নির্দেশমূলক নীতিগুলিকে বাস্তবে কার্যকর করার জন্য কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে

নির্দেশমূলক নীতিগুলিকে বাস্তবে কার্যকর করার জন্য কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে

নির্দেশমূলক নীতিগুলিকে বাস্তবে কার্যকর করার জন্য কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে
নির্দেশমূলক নীতিগুলিকে বাস্তবে কার্যকর করার জন্য কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে

নির্দেশমূলক নীতিগুলিকে বাস্তবে কার্যকর করার জন্য ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ

সংবিধানের চতুর্থ অধ্যায়ে নির্দেশমূলক নীতিগুলি লিপিবদ্ধ আছে। এই নীতিগুলির গুরুত্বকে কখনোই অস্বীকার করা যায় না। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার উভয়েই এই নীতিগুলিকে বাস্তবে রূপায়ণ করার ক্ষেত্রে আগ্রহ প্রকাশ করে। পন্ডিত জওহরলাল নেহরু মনে করতেন, নির্দেশমূলক নীতিগুলি সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার পক্ষে সহায়ক। তিনি মনে করতেন, নির্দেশমূলক নীতিগুলির মাধ্যমে আয় ও সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে যেমন বৈষম্য দূরীকরণ সম্ভব, ঠিক তেমনি আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা সম্ভব। চতুর্থ সংশোধনী বিল-এর সপক্ষে তিনি বলেছিলেন, যদি কখনো মৌলিক অধিকারের সঙ্গে নির্দেশমূলক নীতির বিরোধ বাধে সেক্ষেত্রে তিনি নির্দেশমূলক নীতিগুলিকেই সমর্থন করবেন।

ভারতে গণতান্ত্রিক সমাজবাদের সংকল্প জাতীয় কংগ্রেসের দ্বারা গ্রহণ করা হয় এবং এই উদ্দেশ্যকে পাথেয় করে ভারতে মিশ্র অর্থনীতির প্রবর্তন করা হয়। বলা বাহুল্য, নির্দেশমূলক নীতিগুলি বাধ্যতামূলক নয়। তবুও সরকার এই নীতিগুলিকে যাতে বাস্তবে রূপায়িত করতে পারে তার জন্য বিভিন্ন আইনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এবং করে চলেছে।

(1) জনসাধারণের জন্য গৃহীত ব্যবস্থাসমূহ

ইন্দিরা গান্ধি ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ১৪টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের জাতীয়করণ, বিভিন্ন ধরনের সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ৪২ তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে প্রস্তাবনায় ভারতকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেছে। দেশের সম্পদের মালিকানা যাতে যথাযথভাবে বণ্টিত হয় সেইজন্য জমিদারি প্রথার বিলোপসাধন করা হয়। দেশের কৃষক ও শ্রমিকদের দুঃখ- দুর্দশা ও দারিদ্য হ্রাস করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। যেমন-সবুজ বিপ্লব কর্মসূচি, বিশদফা কর্মসূচি গরিবি হঠাও কর্মসূচি প্রভৃতি। এ ছাড়া রাজীব গান্ধির সময়ে নতুন করে বিশদফা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় নতুন কিছু উদ্দেশ্যসাধনের নিমিত্তে। যেমন-বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহ, দারিদ্র্যমোচন, শিক্ষার সম্প্রসারণ, প্রত্যেকের জন্য সুস্বাস্থ্যের ব্যবস্থা প্রভৃতি। পরবর্তী সময়ে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং-এর আমলে মন্ডল কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করার মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের স্বার্থের উন্নতিবিধানের চেষ্টা করা হয়।

(2) গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষদের জন্য গৃহীত ব্যবস্থাসমূহ

গ্রামাঞ্চলের মানুষদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ভারত সরকার ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে সমাজ উন্নয়নের জন্য প্রকল্প চালু করেছিল। পরবর্তীকালে জাতীয় নিয়োগ কর্মসূচি, স্বর্ণজয়ন্তী গ্রাম স্ব-রোজগার যোজনা, জওহর গ্রাম সমৃদ্ধি যোজনা প্রভৃতির মাধ্যমে ফেবীয় সমাজতন্ত্রের পথ প্রশস্থ করা হয়েছিল।

(3) শ্রমিক ও কর্মচারীদের জন্য গৃহীত ব্যবস্থাসমূহ

নির্দেশমূলক নীতিগুলির মাধ্যমে যাতে শ্রমিক ও কর্মচারীদের অবস্থার উন্নতি হয় সে ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকার নানাবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। যেমন-সরকারি বিমা পরিকল্পনা, প্রভিডেন্ট ফান্ড পরিকল্পনা প্রভৃতি। ঠিক তেমনি শ্রম বিরোধ আইন, ফ্যাক্টরি আইন, সামাজিক নিরাপত্তা আইন প্রভৃতি প্রণীত হয়েছে। শ্রমিকদের মধ্যে যাতে কোনোভাবে মজুরি সংক্রান্ত বিরোধ না দেখা দেয় তার জন্য মজুরি বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

(4) নির্দেশমূলক নীতিগুলি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অক্ষম

সংবিধানের চতুর্থ অংশে নির্দেশমূলক নীতিগুলির দ্বারা ফেবীয় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় কি না সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। নির্দেশমূলক নীতিগুলি আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য নয় তাই নির্দেশমূলক নীতিগুলি যদি বাস্তবে কার্যকর না হয় সেক্ষেত্রে কোনো আদালতের দ্বারস্থ হওয়া যায় না। তাছাড়া সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের সঙ্গে যদি নির্দেশমূলক নীতির বিরোধ বাঁধে সেক্ষেত্রে নির্দেশমূলক নীতিগুলি বাতিল হয়ে যায়। তবে ১৪ ও ১৯ নং ধারায় বর্ণিত মৌলিক অধিকারের সঙ্গে ৩৯ (খ)  নং এবং (গ) নং ধারায় উল্লিখিত নির্দেশমূলক নীতিকে কার্যকর করার জন্য প্রণীত কোনো আইন পরিপন্থী হলেও তা বাতিল হয়ে যায় না। তবে বাস্তবে নির্দেশমূলক নীতিগুলি কতটা কার্যকর সে বিষয়ে সঠিক কোনো মন্তব্য করা যায় না।

(5) পুঁজিপতিদের অবাধ পুঁজির আনাগোনা 

ভারতবর্ষে মিশ্র অর্থনীতি গড়ে ওঠার পশ্চাতে পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে। বলা যায়, এক প্রকার পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থেই এই মিশ্র অর্থনীতি গড়ে উঠেছে। কারণ হিসেবে বলা যায়, শিল্পায়নের মত গুরুদায়িত্ব পুঁজিপতি শ্রেণির একার দ্বারা রূপায়ণ করা সম্ভব ছিল না। তাই রাষ্ট্রীয় সাহায্যের প্রয়োজন ছিল। একটা সময়ের পর দেখা যাচ্ছে পুঁজিপতিদের মুনাফা প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ভারতের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ছিল পুঁজিপতিদের স্বার্থপূরণের এক পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনার দ্বারা পুঁজিপতিদের পুঁজির সম্প্রসারণ হয়েছিল। পরবর্তীতে ইকনমিক টাইমস রিসার্চ ব্যুরো নামক এক সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে জানা যায় টাটা, বিড়লা, সিংহানিয়া, বাজাজ-এর সম্পদ ১৯৮৮-১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল।

এর পরবর্তীতে এইসব কোম্পানির সম্পদের পরিমাণ উত্তরোত্তর কেবল বৃদ্ধিই পেয়েছে। বর্তমান সময়ে এই সম্পদের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। দেখা যাচ্ছে, সংবিধানের ৩৯(খ) ও (গ) নং ধারাকে অগ্রাহ্য করে পুঁজিপতিরা পাহাড়প্রমাণ পুঁজির মালিকে পরিণত হয়েছে। কংগ্রেস শাসনাধীন সময়পর্বে সরকারি ক্ষেত্রের তুলনায় বেসরকারি ক্ষেত্রকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। পি ভি নরসিমা রাও-এর সময়ে শিল্প বাণিজ্যের বেসরকারিকরণ-এর সূত্রপাত ঘটার ফলে হাজার হাজার শিল্প শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে, ফলে তাদের আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটে। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারেরও লক্ষ্য হল বেসরকারিকরণ।

(6) গ্রাম্য জীবনে দুর্দশার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি

শিল্পক্ষেত্রে একচেটিয়া পুঁজিপতি শ্রেণির যেমন উন্নতি ঘটেছিল, ঠিক তেমনি কৃষিক্ষেত্রে জমিদার ও ধনী চাষিদের স্বার্থও সুরক্ষিত হয়েছিল। সাধারণ চাষি যারা ছিলেন তাদের অবস্থার কোনো উন্নতি তো হয়ইনি বরং আরও অবনতি ঘটেছিল। সরকারের তরফ থেকে যে সবুজ বিপ্লব ও বিশদফা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল, তার ফলে তাদের অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটেনি বরং সবুজ বিপ্লবের সময় মাথাপিছু যে খাদ্য সরবরাহ করা হয়েছিল তার পরিমাণও হ্রাস পেয়েছিল।

বিভিন্ন সময়ে যেসকল কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল, যেমন-জাতীয় গ্রামীণ নিয়োগ কর্মসূচি, সুষম গ্রামীণ উন্নয়ন কর্মসূচি সেগুলিও চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধি-র সময়ে গরিবি হঠাও কর্মসূচি গ্রহণ করার ফলে গ্রামীণ মানুষের উন্নতির বদলে দুঃখ-দুর্দশা বৃদ্ধি পেয়েছিল। বর্তমান সময়ে জিনিসপত্রের দাম মারাত্মক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে সেই বৃদ্ধির হার ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল। এই বৃদ্ধি পাওয়ার পরিমাণ ‘সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি’ থেকে জানা যায়। তাই বলা যায়, বাজারমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবণতা স্বাধীনতার পরবর্তীকাল থেকেই সূচিত হয়েছিল।

(7) বেকারত্বের পরিমাণ বৃদ্ধি

নির্দেশমূলক নীতিগুলির মধ্যে অন্যতম একটি নীতি হল রাষ্ট্র থেকে বেকারত্বের সমস্যা দূরীকরণ। কিন্তু বাস্তবে চিত্রটা হল অন্যরকম। বেকারত্বের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার পরিবর্তে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান রিপোর্ট থেকে যা জানা যায়, তা হল- পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময়ে বেকারদের সংখ্যা ছিল ৫৩ লক্ষ। ২০১২ সালে সেই সংখ্যাটি ৪৪ কোটি ৭ লক্ষ ৯০ হাজার-এ পৌঁছায়। ২০১৩ সালে বেকারদের হার ৪.৯০ শতাংশ-এ দাঁড়িয়েছিল যা ২০২২ সালের (৫.২০ শতাংশ) তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছিল। তবে বর্তমান ভারতবর্ষে বেকারদের সংখ্যা সম্পর্কে আর কিছু মন্তব্য করার নেই, কারণ তা চরম সীমা অতিক্রম করেছে।

উপসংহার

নির্দেশমূলক নীতিসমূহ পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, নির্দেশমূলক নীতিকে কেন্দ্র করে পণ্ডিত নেহরু ইন্দিরা গান্ধি, রাজীব গান্ধি যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপায়িত হয়নি, তাঁদের স্বপ্ন কেবল স্বপ্নের আকারেই থেকে গেছে। এই নীতিগুলির উদ্দেশ্য ছিল মূলত সামাজিক ও আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা, আর্থ-সামাজিক বৈষম্য দূর করা, শ্রমিক, কৃষকদের স্বার্থ সুরক্ষিত করা প্রভৃতি। কিন্তু বাস্তব অন্য কথা বলে। বাস্তবে এই উদ্দেশ্য সফল হয়নি বরং এখনও পুঁজিপতি শ্রেণির অত্যাচার শ্রমিক শ্রেণির উপর অব্যাহত রয়েছে। এখনও তারা শ্রমের সঠিক মূল্য পায় না। সর্বোপরি অশিক্ষা এখনও সমাজের বেশিরভাগ অংশে প্রকটভাবে বর্তমান। তাই বলা চলে, নেহরুর সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সমাজব্যবস্থা গঠনের স্বপ্ন অধরাই থেকে গেছে।

Read More – As You Like It MCQ

Leave a Comment