুন সালেমের ‘মাসি’ তথা মায়ের নামান্তর হয়ে উঠল, তাই-ই চিত্রিত হয়েছে আলোচ্য গল্পে।

ঘটনার বিশ্লেষণ: হতদরিদ্র অভাগা নারী গৌরবি তার ছেলের সংসারে আশ্রয় পায়নি। মেয়ে-জামাইয়ের সংসারেও অনটনের কারণে থাকা সম্ভব হয়নি। দূরসম্পর্কের ভাইপো মুকুন্দ তার দখলি জমিতে পিসিকে থাকতে দিয়েছে। খালবিল থেকে শাকপাতা, গুগলি সংগ্রহ করে ও বিক্রি করে গৌরবিকে পেট চালাতে হয়। পায়ের সমস্যার জন্য ভালোভাবে হাঁটতে পারে না সে। তারই মতো গরিব হতভাগ্য আরও এক নারী হারার মা আয়েছা বিবি, গৌরবিকে শাকপাতা তুলতে সাহায্য করে। বিধবা আয়েছা ও তার ছেলে হারার সঙ্গে এভাবেই গৌরবির হৃদয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

এক অঘ্রানের সকালে অকস্মাৎ আয়েছার মৃত্যু হলে গৌরবি হারার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। হারার বয়স মাত্র সাত বছর। অসুখের কারণে স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারে না। বেশি কথা মনে রাখতেও পারে না। এদিকে হারার মা হারাকে বলে গিয়েছে মাসির পা ধরে পড়ে থাকতে। হারার ‘মাসি’ ডাক গৌরবির মাতৃত্বকে জাগিয়ে তোলে। সে হারাকে আশ্রয় দেয়। কিন্তু হারা মুসলমান বলে গ্রাম্যসমাজ তার হিন্দুর ঘরে থাকাকে মেনে নিতে পারে না। হারার বেঁচে থাকার একটা উপযুক্ত ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য গ্রামের মেয়ে যশোদাকে অনুরোধ করে গৌরবি। যশোদা বলে, সে হারাকে শহরে ছেড়ে দিতে পারে। সে ভিক্ষে করে খাবে। বাঁচলে বাঁচবে, মরলে মরবে। ছেলে নিবারণের কাছে আশ্রয় চাইলে সেও হারাকে ত্যাগ করার বিধানই দেয়। হারাকে গৌরবি না তাড়ালে তাকেও ভিটেমাটি ছাড়তে হবে বলে পরিষ্কার জানিয়ে দেয় মুকুন্দ। কিন্তু অকৃত্রিম বাৎসল্যে গৌরবি হারাকে ত্যাগ করার কথা ভাবতেও পারে না। তাই সমাজের ধর্মীয় সংকীর্ণতা উপেক্ষা করে, মানবিকতা ও মাতৃস্নেহের টানে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে বেছে নেয় সে। হারাকে নিয়ে গ্রাম থেকে শহরে পালিয়ে যায় গৌরবি।

নামকরণের তাৎপর্য: গৌরবি যে সার্থকতা নিবারণ ও সাবিত্রীর মা হিসেবে পায়নি, তা পেয়েছে হারার মাসি হয়ে ওঠায় মধ্যে দিয়ে। তাই ‘হারুন সালেমের মাসি’ গল্পটি গৌরবির নিজের জীবনের গল্প যতটা তার চেয়েও বেশি হারার মাসির গল্প। নিজের স্বার্থ, ধর্ম, সমাজ, দারিদ্র্য সবকিছুর উপরে গৌরবি স্থান দিয়েছে মনুষ্যত্বকে। নিজের ছেলেমেয়ে ও সমাজধর্মের কাছে তার প্রয়োজন ফুরোলেও গৌরবি উপলব্ধি করেছে হারার জন্য জগতে সে আজও প্রয়োজনীয়। তাই হারার ‘মাসি’ ডাকের মধ্যেই সে খুঁজে পেয়েছে আত্মপরিচয়, আপন নাম। ফলে আলোচ্য গল্পটির ‘হারুন সালেমের মাসি’ নামকরণটি ব্যঞ্জনাধর্মী ও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

হলুদ পোড়া গল্পের নামকরণ ও বিষয়বস্তু

Leave a Comment