ঠান্ডা লড়াইয়ের উদ্ভবের তাত্ত্বিক কারণ

ঠান্ডা লড়াইয়ের উদ্ভবের তাত্ত্বিক কারণ | Theoretical reasons for the emergence of the Cold War

ঠান্ডা লড়াইয়ের উদ্ভবের তাত্ত্বিক কারণ
ঠান্ডা লড়াইয়ের উদ্ভবের তাত্ত্বিক কারণ

ঠান্ডা লড়াইয়ের উৎপত্তির কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা ভিন্ন ভিন্ন মতামতের অবতারণা করেছেন, যদিও তারা প্রত্যেকেই মার্কিন-সোভিয়েত দ্বন্দ্বকেই এর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ঠান্ডা লড়াইয়ের উদ্ভবের কারণগুলিকে মূলত তিনটি দিক থেকে আলোচনা করা যেতে পারে। যথা-

ঐতিহ্যবাদী মতামত

ঠান্ডা লড়াইয়ের উৎপত্তির কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে মার্কিন প্রশাসন তথা মার্কিন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞগণ যে মতামত ব্যক্ত করেছেন, সেই সকল মতামতকেই ঐতিহ্যবাদী মতামত (Traditional View) বলা হয়। এঁনারা মনে করেন, সাম্যবাদী তথা কমিউনিস্ট আগ্রাসন প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে ঠান্ডা লড়াইয়ের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, যা উদারপন্থী স্বাধীন চিন্তাধারার রাষ্ট্রগুলি সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে ভূলুণ্ঠিত করতে এক উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে গ্রহণ করেছিল। এই মতবাদের সমর্থকরা মনে করেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে মিত্রশক্তি জোটের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের যে সহযোগিতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, যুদ্ধের শেষপর্বে এসে তৎকালীন সোভিয়েত প্রধান স্তালিনের সাম্যবাদী ক্রিয়াকলাপের প্রতিবাদস্বরূপ তা বিনষ্ট হয়ে যায়। ফলে সেই সময় থেকেই এক অদৃশ্য ঘৃণা, বিদ্বেষ, পারস্পরিক সন্দেহ ঠান্ডা লড়াইয়ের আবহ সৃষ্টি করেছিল। ঐতিহ্যবাদী মতবাদের প্রবক্তারা স্তালিন তথা সোভিয়েত প্রশাসনের বিরুদ্ধে বেশকিছু অভিযোগের অবতারণা করেছেন। যথা-

  1. ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ইয়াল্টা সম্মেলনে যেসকল প্রতিশ্রুতি মিত্রশক্তিবর্গ গ্রহণ করেছিল, পরবর্তীকালে স্তালিন সেই সকল চুক্তি ভঙ্গ করেন।
  2. স্তালিন ছিলেন একজন কট্টর কমিউনিস্ট। সেইসঙ্গে তিনি পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের তীব্র বিরোধীও ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে কমিউনিজমকে প্রচার করতে এবং পুঁজিবাদকে নির্মূল করতে তিনি যাবতীয় কর্মসূচিও গ্রহণ করেছিলেন।
  3. সাম্যবাদকে সমগ্র পূর্ব ইউরোপে ছড়িয়ে দিতে এবং পূর্ব ইউরোপে নিজের একাধিপত্য কয়েম করতে স্তালিনের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল কমিনফর্ম বা Communist Information Bureau। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা সুদৃঢ় করাই ছিল এই সংগঠনটির মূল উদ্দেশ্য।
  4. ঐতিহ্যবাদী প্রবক্তারা মনে করেন, স্তালিনের উদ্যোগেই চেকোশ্লোভাকিয়ায় সোভিয়েত অনুগত সরকার গঠন করার উদ্দেশ্যে বলপূর্বক আকস্মিকভাবে সরকারের পরিবর্তন ঘটানো হয়েছিল, যাকে ক্যু-দেতা (Coup Detat) বলে অভিহিত করা হয়।
  5. কেবলমাত্র পূর্ব ইউরোপেই নয়, পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে স্তালিন ইতালি ও ফ্রান্সের কমিউনিস্টপন্থীদের উসকানিমূলক প্ররোচনাদান করেছিল যাতে ক্ষমতাসীন অকমিউনিস্ট সরকারগুলিকে উৎখাত করে কমিউনিস্টরা ক্ষমতাসীন হতে পারে।

এই মতবাদের প্রবক্তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন-জর্জ কেন্নান, হার্বাট ফিস, উইনস্টন চার্চিল প্রমুখ।

সংশোধনবাদী মতামত

ঐতিহ্যবাদী মতবাদের বিপরীতে যারা মতামত প্রদান করেছেন তাঁদের সংশোধনবাদী (Revisionist) বলা হয়। এঁনারা মনে করেন ঐতিহ্যবাদী মতামত অধিক মাত্রায় মার্কিন ঘেঁষা এবং পক্ষপাতদুষ্ট। সংশোধনবাদীদের মতে, ঠান্ডা লড়াইয়ের উৎপত্তির নেপথ্যে রয়েছে আমেরিকার তীব্র সাম্যবাদবিরোধী মনোভাব। এই লড়াইকে সুনিশ্চিত করতে সোভিয়েত ইউনিয়ন স্বেচ্ছায় কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ-১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ-এর মধ্যে পশ্চিমি পুঁজিবাদী ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি নিজেরাই কমিউনিস্ট ভীতির কারণে নানান কমিউনিস্ট বিরোধী কার্যকলাপ গ্রহণ করেছিল। বিশেষ করে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকার উদ্যোগে একাধিক কর্মসূচি গৃহীত হয়েছিল। এমতাবস্থায় নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে সোভিয়েত প্রশাসন বাধ্য হয়েছিল পুঁজিবাদ বিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে। ফলস্বরূপ সমগ্র পূর্ব ইউরোপকে ঘিরে সোভিয়েত ইউনিয়ন গড়ে তুলেছিল তার সাম্যবাদী নিরাপত্তা বলয়।

সংশোধনবাদী ব্যাখ্যার সমর্থকগণ হলেন-ওয়াল্টার লিপম্যান, গ্যাব্রিয়েল কোল্কে, ডেভিড হরোউইজ, ওয়াল্টার লেফেভর প্রমুখ। সংশোধনবাদী প্রবক্তাদের মতামতকে বিশ্লেষণ করলে কেনেথ টমসন (Kenneth Thomson)-কে অনুসরণ করে এই মতবাদের আবার দুটি দিক পাওয়া যায়। যথা- নরম সংশোধনবাদী এবং ① চরম সংশোধনবাদী।

নরম সংশোধনবাদী মতামত

এই মতবাদের সমর্থকরা ঠান্ডা লড়াইয়ের উদ্ভবের জন্য মূলত ট্রুম্যান এবং তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মার্কিন নেতৃবৃন্দকে দোষারোপ করতে আগ্রহী। তাঁদের বক্তব্য প্রধানমন্ত্রী রুজভেল্ট কর্তৃক গৃহীত পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করার পরিবর্তে যে নয়া বিদেশনীতি আন্তর্জাতিক স্তরে মার্কিন প্রশাসন গ্রহণ করেছিল তাতে যুদ্ধহীন যুদ্ধের পরিস্থিতি অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারণ রুজভেল্ট সোভিয়েত প্রশাসনের সঙ্গে যে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গড়ে তুলেছিল তা পরবর্তীকালে বহাল থাকেনি। পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব ইউরোপ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবকে সম্পূর্ণরূপে মুছে দিতে আত্মনিয়োগ করেছিল। আর আমেরিকার এই কমিউনিস্টবিরোধী নয়া বিদেশনীতির সঙ্গে পাল্লা দিতেই সোভিয়েত প্রশাসন পূর্ব ইউরোপ তথা সোভিয়েত ইউনিয়নের সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলে সুরক্ষামূলক ব্যবস্থাগ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। এমনকি পোল্যান্ডে মিত্র সরকার গঠন করার ক্ষেত্রে স্তালিনের যে কর্মসূচি গ্রহণের পরিকল্পনা ছিল, মার্কিন রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যান অসহযোগিতার মাধ্যমে সেই পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিয়েছিল। আর এর প্রত্যুত্তরেই সোভিয়েত ইউনিয়ন বাধ্য হয়ে নয়া মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির অঙ্গ ‘মার্শাল পরিকল্পনা’ (Marshall Plan) বাতিল করে দিয়েছিলেন এবং সেইসঙ্গে একে একে ক্যু-দেতার মাধ্যমে চেকোশ্লোভাকিয়ার সরকার পরিবর্তন ও বার্লিন অবরোধের মতো যাবতীয় আন্তর্জাতিক নীতি গ্রহণ করেছিলেন।

চরম সংশোধনবাদী মতামত

চরম সংশোধনবাদীদের মতে, সমগ্র বিশ্বে পুঁজিবাদের একচেটিয়া বাজার দখল করার উদ্দেশ্যেই মার্কিন মদতে ঠান্ডা লড়াইয়ের আবির্ভাব ঘটে। আমেরিকা যেহেতু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রায় মাঝামাঝি সময়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল তাই তার আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও তেমন ছিল না। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তির পর যুদ্ধবিধ্বস্ত পশ্চিম ইউরোপে তথা সমগ্র বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর ও আর্থিক দিক থেকে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ লাভ করেছিল। এরপরই মার্কিন শিল্পজাত দ্রব্যাদি-সহ অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র বিক্রয়ের তাগিদে আন্তর্জাতিক বাজার দখলের বিশেষ প্রয়োজন দেখা দিল। তাছাড়া পণ্য উৎপাদনের জন্য যে বিপুল পরিমাণ কাঁচামালের নিত্যনতুন বাজার। তবে সবশেষে মধ্যপ্রাচ্যের সুবিশাল তৈলসম্পদের উপর আমেরিকার লোলুপ দৃষ্টি পড়েছিল। আর মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ন্ত্রণ করাই তখন আমেরিকার প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এমনটা করার জন্য অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছিল সমগ্র বিশ্বে মার্কিন অনুগামী সরকার প্রতিষ্ঠা, যা হবে অবশ্যই স্থিতিশীল প্রকৃতির। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এই প্রকৃতির বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য পুঁজিবাদবিরোধী সমস্তরকম বৈপ্লবিক কার্যকলাপকে ধ্বংস করা অনিবার্য হয়ে পড়েছিল, যা সফল করতে উদ্যত হয়েছিল মার্কিন প্রশাসন। বিশ্বে সেই সময় একমাত্র মহাশক্তিধর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। আর সেই রাষ্ট্রের প্রতি বিপ্লব ঘটানোর মধ্য দিয়ে মার্কিন অনুগামী সরকার প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন। সাম্যবাদের গতি প্রতিরোধ করার জন্য গৃহীত নীতিগুলিই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনায় ‘প্রতিরোধের নীতি’ (Policy of Containment) নামে পরিচিত। আসলে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে বিশ্বে পুঁজির অবাধ চলাচলকে সুনিশ্চিত করতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সকল নীতির মাধ্যমে এক নয়া বিশ্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল, যে বিশ্ব হবে সম্পূর্ণ সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণমুক্ত।

বিকল্প মতামত বা বাস্তববাদী মতামত

উপরোক্ত ঐতিহ্যবাদী ও সংশোধনবাদী মতামত দুটির সঙ্গে যারা সহমত পোষণ করতে পারেননি, তারা একটি তৃতীয় ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন যা বিকল্প মতামত (Alternative or Realist View) হিসেবে আলোচনা করা যেতে পারে। এঁনারা ঠান্ডা লড়াইয়ের উৎপত্তির কারণ হিসেবে দুই মহাশক্তির আর্থরাজনৈতিক ব্যবস্থাকে দায়ী করার পরিবর্তে উভয় রাষ্ট্রের বিষয়গত অবস্থা এবং রুশ-মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির প্রকৃতিকে দায়ী করেছেন। বিংশ শতকের মাঝের দশক থেকে এই দুটি অপ্রতিহত শক্তি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করা শুরু করেছিল। ধীরে ধীরে এর পরিধি বিস্তৃত করার জন্য উভয়েই আত্মনিয়োগ করলে উভয়ের মধ্যে এক উত্তেজনাকর রেষারেষি শুরু হয়। পশ্চিমি রাষ্ট্রগুলির মধ্যে এই আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্বের গণ্ডি অতিক্রম করে পশ্চিমের দিকে অগ্রসর হলে ফ্রান্স ও ইতালির কমিউনিস্টরা সোভিয়েত সৈন্যবাহিনীকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবে। তাই আমেরিকাও অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে পশ্চিমি দেশগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে সোভিয়েত আগ্রাসনের পথকে অবরুদ্ধ করে দেয়। আর এইভাবেই সূচনা ঘটে ঠান্ডা লড়াইয়ের। তবে এ কথা কখনই অস্বীকার করা যাবে না যে, ঠান্ডা লড়াইয়ের উৎপত্তির অন্যতম কারণ ছিল রাজনৈতিক মতাদর্শগত বিরোধ। বিকল্প অভিমত প্রদানকারী তাত্ত্বিকরা আমেরিকার পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক মতাদর্শ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের কট্টর কমিউনিস্ট মতাদর্শের মধ্যে আদর্শগত সংঘাতকে ঠান্ডাযুদ্ধের অন্যতম কারণ হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও, এটিকে প্রধান ও একমাত্র কারণ হিসেবে মেনে নিতে রাজি নন। তাই এ প্রসঙ্গে টমসন মন্তব্য করেছেন, এই মতবাদটিকে ঐতিহ্যবাদী বা সংশোধনবাদী মতামতের একটি বিকল্প অভিমত হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়।

ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল সদ্যজাত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রটিকে ধ্বংস করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে যে কর্মসূচি গ্রহণের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন তাকে বাস্তবে ফলপ্রসূ করে তুলতে ব্রিটেন ও ফ্রান্স এগিয়ে এলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। তাছাড়া ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের আগে পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন আন্তর্জাতিক স্তরে সেভাবে স্বীকৃতি লাভ করতে পারেনি। আবার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত বেশকিছু নীতি সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিরূপ মনোভাব পোষণ করতে বাধ্য করেছিল। এক্ষেত্রে উদাহরণস্বরূপ ফ্যাসিবাদকে প্রতিহত করতে মিত্রশক্তি জোটে সোভিয়েত ইউনিয়নকে অন্তর্ভুক্ত করায় দ্বিধাগ্রস্থতা, সোভিয়েত ইউনিয়নকে মিত্রশক্তি জোটের সদস্যরাষ্ট্রগুলির জন্য অস্ত্র ও অর্থ প্রেরণে বাধা দিয়ে ইচ্ছাকৃত মার্কিন প্রশাসনের সাহায্য প্রেরণ করা, দ্বিতীয় রণাঙ্গণ খোলার জন্য রুশ প্রশাসনের অনুরোধকে নাকচ করে দেওয়া, সর্বপরি, পারমাণবিক বোমা আবিষ্কার এবং জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে তা অতর্কিতে প্রয়োগ করার বিষয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নকে অবহিত না করা ইত্যাদির কথা বলা যায়। মার্কিন প্রশাসনের এইরূপ আচরণই সাম্যবাদী সোভিয়েত সরকারকে মার্কিন সরকারের প্রতি সন্দেহ, অবিশ্বাস ও তিক্ততার সঞ্চারে সহায়তা করেছিল। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ইউরোপের বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য ও অনুদান পাঠালেও সোভিয়েত ইউনিয়নের যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলগুলিতে সাহায্য প্রদানের কোনো ব্যবস্থাগ্রহণ করেনি।

তৎকালীন সোভিয়েত প্রধান স্তালিন ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে কমিনটার্ন গঠনের মাধ্যমে মিত্রশক্তি জোটের মধ্যেকার পারস্পরিক অন্তর্দ্বন্দ্ব নিরসনের প্রচেষ্টা করলেও শেষপর্যন্ত সেই সোভিয়েত ইউনিয়নই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কঠোর সিদ্ধান্তগ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। এ ছাড়াও ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যানের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের নীতিকে বাস্তবে রূপদান করতে মার্শাল পরিকল্পনা কার্যকর করা হয়। কিন্তু, পরিকল্পনায় সমগ্র ইউরোপের কথা ঘোষণা করা হলেও উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার অনুগামী রাষ্ট্রগুলিকে সাহায্যদানের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। আর এরই প্রতিবাদস্বরূপ রুশ সরকার চেকোশ্লোভাকিয়ায় ক্যু-দেতার মাধ্যমে তাবেদার সরকার প্রতিষ্টা করে। অতঃপর পশ্চিম জার্মানির মধ্য দিয়ে বার্লিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যাতে সাম্যবাদবিরোধী কার্যকলাপ চালাতে না পারে তাই সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে বার্লিন অবরোধ (Berlin Blockade, 1948) করে। কিন্তু শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আকাশপথে মার্কিন বাহিনীকে আটকানো সম্ভব না হওয়ায় রুশ প্রশাসনের এই অবরোধ কার্যত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এরপরই রুশ আগ্রাসনকে সীমাবদ্ধ করে দিতে মার্কিন উদ্যোগে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ এপ্রিল গঠিত হয় NATO (North Atlantic Treaty Organization) নামক সামরিক জোট, যা সোভিয়েত ইউনিয়নের আশঙ্কাকে সত্য বলে প্রমাণিত করে। তাই সবদিক বিবেচনা করে বলা যায়, বিকল্প অভিমত প্রদানকারীরা মার্কিন-সোভিয়েত পারস্পরিক সন্দেহ ও ভুল বোঝাবুঝিকেই ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। হ্যানস জে মরগেনথাউ, লুই জে হ্যালে প্রমুখ হলেন এই মতবাদের অন্যতম সমর্থক।

উপসংহার

উপরোক্ত তিনটি মতামত বিশ্লেষণ করার পর এ কথা বলা যায় যে, ঠান্ডা লড়াইয়ের উৎপত্তির নেপথ্যে কোনো একটিমাত্র মতামতকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা যাবে না। কারণ, প্রথম মতামতটি মার্কিন বিশেষজ্ঞরা প্রদান করেছিলেন। তাই তাদের বক্তব্যেও মার্কিন আধিক্য দেখতে পাওয়া যায়। তাঁরা ঠান্ডা লড়াইয়ের উত্থানের নেপথ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং স্তালিনকেই দায়ী করেছেন। আবার, সংশোধনবাদীরা সোভিয়েত ঘেঁষা মন্তব্য প্রদান করেন এবং তার সঙ্গে এও বলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সোভিয়েতবিরোধী কার্যকলাপ হল ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রধান কারণ। তাঁদের মতে, সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্ব মানচিত্রে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে মার্কিন উদ্যোগে গৃহীত কমিউনিস্টবিরোধী কর্মসূচির প্রতিবাদে উপযুক্ত ব্যবস্থাগ্রহণ করতে বাধ্য হয়। আর সবশেষে ঠান্ডা লড়াইয়ের উত্থানের জন্য বিকল্প মতামত বা বক্তব্যটিতে সোভিয়েত-মার্কিন ভুল বোঝাবুঝিকে দায়ী করা হয়। কিন্তু এই মতবাদের সমালোচকরা মন্তব্য করেন, সদ্যস্বাধীন অনুন্নত বা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে কোনোরকম সমস্যা না হলেও হঠাৎ করে কেন শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গেই মতবিরোধ বাঁধলো আমেরিকার বিকল্প মতামত প্রদানকারীরা এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। প্রসঙ্গত ঠান্ডা লড়াইকে কেন্দ্র করে বিশিষ্ট কিছু তাত্ত্বিকদের মন্তব্য নিম্নে ব্যক্ত করা হল-ওয়াল্ট রোস্টো (Walt Rostow) তাঁর ‘The United States in the World Arena’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছিলেন, “আমরা এমন একটি বিশ্বে বাস করছি, যেখানে কমিউনিজমের বৈশিষ্ট্যসমূহ আমাদের কাছে একটি মতাদর্শগত সংগ্রাম হাজির করেছে। কমিউনিজমকে পরাজিত করাই হল আমাদের লক্ষ্য।” জেমস্ বার্নহাম (James Burnham) তাঁর ‘Containment or Liberation’ নামক গ্রন্থে সম্পূর্ণরূপে কমিউনিজমকে নিশ্চিহ্ন করতে এবং কমিউনিজম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে কমিউনিস্ট প্রভাবমুক্ত করতে আহবান জানিয়েছেন। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান মন্তব্য করেছিলেন, “এই মুহূর্তে প্রতিটি জাতিকে দুটি জীবনধারার মধ্যে যে-কোনো একটিকে বেছে নিতে হবে।” আবার ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে রিপাবলিকান পার্টির নেতা রবার্ট টাফ্ট (Robert Taft) ‘A foreign Policy for Americans’ গ্রন্থে বলেন, মতাদর্শগত দিক থেকে যুদ্ধে কমিউনিস্টদের জয় ফ্যাসিবাদের জয়ের থেকেও বেশি ভয়ঙ্কর – হবে। অন্যদিকে, ডি এফ ফ্লেমিং (DF Flaming) তাঁর ‘The Cold War and Its Origin : 1917-1960’ গ্রন্থে ট্রুম্যান-এর রুশবিরোধী নীতিকে ঠান্ডাযুদ্ধের কারণ হিসেবে দেখেছেন। সুতরাং বলা যায় যে, মতাদর্শগত বিরোধই ঠান্ডা লড়াইয়ের উদ্ভবের পশ্চাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

আরও পড়ুন- ছুটি গল্পের বড় প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment