রাজনৈতিক তত্ত্বের মৌলিক ধারণাসমূহ
আইনসংগত স্বাধীনতা বলতে কী বোঝো?
আইনসংগত স্বাধীনতা: আইনসংগত স্বাধীনতা প্রকৃতিগত দিক থেকে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট। আইনের মাধ্যমে স্বীকৃত, সংরক্ষিত ও নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতাকে আইনসংগত স্বাধীনতা বলে।
এই ধরনের স্বাধীনতার পশ্চাতে সংবিধান ও আইনের অনুমোদন স্বীকৃত থাকে। অর্থাৎ, আধুনিক রাষ্ট্রে নাগরিকরা আইনসংগত স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে।
ব্যক্তিগত বা পৌর স্বাধীনতা বলতে কি বোঝায়?
পৌর স্বাধীনতার ধারণা: পৌর স্বাধীনতা বা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হল সেইসব স্বাধীনতা, যার মাধ্যমে মানুষ তার ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনে সক্ষম হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ব্ল্যাকস্টোন-এর মতে, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, ব্যক্তিগত গতিবিধি এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির স্বাধীনতা হল পৌর স্বাধীনতার মুখ্য উপাদান। এ প্রসঙ্গে কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন-চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংঘ বা সমিতি গঠনের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, পরিবার গঠনের স্বাধীনতা ইত্যাদি।
রাজনৈতিক স্বাধীনতা বলতে কী বোঝায়?
রাজনৈতিক স্বাধীনতা: রাজনৈতিক স্বাধীনতা বলতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপরিচালনার প্রক্রিয়ায় জনগণের প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণে বোঝায়। যেমন- সরকার গঠন, সরকারি সিদ্ধান্তের সমালোচনা, নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও নির্বাচিত হওয়া এবং সরকারি চাকরি লাভের অধিকার ইত্যাদি হল রাজনৈতিক স্বাধীনতার অন্তর্গত।
অধ্যাপক ল্যাস্কি এ প্রসঙ্গে বলেন যে, “রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের ক্ষমতাই হল রাজনৈতিক স্বাধীনতা।”
অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বলতে কী বোঝায়?
অর্থনৈতিক স্বাধীনতা: অর্থনৈতিক স্বাধীনতা হল অভাব অনটন, দারিদ্র্য, বেকারত্ব থেকে মুক্ত থাকার স্বাধীনতা। যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের অধিকার, বিশ্রামের অধিকার এই স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত। এ ছাড়াও উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাওয়ার অধিকার, বার্ধক্য বা অক্ষম অবস্থায় সরকার কর্তৃক রক্ষিত হওয়ার অধিকার ইত্যাদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত। আবার অনেকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বলতে শিল্পক্ষেত্রে, অর্থনীতিতে অবাধ সুযোগসুবিধাকে বোঝায়।
বার্কার এবং ল্যাস্কি প্রমুখ রাষ্ট্রতাত্ত্বিকরা অর্থনৈতিক স্বাধীনতার পক্ষে মত প্রদান করেছেন। বার্কার বলেছেন, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পরাধীন শ্রমিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্বাধীন হতে পারে না। কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বলেন, ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’। মার্কসবাদী তাত্ত্বিকরাও অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য বলেছেন।
নৈতিক স্বাধীনতার সংজ্ঞা দাও। নৈতিক স্বাধীনতার উপর কারা গুরুত্ব আরোপ করেছেন?
নৈতিক স্বাধীনতা: নৈতিক স্বাধীনতার অর্থ হল ব্যক্তির নৈতিক বিচারবুদ্ধি ও চেতনার স্বাধীনতা। বলা যায়, নৈতিক স্বাধীনতা ব্যতীত সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা মূল্যহীন।
তাত্ত্বিকগণ: ইংরেজ আদর্শবাদী দার্শনিক টি এইচ গ্রিন, বোসাংকোয়েত, বার্কার প্রমুখ নৈতিক স্বাধীনতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁদের মতে, নৈতিক স্বাধীনতা না থাকলে ব্যক্তি তার প্রবৃত্তির দাস হয়ে পড়বে।
স্বাধীনতার রক্ষাকবচ বলতে কী বোঝায়? এর প্রয়োজনীয়তা সংক্ষেপে লেখো।
স্বাধীনতার রক্ষাকবচ: স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত ও সুনিশ্চিত করার ব্যবস্থাপনাকে স্বাধীনতার রক্ষাকবচ বলা হয়। অধ্যাপক ল্যাস্কি বলেছেন যে, সংরক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থা ছাড়া অধিকাংশ মানুষ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে না।
প্রয়োজনীয়তা: অনেকসময় মুষ্টিমেয় ব্যক্তিবর্গ দ্বারা গঠিত সরকার নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে থাকে, এমতাবস্থায় ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা করা অনিবার্য হয়ে ওঠে। এই কারণে প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা অর্থাৎ স্বাধীনতার রক্ষাকবচ এর উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলি (Safeguard of Liberty) কী কী?
স্বাধীনতার রক্ষাকবচ: স্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্য যেসব রক্ষাকবচের ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়ে থাকে, সেগুলি হল সংবিধানে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকারসমূহ, আইনের অনুশাসন নীতি, ⑪ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি, দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা, পদচ্যুতি, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারালয়, এবং সদাসতর্ক জনমত। গণভোট, গণউদ্যোগ, ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ
স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকারের ভূমিকা উল্লেখ করো।
স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকারের ভূমিকা: সংবিধানে মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ করা স্বাধীনতার এক গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ। সুস্পষ্টভাবে মৌলিক অধিকারগুলি বিধিবদ্ধ থাকলে নাগরিকগণ তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকতে পারে, অধিকারগুলির মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। সরকার যদি এই অধিকারগুলি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয় তাহলে নাগরিকগণ তাদের অধিকার রক্ষার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে। ফলে সরকারও অধিকারগুলির প্রতি সচেতন ও শ্রদ্ধাশীল হয়।
স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে আইনের অনুশাসন (Rule of Law)-এর ভূমিকা উল্লেখ করো।
স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে আইনের অনুশাসন: আইনের অনুশাসন বলতে আইনের প্রাধান্য ও আইনের দৃষ্টিতে সাম্যকে বোঝায়। আইনের প্রাধান্য বজায় থাকলে সরকার প্রচলিত আইন অনুযায়ী সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে, ফলে ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার বজায় থাকে এবং সরকার স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে না। আইনের দৃষ্টিতে সাম্য প্রতিষ্ঠা হলে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে একজন সাধারণ নাগরিক পর্যন্ত সকলেই অভিন্ন আইনের দ্বারা পরিচালিত হয় এবং অপরাধ করলে তার বিচার একই আইনের ভিত্তিতে হয়।
ব্রিটেনে লিখিত সংবিধান নেই, তাই সেখানে স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে আইনের অনুশাসন নীতিটির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির (Separation of Power) উল্লেখ করো।
স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির ভূমিকা: একই ব্যক্তি বা একই বিভাগের হাতে আইন প্রণয়ন, শাসন ও বিচার সংক্রান্ত কার্যভার অর্পিত হলে উক্ত ব্যক্তি বা বিভাগ স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে। এর ফলে ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব হতে পারে। তাই সরকারের তিনটি বিভাগ যথা- আইন, শাসন ও বিচার বিভাগ প্রত্যেকে আলাদাভাবে স্ব স্ব বিভাগীয় দায়িত্ব পালন করবে। এর ফলে ব্যক্তিস্বাধীনতা বজায় থাকবে। মস্তেস্কু, ব্ল্যাকস্টোন, ম্যাসিডন প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণকে ব্যক্তিস্বাধীনতার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ বলে গণ্য করেছেন।
প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি (Direct Democratic System) কীভাবে স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে?
স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ভূমিকা: বর্তমানে জনবহুল রাষ্ট্রগুলিতে গণভোট, গণউদ্যোগ, পদচ্যুতির মতো প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিগুলির প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। এর মাধ্যমে জনগণের স্বাধীনতা সংরক্ষণ করা হয়। এই পদ্ধতিগুলি থাকলে সরকার জনগণের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কারণ সরকার নাগরিকদের স্বাধীনতায় বাধা সৃষ্টি করলে জনসাধারণ প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মাধ্যমে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে। সুইটজারল্যান্ডে এই তিনটি পদ্ধতির প্রচলন আছে।
স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ (Decentralization of Power) কীভাবে ভূমিকা পালন করে?
স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ-এর ভূমিকা: অধ্যাপক ল্যাস্কি মন্তব্য করেছিলেন, যে রাষ্ট্রে ক্ষমতা অতিমাত্রায় কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়, সেখানে স্বাধীনতা থাকতে পারে না। অর্থাৎ কেন্দ্রের হাতে সমস্ত ক্ষমতা একীভূত হলে শাসন কর্তৃপক্ষের স্বৈরাচারী হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ ও স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার প্রচলন হলে নাগরিকদের ব্যক্তিস্বাধীনতা ভোগের সুযোগ বৃদ্ধি পায়। তেমনই তাদের রাজনৈতিক সচেতনতার স্তরও উন্নত হয়।
স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে সদাসতর্ক জনমত কীভাবে ভূমিকা পালন করে?
স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে সদাসতর্ক জনমত এর ভূমিকা: বলিষ্ঠ ও সদাজাগ্রত জনমতই হল স্বাধীনতার সর্বোন্নত রক্ষাকবচ। স্বাধীনতার জন্য নাগরিকদের চাহিদা এবং তাকে রক্ষা করার জন্য নাগরিকদের উচিত তৎপরতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে বলিষ্ঠ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ব্রিটেনের জনগণ স্বাধীনতা রক্ষার বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন, তাই সরকার তাদের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করার মতো কোনো পদক্ষেপ নিতে সাহস পায় না। পেরিক্লিস-এর মতানুসারে, ‘চিরন্তন সতর্কতাই হল স্বাধীনতার মূল্য’।
আইনের রক্ষাকবচ হিসেবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারালয় (Independent Judiciary)-এর ভূমিকা উল্লেখ করো। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ‘আধা অলীক কাহিনী-কে বলেছেন?
স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারালয়ের ভূমিকা: স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগের অস্তিত্ব ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার জন্য আবশ্যিক শর্ত হিসেবে গণ্য করা হয়। বিচারকরা যদি নিরপেক্ষভাবে কাজ করার সুযোগ না পায় বা বিচারকদের যদি কারও অধীনে থেকে কাজ করতে হয়, তাহলে ন্যায়বিচার অবহেলিত হয় এবং নাগরিকগণ স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হয়। ভারতবর্ষ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশে ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার ক্ষেত্রে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারবিভাগের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ‘আধা অলীক কাহিনী’ এই মন্তব্যটি করেছেন-রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অ্যালান বল।
আইন ও স্বাধীনতার মধ্যে সম্পর্ক সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করো।
আইন ও স্বাধীনতার মধ্যে সম্পর্ক: প্রত্যেক নাগরিকের আত্মবিকাশের উপযোগী পরিবেশকে স্বাধীনতা বলে। রাষ্ট্রীয় আইনের দ্বারাই স্বাধীনতা সৃষ্টি হয় ও তার মাধ্যমে সমাজে দুর্বল শ্রেণির স্বাধীনতা রক্ষা করা হয়।
দ্বিতীয়ত, আইন কেবল স্বাধীনতাকে রক্ষাই করে না, সম্প্রসারিতও করে। আইন ছাড়া স্বাধীনতার ভিত্তি দুর্বল হয়ে যায়। তাই বলা হয় আইন স্বাধীনতার শর্ত (Law is Condition of Liberty)। এ প্রসঙ্গে রিচি বলেছেন, “স্বাধীনতা বলতে যদি আত্মবিকাশের জন্য আবশ্যক সুযোগসুবিধা বোঝায়, তবে তা অবশ্যই আইন দ্বারা সৃষ্ট।”
নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক বিচার করেছেন?
অথবা, আইন এবং স্বাধীনতাকে পরস্পরবিরোধী বলে মনে করেন, এমন কিছু রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর নাম উল্লেখ করো।
আইন ও স্বাধীনতার পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মতান্তর লক্ষ করা যায়। হার্বার্ট স্পেনসার, জেরেমি ব্যোম, জেমস মিল, জন স্টুয়ার্ট মিল প্রমুখ ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী দার্শনিকেরা আইন, রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব এবং স্বাধীনতাকে পরস্পরবিরোধী বলে গণ্য করেছেন। এ ছাড়া ডেভিড রিকার্ডো, আলফ্রেড মার্শাল, অ্যাডাম স্মিথ প্রমুখ অর্থনীতিবিদ এবং গডউইন, বাকুনিন, ক্রোপোটকিন প্রমুখ নৈরাজ্যবাদী একই মত পোষণ করেছেন।
কোন্ কোন্ রাষ্ট্রচিন্তাবিদ ইতিবাচক অর্থে আইন এবং স্বাধীনতার সম্পর্ক বিচার করেছেন?
অথবা, আইন এবং স্বাধীনতার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলে কারা মনে করেছেন?
ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যেসব রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আইন এবং স্বাধীনতার সম্পর্ককে বিচার করেছেন, তারা হলেন আর্নেস্ট বার্কার, হ্যারল্ড ল্যাস্কি, রিচি প্রমুখ। তাঁরা মনে করেন, আইন এবং স্বাধীনতার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বর্তমান। প্রত্যেকের স্বাধীনতা অন্যের স্বাধীনতার দ্বারা সীমাবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত।
আইন কর্তৃক স্বাধীনতা রক্ষার উপায়গুলি বর্ণনা করো।
আইন কর্তৃক স্বাধীনতা রক্ষার উপায়সমূহ: আইনের সাহায্যে রাষ্ট্র সাধারণত তিনটি উপায়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা করে। যথা- সবলের অত্যাচারের হাত থেকে আইন শোষিত মানুষকে রক্ষা করে। আইনের সঠিক প্রয়োগ কখনোই অন্যায়ভাবে অন্যের স্বাধীনতা কেড়ে নেয় না, রাষ্ট্র বিশেষ ধরনের আইন প্রণয়ন করে, যাতে শাসকগোষ্ঠীর স্বৈরাচারের ফলে ব্যক্তিস্বাধীনতা বিনষ্ট না হয় এবং আইনের দ্বারা রাষ্ট্র এমন একটি সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি করে, যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি তার ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারে।
আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক প্রসঙ্গে বার্কার-এর মত কী?
আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক প্রসঙ্গে বার্কার এর মত: বার্কার মনে করতেন, প্রত্যেকের স্বাধীনতা অপরের স্বাধীনতার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত অর্থাৎ স্বাধীনতা হল আপেক্ষিক। আইন যেমন একদিকে স্বাধীনতার রক্ষাকর্তা হিসেবে কাজ করে, তেমনি তার সম্প্রসারণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তাই বার্কার স্বাধীনতা বলতে নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতার কথা বলেছেন, এই ধরনের স্বাধীনতা শুধুমাত্র আইন নির্দিষ্ট পথেই ভোগ করা সম্ভব।
আইন এবং স্বাধীনতার সম্পর্ক প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রিচি কী বলেছেন?
আইন এবং স্বাধীনতার সম্পর্ক প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রিচি-এর মত: আইন এবং স্বাধীনতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পর্যবেক্ষণ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রিচি মন্তব্য করেছেন যে, স্বাধীনতা বলতে যদি আত্মবিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগসুবিধাকে বোঝায়, তবে তা নিশ্চিতভাবে আইনের দ্বারা সৃষ্টি হয়। তাছাড়া, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত আইনসভা জনমতের দিকে দৃষ্টি রেখেই নানা ধরনের জনকল্যাণকর আইন প্রণয়ন করে।
সাম্য বলতে কী বোঝায়?
সাধারণভাবে সাম্য বলতে সব মানুষের সমান অধিকারকে বোঝায়। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সাম্য বা Equality কথাটি অন্য অর্থে ব্যবহৃত হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় সাম্য বলতে বোঝায়, ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশের জন্য উপযুক্ত সুযোগসুবিধার সমতা লাভ। অর্থাৎ, সাম্য প্রত্যেকটি মানুষের আত্মোপলব্ধিতে বিশেষভাবে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
বার্কারের মতে সাম্য কী?
বার্কারের মতে সাম্য: বার্কার-এর মতে সাম্য হল, অধিকার বণ্টনের সেই পদ্ধতিগত নিয়ম যা ন্যায়ের অনুসরণে ন্যায় থেকে উদ্ভূত। অর্থাৎ, সাম্য অধিকার বণ্টনের ক্ষেত্রে কোনোপ্রকার পার্থক্য সৃষ্টি করে না। অর্থাৎ, সকলেই সমান সুযোগ পাওয়ার অধিকারী। কিন্তু ব্যক্তিকেই সেই সমান সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে। বার্কার সাম্যের ধারণাকে একটি পরিবর্তনশীল ধারণা বলে অভিহিত করেছেন। তিনি সাম্য বলতে আইনগত ও সামাজিক সাম্য উভয়কেই বুঝিয়েছেন। তিনি মনে করেন, আইনগত সাম্যকে বাস্তবায়িত করতে গেলে আর্থিক সাম্য একান্ত আবশ্যক।
ল্যাস্কির মতে সাম্য কী?
ল্যাস্কির মতে সাম্য: ল্যাস্কি সাম্য বলতে বিশেষ সুযোগসুবিধার অনুপস্থিতি এবং সকলকে পর্যাপ্ত সুবিধা দান কে বুঝিয়েছেন। তাঁর মতে, সাম্য হল অসমান অংশকে সমান করার এক প্রক্রিয়া। তিনি সাম্য বলতে সকলের প্রতি সমান ব্যবহারকে বোঝাননি। তাঁর মতে, প্রতিটি ব্যক্তির চাহিদা, দাবি এবং প্রয়োজন ভিন্ন প্রকৃতির। অর্থাৎ ব্যক্তিদের মধ্যে শক্তি, সামর্থ্য, বুদ্ধিতে স্বাভাবিক পার্থক্য থাকে। তাই সাম্য বলতে সমতাকে বোঝায় না।
টমাস ম্যুর সাম্য বলতে কী বুঝিয়েছেন?
টমাস ম্যুরের অভিমত: টমাস ম্যুর তাঁর ‘ইউটোপিয়া’ (Utopia) গ্রন্থে সাম্যের ধারণাটির অবতারণা করেন। তাঁর মতে, ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসান ঘটলে সামাজিক ভারসাম্য বজায় থাকবে এবং সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। তিনি এমন এক কাল্পনিক জগতের প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন যেখানে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অস্তিত্ব থাকবে না এবং সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
কে সাম্যকে একটি ‘পরিবর্তনশীল ধারণা’ বলে অভিহিত করেছেন?
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্কার সাম্যের ধারণাটিকে একটি ‘পরিবর্তনশীল ধারণা’ বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সাম্যের ধারণাটিও নিজেকে পরিবর্তিত করেছে। প্রাচীনকালে সাম্যের ধারণাটি যেমন ছিল বর্তমানে তা আর নেই। বর্তমানে সাম্য বলতে সামাজিক, রাজনৈতিক, গঠনগত সব ক্ষেত্রেই সমান অধিকার প্রতিষ্ঠাকে বোঝায়।
সাম্য সম্পর্কে মার্কসীয় ধারণা কী?
মার্কসীয় ধারণা: মার্কসবাদীদের মতে, সমাজে প্রকৃত সাম্য তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে যখন ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ ও শ্রেণিবৈষম্যের অবসান ঘটবে। তাঁদের মতে, ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং শ্রেণিবৈষম্যই হল সমাজে বৈষম্য সৃষ্টির মূল কারণ। তাঁরা বলেন, ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসানের পরই প্রকৃত সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
কোথায় প্রথম সাম্যের ধারণাটির উৎপত্তি ঘটে?
সাম্যের ধারণার উৎপত্তি: সাম্যের ধারণাটির প্রথম উৎপত্তি ঘটে প্রাচীন গ্রিসে। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিসের স্টোয়িক দার্শনিকেরা স্বাভাবিক সাম্যের ধারণাটির অবতারণা করেন। তাঁরা বিশ্বজনীন প্রাকৃতিক আইন ও বিশ্বজনীন নাগরিকতার কথাও বলেন। এ ছাড়াও রোমান দার্শনিক যেমন সিসেরা, পলিবিয়াস এবং পরবর্তীকালে খ্রিস্টান ধর্মযাজকরা স্টোয়িক দার্শনিকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে স্বাভাবিক সাম্যের ধারণার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন।
সাম্যের মূলকথা কী?
সাম্যের মূলকথা: বাস্তবে মানুষের একে অপরের সঙ্গে মানসিক ও দৈহিক পার্থক্য বর্তমান। তাই ব্যক্তির আশা-আকাঙ্খা, চাহিদাও বিভিন্ন হয়। সাম্য বলতে ব্যক্তির ব্যক্তিগত পার্থক্যের মধ্যে সমতাকে বোঝায় না। বরং সকলের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক অধিকারের ক্ষেত্রে সমতা প্রতিষ্ঠাকে বোঝায়। অধ্যাপক ল্যাস্কি-র মতে সাম্য বলতে মূলত দুটি বিষয়- বিশেষ সুযোগসুবিধার অনুপস্থিতি ও⑪ সকলের জন্য উপযুক্ত সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা করা।
‘আইনের দৃষ্টিতে সাম্য’ বলতে কী বোঝো?
কর আইনের দৃষ্টিতে সাম্য হল আইনগত সাম্যের একটি রূপ। আইনগত সাম্য বলতে প্রত্যেক নাগরিকই আইনের চোখে সমান এবং আইন সকলকে সমানভাবে রক্ষা করবে। কোনো ব্যক্তি বিশেষকেই বিশেষ সুযোগসুবিধা প্রদান করা হবে না। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই সমান সুযোগসুবিধা ভোগ করবে। এই আইনগত সাম্যই হল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি।
সাম্যের দুটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো?
সাম্যের বৈশিষ্ট্য: সাম্য বলতে ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশের জন্য উপযুক্ত সুযোগসুবিধার সমতা লাভকে বোঝায়। সর্বপ্রথম স্টোয়িক দার্শনিকরা সাম্যের ধারণাটির উদ্ভব ঘটায়।
সাম্যের দুটি বৈশিষ্ট্য হল-
- সাম্য হল মানুষের অধিকারকে সুনিশ্চিত করার কিছু সুযোগ যা সকলের ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য।
- সাম্য হল একটি পরবির্তনশীল ধারণা, যা সময়ের, যুগের, কালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তিত হতে থাকে।
সাম্যের প্রকৃতিকে কয় ভাগে ভাগ করা যায় ও কী কী?
সাম্যের প্রকৃতি: সাম্য বলতে সকলের জন্য উপযুক্ত সুযোগসুবিধার সমতাকে বোঝায়। সাম্যের প্রকৃতি বিষয় বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। তাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সাম্যের প্রকৃতিকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- নেতিবাচক অর্থে সাম্য এবং ইতিবাচক অর্থে সাম্য। ইতিবাচক সাম্যের একজন প্রবক্তা হিসেবে বার্কার এবং নেতিবাচক সাম্যের একজন প্রবক্তা হিসেবে ল্যাস্কির নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।
নেতিবাচক অর্থে সাম্য বলতে কী বোঝায়?
নেতিবাচক অর্থে সাম্য: নেতিবাচক অর্থে সাম্য হল ধর্ম, জাতি, সম্পদ, বাসস্থান, সম্পত্তি, বর্ণ, লিঙ্গ এবং যে-কোনো রকম কৃত্রিম বিভাজনের ভিত্তিতে প্রভেদের অবসান। অর্থাৎ জাতি, ধর্ম, সম্পদ, বাসস্থান নির্বিশেষে কোনোরকম বৈষম্য না করা। রাষ্ট্রের কাছে বা আইনের কাছে সকলেই সমান। রাষ্ট্র কোনো পক্ষপাতিত্ব করবে না। অধ্যাপক ল্যাস্কি-কে অনুসরণ করে বলা যায়, নেতিবাচক অর্থে সাম্য হল ‘বিশেষ সুযোগ সুবিধার অনুপস্থিতি’।
ইতিবাচক অর্থে সাম্য বলতে কী বোঝায়?
ইতিবাচক অর্থে সাম্য: ইতিবাচক অর্থে সাম্য বলতে বোঝায় সকলের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগসুবিধা প্রদান। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, সকলের প্রতি অভিন্ন ব্যবহার। কারণ সকল মানুষের মধ্যে আত্মবিকাশের জন্য ভিন্ন চাহিদা লক্ষ করা যায়, আবার তাদের কর্মপ্রয়াস ও যোগ্যতাও অভিন্ন নয়। রাষ্ট্র প্রত্যেক ব্যক্তির পরিপূর্ণ আত্মবিকাশের সমান সুযোগ সৃষ্টি করলেই কেবলমাত্র সাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
বেন ও পিটার্ক্স-এর মতে, ইতিবাচক সাম্য কী?
বেন ও পিটারস্ এর মতবাদ: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বেন ও পিটান্স ইতিবাচক দৃষ্টিতে সাম্যের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তাঁরা ইতিবাচক সাম্য বলতে বুঝিয়েছেন যে, সুযোগের সমানাধিকার অর্জিত হতে পারে তখনই, যখন সকলের প্রয়োজনীয় সুযোগ থাকবে। তবে এর অর্থ পেশায় বা ব্যাবসায়ে সাফল্য অর্জনকে বোঝায় না, বরং সুনাগরিক হওয়ার সুযোগ বা ব্যক্তিত্ব বিকাশের লক্ষ্যে সমানাধিকারকে বোঝায়।
সাম্যকে কয় ভাগে ভাগ করা যায় ও কী কী?
সাম্যের প্রকারভেদ: সাম্য বলতে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য পরিপূর্ণ সুযোগসুবিধাকে বোঝায়। সমাজের সকল নাগরিক যখন রাজনৈতিক সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে সমান অধিকার ভোগ করে তখন সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সাধারণত সাম্যকে আট ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
- স্বাভাবিক সাম্য বা প্রাকৃতিক সাম্য (Natural Equality),
- সামাজিক সাম্য (Social Equality),
- আন্তর্জাতিক সাম্য (International Equality),
- সাংস্কৃতিক সাম্য (Cultural Equality),
- লিঙ্গ সাম্য (Gender Equality),
- রাজনৈতিক সাম্য (Political Equality),
- অর্থনৈতিক সাম্য (Economic Equality) এবং
- আইনগত সাম্য (Legal Equality)।
স্বাভাবিক সাম্য কাকে বলে?
স্বাভাবিক সাম্য: স্টোয়িক দার্শনিক, রোমান চিন্তাবিদ ও চুক্তিবাদী দার্শনিকদের রচনায় স্বাভাবিক সাম্যের ধারণা পাওয়া যায়। স্বাভাবিক সাম্যের মূল কথা হল জন্মগতভাবে সকল মানুষ সমান এবং সমানাধিকারসম্পন্ন। কারণ প্রকৃতি সকল মানুষকে সমানভাবে সৃষ্টি করেছে। এই ধারণাকেই স্বাভাবিক সাম্য বলে। রোমান দার্শনিক সিসেরো ও পলিবিয়াস স্বাভাবিক সাম্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।
সামাজিক সাম্য বলতে কী বোঝায়?
সামাজিক সাম্য: সামাজিক সাম্য হল মানুষের সামাজিক অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজনীয় সমতা। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বংশ, নারী-পুরুষ ভেদে সমাজে যখন বিভেদ করা হয় না, তখন তাকে সামাজিক সাম্য বলে। অর্থাৎ সমাজের সকল স্তরের প্রত্যেক ব্যক্তি তার জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমান ক্ষমতা ও মর্যাদা ভোগ করবে। অবাধ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ দ্বারা মানুষের আর্থিক সংগতির সাম্যঞ্জস্য বিধান করা প্রভৃতি ক্ষেত্রে সামাজিক সাম্য দেখতে পাওয়া যায়। ধনতান্ত্রিক সমাজে সাম্যের এই ধারণাটি প্রসার লাভ করে।
বার্কার সামাজিক সাম্য বলতে কী বুঝিয়েছেন?
বার্কারের বক্তব্য: সামাজিক সাম্য বলতে সমাজের সকল স্তরের ব্যক্তির সমান মর্যাদা ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠাকে বোঝায়। বার্কার সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর মতে, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠা করাকেই সামাজিক সাম্য বলে। তিনি মনে করেন, ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য আইনগত সাম্য পর্যাপ্ত নয়, এর জন্য প্রয়োজন সামাজিক সাম্যের।
আন্তর্জাতিক সাম্য কী?
আন্তর্জাতিক সাম্য: সাম্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিভাজন হল আন্তর্জাতিক সাম্য। রাষ্ট্রগুলির মধ্যে জনসংখ্যা থেকে শুরু করে ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক বা সামরিক গুরুত্বের ব্যবধান না মেনে সমানভাবে বিবেচনা করাকে আন্তর্জাতিক সাম্য বলা হয়।
আন্তর্জাতিক সাম্যের মূল বক্তব্য হল, ক্ষুদ্র-বৃহৎ নির্বিশেষে সমস্ত জাতীয় রাষ্ট্রের মর্যাদা ও গুরুত্ব সমান। অধ্যাপক জোহারি-র মতে, এর অর্থ হল বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রকে সমানভাবে দেখা হবে। তবে বাস্তবে ক্ষমতাকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় বৃহৎ ও অতিবৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলির আধিপত্য, সামরিক আগ্রাসন প্রভৃতি আন্তর্জাতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার পথে মস্ত বড়ো বাধা হয়ে দেখা দিয়েছে।
সাংস্কৃতিক সাম্য বলতে কী বোঝায়?
সাংস্কৃতিক সাম্য: সাংস্কৃতিক সাম্য বলতে এমন এক ধরনের সাম্যকে বোঝায় যেখানে বহুত্ববাদী সমাজে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সংস্কৃতিগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করা হয় না। অর্থাৎ এককথায় বলতে গেলে সাংস্কৃতিক পার্থক্য নির্বিশেষে সকলকে তার নিজ নিজ সংস্কৃতির পরিপূর্ণ বিকাশের সমান সুযোগ প্রদান করাকেই সাংস্কৃতিক সাম্য বলে অভিহিত করা হয়।
লিঙ্গ সাম্য কাকে বলে?
লিঙ্গ সাম্য: লিঙ্গ সাম্য বলতে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থাৎ অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকারকে বোঝানো হয়। প্রভৃতি ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান সুযোগ ও অংশগ্রহণকে সুনিশ্চিত করাই হল লিঙ্গ সাম্য। নারীবাদীরা লিঙ্গ সাম্যকে মৌলিক মানবাধিকার বলে ঘোষণা করেছেন।
রাজনৈতিক সাম্য বলতে কী বোঝ?
রাজনৈতিক সাম্য: রাজনৈতিক সাম্য বলতে রাজনৈতিক অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে সকলের সমানাধিকারকে বোঝায়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বংশমর্যাদা, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের সরকার গঠন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ, সরকারকে সমালোচনা প্রভৃতি ক্ষেত্রে সমান অধিকারকে রাজনৈতিক সাম্য বলে। উদারনৈতিক গণতন্ত্রে রাজনৈতিক সাম্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
অর্থনৈতিক সাম্য কাকে বলে?
অর্থনৈতিক সাম্য: অর্থনৈতিক সাম্য বলতে আয় ও সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠাকে বোঝায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অর্থনৈতিক সাম্য বলতে সম্পত্তি অর্জনের ক্ষেত্রে সমানাধিকারকে বোঝায় না। কারণ এই ধরনের অধিকার সমাজে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে অসাম্যকেই ডেকে আনে। তাই ল্যাস্কি (Laski) সকলের সমপরিমাণ সম্পদ রাখার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
আইনগত সাম্য বলতে কি বোঝায়?
আইনগত সাম্য: উদারবাদী দর্শনে আইনগত সাম্য (Legal Equality) প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আইনি সাম্যের অধীনে প্রধান দুটি বিষয় হল- আইনের দৃষ্টিতে সমতা (Equality Before Law), ও আইন কর্তৃক সমভাবে রক্ষিত হওয়ার অধিকার (Right to Equal Protection of Law)। এই দুই অধিকারকে একত্রে আইনগত সাম্য (Legal Equality) বলে অভিহিত করা হয়। আইনের দৃষ্টিতে সমতার অর্থ হল ধনী-দরিদ্র, শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্বিশেষে সব নাগরিক আইনের চোখে সমান।
অন্যদিকে, আইন কর্তৃক সমভাবে রক্ষিত হওয়ার অর্থ হল আইনের মাধ্যমে সকল নাগরিকের সমান সুরক্ষা। এটি ইতিবাচক সাম্য হিসেবে পরিচিত। কারণ এর দ্বারা ব্যক্তি রাষ্ট্রের কাছ থেকে ইতিবাচক পদক্ষেপের প্রত্যাশা করে।
অর্থনৈতিক সাম্যের গুরুত্ব সংক্ষেপে লেখো।
অর্থনৈতিক সাম্যের গুরুত্ব: অধ্যাপক হ্যারল্ড ল্যাস্কি তাঁর ‘A Grammar of Politics’ গ্রন্থে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, অর্থনৈতিক সাম্য না থাকলে রাজনৈতিক সাম্যের কোনো মূল্য নেই। তাই দুটি ধারণা কখনোই পরস্পরের বিরোধী নয়। মার্কসবাদীরাও এই অভিমত প্রকাশ করেন যে, ধনবৈষম্যমূলক সমাজে অর্থনৈতিক সাম্য না থাকায় রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা নিতান্তই মূল্যহীন হয়ে দাঁড়ায়।
এরূপ সমাজে আইন যেহেতু কতিপয় ব্যক্তির স্বার্থরক্ষার যন্ত্র হিসেবে কাজ করে, সেহেতু এই আইন শ্রমজীবী মানুষদের আর্থিক স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করতে পারে না। তাই, মার্কসীয় তত্ত্বে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্তরূপে অর্থনৈতিক সাম্যের কথা বলা হয়। তাই মার্কসবাদীদের মতে, শ্রেণিহীন, শোষণহীন সমাজেই সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পরের পরিপূরকরূপে কাজ করতে পারবে।
সংরক্ষণমূলক বৈষম্য বলতে কী বোঝো?
সংরক্ষণমূলক বৈষম্য: সামাজিক বৈষম্য বলতে অধিকার বা অন্য কোনো ক্ষেত্রে সামাজিক অসাম্যতাকে বোঝায়। রাষ্ট্র যখন কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব করে তখন বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। সংরক্ষণমূলক বৈষম্য বলতে কোনো বিশেষ সম্প্রদায় বা জাতির প্রতি রাষ্ট্রের বিশেষ সুযোগসুবিধা প্রদানকে বোঝায়। ভারতেও এই নীতিটি বিদ্যমান। একে ইতিবাচক বৈষম্য (Affirmative Discrimination) বলা হয়ে থাকে।
সাম্য ও স্বাধীনতার মধ্যে সম্পর্ক কী?
সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্ক: সাম্য ও স্বাধীনতা দুটিই হল আইনগত ধারণা। রাষ্ট্র আইনের সহায়তায় স্বাধীনতা ও সাম্যের ধারণাকে বাস্তবায়িত করে। উভয় ধারণাই ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তার বিকাশের সঙ্গে জড়িত। স্বাধীনতা বলতে একটি সামাজিক পরিবেশের সযত্নে সংরক্ষণকে বোঝায়। বলা বাহুল্য, এই সামাজিক পরিবেশ আসলে সাম্যের পরিবেশকেই বোঝায়। সুতরাং সাম্য ও স্বাধীনতার ধারণা কার্যত পরস্পরের পরিপূরক। কারণ, সাম্য ও স্বাধীনতা উভয়েই মানুষের আত্মবিকাশে সহায়তা করে, তাই সাম্য ও স্বাধীনতা একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কযুক্ত। অধ্যাপক ল্যাস্কি-র মতে, “জনগণের কোনো স্বাধীনতা থাকতে পারে না, যদি বিশেষ সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা না থাকে”। অর্থাৎ সকলে সমান সুযোগ পেলে তবেই স্বাধীনতা সম্ভব হবে।
সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পরের পরিপূরক বলে মনে করেন এমন কয়েকজন তাত্ত্বিকের নাম লেখো।
সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পর পরিপূরক: সাম্য ও স্বাধীনতার দাবিটি প্রথম উচ্চারিত হয় ফরাসি বিপ্লবের সময়কালে। তাই বলা যায়, দুটি ধারণাই এই ঘোষণাপত্রদ্বয়ের মাধ্যমেই পরস্পরের পরিপূরক রূপে বিবেচিত হয়। কোনো কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সাম্য ও স্বাধীনতাকে পরস্পরের পরিপূরক বলে মনে করেন। যেমন-ল্যাস্কি, রুশো, বার্কার, টনি প্রমুখ এবং মার্কসবাদী তাত্ত্বিকগণ সাম্য ও স্বাধীনতার ধারণাকে পরস্পরের পরিপূরক বলার পক্ষপাতী। আধুনিককালে বিংশ শতাব্দীর চিন্তাবিদরা যেমন হবহাউস, পোলার্ড, মেইটল্যান্ড ও গডউইন প্রমুখরাও সাম্য ও স্বাধীনতাকে একে অপরের পরিপূরক বলে মনে করেন।
সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পরবিরোধী বলে মনে করেন এমন কয়েকজন তাত্ত্বিকের নাম লেখো।
সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পরবিরোধী: সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্ক নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্যের শেষ নেই। কোনো কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সাম্য ও স্বাধীনতাকে পরস্পরের পরিপূরক বলে উল্লেখ করেছেন। আবার কেউ কেউ এই দুটি ধারণাকে পরস্পরবিরোধী ধারণা বলে মনে করেন। যেমন- লর্ড অ্যাক্টন, টকভিল, হার্বার্ট স্পেনসার প্রমুখ তাত্ত্বিকেরা সাম্য ও স্বাধীনতাকে পরস্পরবিরোধী ধারণা হিসেবে উল্লেখ করার পক্ষপাতী।
অধ্যাপক বার্কারের মতে সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্ক লেখো।
বার্কারের মতে সাম্য ও স্বাধীনতা: অধ্যাপক বার্কার সাম্য ও স্বাধীনতার পারস্পরিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে বলেছেন, সাম্য বা স্বাধীনতা একে অপরের পরিপূরক। এটি একটি অভিন্ন ধারণা। তাঁর মতে, আইনগত সাম্যের পূর্বে সমাজে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করা উচিত। কারণ অর্থনৈতিক সাম্য সমনাগরিকতার আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে।
সাম্য ও স্বাধীনতার পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে জন স্টুয়ার্ট মিলের মতামত ব্যক্ত করো।
মিলের অভিমত: জন স্টুয়ার্ট মিল তাঁর ‘On Liberty’ গ্রন্থে স্বাধীনতাকে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, সমাজ কল্যাণের দৃষ্টিতে স্বাধীনতাকে বিচার করার চেষ্টা করলে সাম্যকে উপলব্ধি করা সম্ভব হয়। তিনি আরও বলেছেন যে, স্বাধীনতা কখনোই স্বেচ্ছাচারের নামান্তর নয়। মিল সাম্য ও স্বাধীনতাকে পরস্পরের পরিপূরক বলার পক্ষপাতী।
‘সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পরের পরিপূরক- এপ্রসঙ্গে দুটি যুক্তি দাও।
সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পরের পরিপূরক কি না তা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। ল্যাস্কি, রুশো, বার্কার, টনি প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সাম্য ও স্বাধীনতাকে পরস্পরের পরিপূরক বলে অভিহিত করে কতগুলি যুক্তির অবতারণা করেছেন। এর মধ্যে দুটি যুক্তি হল-
- সাম্য ও স্বাধীনতার পরিবেশে ব্যক্তিদের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটবে এবং একই সঙ্গে ব্যক্তির সমাজবোধও জাগ্রত হবে। ফলে সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পরের পরিপূরক।
- অধ্যাপক ল্যাস্কি-র মতে, সাম্য ও স্বাধীনতার আদর্শ সমাজে মানুষের জীবনের সৃজনশীলতাকে কার্যকর করে। তিনি আরও বলেন যে, সাম্য ছাড়া স্বাধীনতার অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না।
‘সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পরের পরিপূরক’-এর বিপক্ষে দুটি যুক্তি দাও।
লর্ড অ্যাক্টন, টকভিল, হার্বার্ট স্পেনসার প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সাম্য ও স্বাধীনতাকে পরস্পরবিরোধী ধারণা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এর বিপক্ষে তারা কিছু যুক্তি দিয়েছন। এর মধ্যে দুটি যুক্তি হল-
বিপক্ষে যুক্তি: সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের স্বার্থে ব্যক্তিবিশেষের স্বাধীনতা অনিয়ন্ত্রিত হতে পারে না।
লর্ড অ্যাক্টন তাঁর লেখা Lecture on Liberty তে বলেছেন, সাম্য অর্জনের অধীর ইচ্ছাই স্বাধীনতার আশাকে ব্যর্থ করে।
ন্যায় কী?
ন্যায়: ন্যায় বা Justice হল রাষ্ট্রতত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি হল একটি নৈতিক ধারণা, এমন একটি বন্ধন যা সমাজকে একসূত্রে বেঁধে রাখে। ন্যায় হল চরম সত্য, বিশুদ্ধতা ও পরিপূর্ণতার প্রতীক। কারণ এর সঙ্গে সততা ও নৈতিকতা, আদর্শবোধ এবং বিশুদ্ধতার মতো ধারণাগুলি বর্তমান। ন্যায়ের ধারণা সদা পরিবর্তনশীল।
আর্নেস্ট বার্কার ন্যায় বলতে কী বুঝিয়েছেন?
বার্কারের মতে ন্যায়: আর্নেস্ট বার্কার তাঁর Principles of Social and Political Theory গ্রন্থে ন্যায়ের আলোচনা করেছেন। বার্কার ন্যায়কে ‘একটি সমন্বয়ী শব্দ’ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। মনুষ্য সম্পর্কের একটি সংগঠিত ব্যবস্থার মধ্যে মানুষের সঙ্গে মানুষের এবং সমন্বিত মূল্যবোধের সঙ্গে মূল্যবোধের সামঞ্জস্যবিধানকে ন্যায় বলে চিহ্নিত করা যায়। তাঁর মতে, ন্যায় হল সেই নীতি যা ব্যক্তিত্বের মহত্তম বিকাশ সাধনের লক্ষ্যে নিয়োজিত। তাঁর মতে, ব্যক্তির অধিকার বণ্টনের ক্ষেত্রে যে তিনটি নীতি কার্যকর, সেই সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার নীতিকে সমন্বিত করে যে নীতি, তাই হল ন্যায়। তিনি ন্যায়কে সামাজিক বাস্তবতা বলেও উল্লেখ করেছেন।
জন রল্স-এর ন্যায় সম্পর্কিত নীতিগুলি উল্লেখ করো।
রলসের অভিমত: ন্যায়বিচারের আধুনিক ভাবনার পরিচয় পাওয়া যায় জন রলসের তত্ত্বে। তিনি A Theory of Justice নামক গ্রন্থে ন্যায়বিচারের তত্ত্বটি প্রকাশ করেন। জন রলস ন্যায় বলতে এমন এক ন্যায্যতার নীতিকে বুঝিয়েছেন, যা মৌলিক দুটি নীতির প্রতি সংবেদনশীল হবে। এই নীতি দুটি হল-
[1] প্রথম নীতি: অন্যান্য ব্যক্তির ব্যাপক মৌলিক স্বাধীনতার সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখেই প্রত্যেক ব্যক্তির সমতুল্য স্বাধীনতার সমান অধিকার থাকবে।
[2] দ্বিতীয় নীতি: প্রথমত, সামাজিক ও আর্থিক অসাম্যকে এমনভাবে ব্যবস্থাপন করতে হবে, যাতে তা সকলের সুবিধার্থে কাজ করে এবং বিশেষভাবে সবচেয়ে কম সুবিধাভোগী ব্যক্তিসমূহের কল্যাণে লাগে। দ্বিতীয়ত, সামাজিক ও আর্থিক অসাম্যের ব্যবস্থাপনা এমনভাবে হবে, যাতে মর্যাদা ও চাকুরি লাভের ক্ষেত্রে সকলে ন্যায্য সমসুযোগ লাভ করতে পারে।
রলসের ‘ম্যাক্সিমিন’ নীতিটি আলোচনা করো।
রলসের ম্যাক্সিমিন নীতি: রলসের ম্যাক্সিমিন নীতিটির প্রথম অংশের মূল কথা হল- অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যকে এমনভাবে বিন্যস্ত করতে হবে, যাতে সমাজের সর্বাপেক্ষা কম সুবিধাপ্রাপ্তরা সর্বাপেক্ষা বেশি সুবিধা লাভ করতে পারে। অপরদিকে, দ্বিতীয় অংশের মূল কথা হল- অর্থনৈতিক ও সামাজিক অসাম্যের যুক্তিসংগত বিন্যাসের উপর নির্ভর করে সমান সামর্থ্যযুক্ত ও দক্ষতাসম্পন্ন সকল মানুষই যে-কোনো পদমর্যাদার সুযোগসুবিধা লাভ করতে পারবে।
রলস-এর পার্থক্যের নীতি’ কী?
রলসের পার্থক্যের নীতি: জন রলস ন্যায়বিচারের তত্ত্বটির ক্ষেত্রে তিনটি নীতির কথা উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে একটি নীতি হল ‘পার্থক্যের নীতি’। পার্থক্যের নীতি বলতে, ন্যায়বিচারের স্বার্থে সামাজিকভাবে দুর্বলতর ব্যক্তি বা শ্রেণির জন্য বিশেষ অধিকার বা বিশেষ ব্যবস্থার সংস্থানকে বোঝায়। রলসের মতে, এই নীতি ন্যায়বিচারের পরিপন্থী নয়। বরং এই নীতির মাধ্যমে সমাজের অনগ্রসর ও দুর্বল শ্রেণিগোষ্ঠীর লোকেরা অন্যদের সঙ্গে একই সারিতে উন্নীত হতে পারবে।
প্লেটোর মতে ন্যায় কী?
প্লেটোর অভিমত: গ্রিক পন্ডিত প্লেটো-র মতে, ন্যায় হল সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সমন্বয়সাধন। তিনি তাঁর রিপাবলিক গ্রন্থে ন্যায়ের তত্ত্বটি প্রকাশ করেন। তাঁর মতে, প্রত্যেকে যদি তার দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করে এবং কাজের ভিত্তিতে যদি তার সামাজিক অবস্থান নির্ধারিত হয় এবং সেই সামাজিক অবস্থানে যদি ঐ ব্যক্তি সন্তুষ্ট থাকে অর্থাৎ অন্যের কাজে হস্তক্ষেপ না করে, তবেই সমাজে সমন্বয়সাধন সম্ভব। এইভাবে সমন্বয়সাধন করতে পারলেই ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে।
মার্কসীয় দর্শনে ন্যায় বলতে কী বোঝায়?
মার্কসীয় দর্শনে ন্যায়: উনবিংশ শতাব্দীতে মার্কসীয় দর্শনে অর্থনৈতিক শোষণ ও আধিপত্যের প্রেক্ষিতে ‘ন্যায়’-এর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। মার্কস মনে করতেন পুঁজিবাদী সমাজে ন্যায়ের ধারণা অপ্রাসঙ্গিক। কারণ এখানে বণ্টনমূলক ন্যায়ের মাধ্যমে কখনোই শ্রেণিশোষণ বন্ধ করা যায় না। কারণ অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রভুত্বকারী বুর্জোয়াশ্রেণির স্বার্থে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালিত হয়। তাই, একমাত্র উৎপাদনের উপাদানগুলির উপরে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হলে, শোষকশ্রেণির অবলুপ্তি ঘটবে এবং মানুষের জন্য ন্যায়ের ধারণাটি বাস্তবায়িত হবে। মার্কসীয় দর্শনে ন্যায় শ্রেণিসংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত।
ন্যায় শব্দটি কোন্ কোন্ শব্দ থেকে উদ্ভুত?
ন্যায় শব্দটির উদ্ভব: অধ্যাপক বার্কার-এর মতে, ন্যায় শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ Jus (জাস), Justus (জাস্টাস) ও Justitia (জাস্টিসিয়া) থেকে। এই শব্দযুগলের অর্থ হল সংযোগসাধন, মিলন। বার্কার ন্যায়বিচারকে একটি সমন্বয়সাধনকারী ধারণা (A Term of Synthesis) বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, ন্যায় হল এমন একটি মূল্যবোধ যার মধ্যে অন্যান্য রাজনৈতিক মূল্যবোধের সমন্বয় সাধিত হয়েছে।
ন্যায় সম্পর্কে ইমানুয়েল কান্ট-এর বক্তব্য কী?
ইমানুয়েল কান্ট এর ন্যায়তত্ত্ব: জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের ন্যায়তত্ত্বটি তাঁর বৃহত্তর নৈতিক ও রাজনৈতিক দর্শনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তিনি তাঁর ‘দ্য মেটাফিজিক্স অফ মরালস্’ গ্রন্থে ন্যায়বিচার তত্ত্বটির ব্যাখ্যা করেছেন। কান্টের ন্যায়তত্ত্বটির কেন্দ্রবিন্দু হল ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারণা। তাঁর মতে, ব্যক্তির নিজের ইচ্ছানুযায়ী কাজ করাকেই স্বাধীনতা বলে। কান্টের মতে, সমাজে ন্যায় তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে যখন সমাজ ব্যক্তির স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতাকে সম্মান ও সমর্থন করবে।
ন্যায়ের ধারণার উৎসগুলি উল্লেখ করো।
ন্যায়ের উৎস: অধ্যাপক আর্নেস্ট বার্কার তাঁর ‘Principles of Social and Political Theory’ গ্রন্থে ন্যায়ের ধারণাটির অবতারণা করেন। তাঁর মতে, ন্যায়ের ধারণাটি একটি সমন্বয়সাধনকারী ধারণা। ন্যায় সম্পর্কে চারটি উৎসের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। যথা- ধর্ম (Religion), প্রকৃতি (Nature), অর্থনীতি (Economy) এবং নীতিশাস্ত্র (Ethics)।
সর্বপ্রথম কোথায় ন্যায়ের ধারণাটির উল্লেখ পাওয়া যায়?
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ন্যায়ের ধারণাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। এই ধারণাটিকে গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গঠনের ফলে অত্যন্ত অপরিহার্য বলে মনে করা হয়। ন্যায় হল মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক স্থাপন বা মূল্যবোধের সঙ্গে মূল্যবোধের সামঞ্জস্যবিধান। প্রাচীনকাল থেকেই সমাজে ন্যায়ের ধারণাটি বিদ্যমান ছিল। সর্বপ্রথম গ্রিক পণ্ডিত পিথাগোরাসের অনুগামীদের রচনায় ন্যায়ের ধারণাটির উল্লেখ পাওয়া যায়।
সাধারণত ন্যায় কত প্রকার ও কী কী?
ন্যায়ের প্রকারভেদ: প্রাচীনকাল থেকেই সমাজে ন্যায়ের ধারণাটি প্রচলিত ছিল। পিথাগোরাসের অনুগামীদের রচনায় সর্বপ্রথম ন্যায়ের ধারণাটির উল্লেখ পাওয়া যায়। তখন থেকে আজ পর্যন্ত ন্যায়ের ধারণাটি ক্রমশ পরিবর্তিত হয়েছে। তার উপর ভিত্তি করেই সাধারণ ন্যায়ের ধারণাটির শ্রেণিবিভাগ করা যায়। সাধারণত ন্যায় চার প্রকার যথা- আইনগত ন্যায়, রাজনৈতিক ন্যায়, সামাজিক ন্যায় এবং অর্থনৈতিক ন্যায়।
আইনগত ন্যায় বলতে কী বোঝো?
আইনগত ন্যায়: আইনগত ন্যায় বলতে সেইরূপ ন্যায়ব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে মানুষের মধ্যে সঠিক সম্পর্ক স্থাপনের সহায়ক, শাসনতান্ত্রিক বিধির নির্দেশে যার সৃষ্টি এবং যা কতগুলি বাস্তব নিয়মকে সংঘবদ্ধ করে। বস্তুত ‘আইনের চোখে সবাই সমান’ এবং ‘আইন কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষণ’ নীতির বাস্তবায়নের মাধ্যমেই আইনগত ন্যায় প্রতিষ্ঠা সম্ভব। আইনগত ন্যায়ের ক্ষেত্রে দুটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। যথা- ন্যায় অনুসারে আইন এবং আইন অনুসারে ন্যায়।
আইনগত ন্যায়ের কয়টি উপাদান আছে ও কী কী?
আইনগত ন্যায়ের দুটি উপাদান। যথা- আইনানুসারে ন্যায় (Justice according to Law)-এর অর্থ হল আইনের মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ আইনের সাহায্য নিয়ে ন্যায় স্থাপন করা। ন্যায় অনুসারে আইন (Law according to Justice)- এর অর্থ হল আইনকে ন্যায়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হতে হবে। এক্ষেত্রে আইনের মূল বিষয় ন্যায়ের ধারণার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কি না সেটি বিচার করে নিতে হবে।
জাস্টিনিয়ান ইনস্টিটিউট এর মতে ন্যায় কী?
জাস্টিনিয়ান ইনস্টিটিউটে ন্যায়ের তিনটি কাজের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলির মধ্য দিয়ে সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়। সেগুলি হল-
- নিজের সামাজিক মর্যাদা অনুসারে জীবনযাপন।
- অন্যের সামাজিক মর্যাদার ক্ষতিসাধন না করা।
- অন্যের সামাজিক মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা।
ন্যায়ের দুটি উৎসের বর্ণনা দাও।
অধ্যাপক আর্নেস্ট বার্কার ন্যায়ের উৎস আলোচনা প্রসঙ্গে চারটি উৎসের অবতারণা করেছেন। যেমন- ধর্ম, প্রকৃতি, অর্থনীতি ও নীতিশাস্ত্র। এর মধ্যে দুটি উৎস আলোচনা নিম্নরূপ-
ধর্ম: মধ্যযুগের ধর্মযাজকরা মনে করতেন, ঈশ্বর সাধনার মধ্য দিয়েই মানুষের মনে ন্যায়ের ধারণাটির বিকাশ ঘটেছে। তাই তারা ধর্মকে ন্যায়ের একটি উৎস বলে মনে করতেন।
প্রকৃতি: স্টোয়িক দার্শনিকণ থেকে শুরু করে চুক্তিবাদী দার্শনিকরা প্রকৃতিকে ন্যায়ের একটি উৎস বলে মনে করতেন। কারণ, তাঁরা প্রকৃতি বলতে একটি নীতিকে চিহ্নিত করেছেন, যার দ্বারা বিশ্বসংসার নিয়ন্ত্রিত হয় বলে দাবি করা যায়।
রাজনৈতিক ন্যায় বলতে কী বোঝো?
রাজনৈতিক ন্যায়: সাধারণভাবে রাজনৈতিক ন্যায় বলতে বোঝায়, দেশের রাজনৈতিক জীবনে জনগণের স্বাধীন ও সংগত অংশগ্রহণ। রাজনৈতিক ন্যায়ের মূল কথা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সাম্যের মধ্যেই নিহিত থাকে। সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার, বাক্ ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, অন্যান্য সরকারি নীতি ও কার্যকলাপে বিরোধিতা করার অধিকার প্রভৃতি ছাড়া রাজনৈতিক ন্যায়ের তত্ত্ব বাস্তবায়িত হতে পারে না।
রাজনৈতিক ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার দুটি আবশ্যিক শর্ত লেখো।
শর্ত: ব্যাপক অর্থে রাজনৈতিক ন্যায় বলতে সামগ্রিকভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বীকৃতি ও সংরক্ষণকে বোঝায়। রাজনৈতিক ন্যায়ের প্রধান লক্ষ্য হল-জনগণের ইচ্ছানুসারে রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতিষ্ঠা ও জনমতের অনুগামী শাসকগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠা। এর উপর ভিত্তি করেই রাজনৈতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার কতগুলি শর্তের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।
সামাজিক ন্যায় বলতে কী বোঝো?
সামাজিক ন্যায়: সামাজিক ন্যায় হল একটি আদর্শগত ধারণা। এর উদ্দেশ্য হল ন্যায়সংগত সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনসাধারণের সর্বাঙ্গীন কল্যাণসাধন করা। ব্যাপক অর্থে সামাজিক ন্যায় বলতে ব্যক্তির স্বার্থ ও জনগণের সামাজিক স্বার্থের মধ্যে সামঞ্জস্যবিধানকে বোঝায়। সাধারণভাবে ব্যক্তির অধিকার ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করাকেই সামাজিক ন্যায় বলা হয়। একথা অনস্বীকার্য যে, বৈষম্যমূলক সমাজে কখনো সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।
অর্থনৈতিক ন্যায় বলতে তুমি কী বোঝো?
অর্থনৈতিক ন্যায়: সাধারণভাবে অর্থনৈতিক ন্যায় বলতে উৎপাদন ও বণ্টনের ক্ষেত্রে প্রত্যেকের জন্য স্বাধীনতাকে বোঝায়। এইরূপ ন্যায় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে সকল ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বৈষম্যের অবসান ঘটবে এবং সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। মার্কসবাদীদের মতে, একমাত্র ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসানের ভিত্তিতেই সমাজে অর্থনৈতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা হবে।
উদারনৈতিক ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক ন্যায় বলতে কী বোঝায়?
আর্নেস্ট বার্কার-কে উদারনৈতিক ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য প্রবক্তা রূপে মনে করা হয়। তাঁর মতে, ন্যায়ের একটি বাস্তব ভিত্তি রয়েছে। এটি কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়। উদারনৈতিক ব্যবস্থায় প্রত্যেকের জীবনযাত্রার ন্যূনতম মান ও ধনবৈষম্যের হ্রাস, সমান পারিশ্রমিকের অধিকার, অর্থনৈতিক শোষণের অবসান, ন্যূনতম মজুরি, দরিদ্রের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা, অবসরের অধিকার প্রভৃতিকে অর্থনৈতিক ন্যায় বলা হয়।
অ্যারিস্টট্ল কয় ধরনের ন্যায় প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন ও কী কী ?
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টট্ল ন্যায় বলতে মহত্ত্বের সামগ্রিক প্রকাশকে বুঝিয়েছেন। তিনি সমাজে তিন ধরনের ন্যায় প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। যথা- বণ্টনমূলক ন্যায়, সংশোধনমূলক ন্যায় এবং বিনিময় সংক্রান্ত ন্যায়।
- বণ্টনমূলক ন্যায়: বণ্টনমূলক ন্যায় বলতে তিনি বুঝিয়েছেন, সমাজের সকলের মধ্যে সমানসুযোগ সুবিধার বণ্টনকে।
- সংশোধনমূলক ন্যায়: সংশোধনমূলক ন্যায় বলতে ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদার ক্ষতিসাধন হলে তা সংশোধন করে দেওয়াকে বোঝায়।
- বিনিময় সংক্রান্ত ন্যায়: বিনিময় সংক্রান্ত ন্যায় বলতে কোনো পরিসেবা বিনিময় বা অন্য পরিসেবা গ্রহণের আনুগত্যকে বোঝায়।
বণ্টনমূলক ন্যায় বলতে কী বোঝো?
বণ্টনমূলক ন্যায়: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টট্ল ন্যায়ের ধারণাটি শ্রেণিবিভাগ করতে গিয়ে তিন প্রকার ন্যায়ের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন- বণ্টনমূলক ন্যায়, সংশোধনমূলক ন্যায় ও বিনিময় সংক্রান্ত ন্যায়। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রের নাগরিকদের প্রত্যেকে যখন প্রাপ্য সুযোগ ও সম্মান এবং প্রাপ্য অংশ লাভ করে, তখন তাকে বণ্টনমূলক ন্যায় বলে। বণ্টনমূলক ন্যায় সংক্রান্ত তাঁর বিখ্যাত নীতিটি হল সমানদের সঙ্গে সমআচরণ এবং অসমদের সঙ্গে অসম আচরণ।
সংশোধনমূলক ন্যায় বলতে কী বোঝো?
সংশোধনমূলক ন্যায়: গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টট্ল ন্যায়ের সংশোধনমূলক ধারণাটির অবতারণা করেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েনে অনেকসময় অনিচ্ছাকৃতভাবে নাগরিকদের ব্যক্তিগত ক্ষতি এবং সামাজিক মর্যাদাহানি ঘটে। এইরূপ পরিস্থিতিকে সংশোধন করে দেওয়াকেই সংশোধনমূলক ন্যায় বলা হয়। রাষ্ট্র এইরূপ দায়িত্ব পালন করলে সমাজে সংশোধনমূলক ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়।
বিনিময় সংক্রান্ত ন্যায় বলতে কী বোঝো?
বিনিময় সংক্রান্ত ন্যায়: গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টট্ল বিনিময় সংক্রান্ত ন্যায়ের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, যে কোনো দ্রব্য বা বস্তু ক্রয়-বিক্রয়কালে বা স্বেচ্ছায় রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে আদান-প্রদান করা কিংবা কোনো পরিসেবার বিনিময় অন্য পরিসেবা গ্রহণের আনুগত্যকে বিনিময় সংক্রান্ত ন্যায় বলে।
ন্যায়ের প্রকৃতি সম্পর্কে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি কী?
মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি: কার্ল মার্কস তাঁর The Critique of the Gotha Programme নামক গ্রন্থে ন্যায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে, ধনবৈষম্যমূলক সমাজে বণ্টনমূলক ন্যায়ের মাধ্যমে কখনোই সামাজিক শ্রেণিশোষণ বন্ধ করা যায় না। মার্কসীয় ন্যায়ের ধারণা সমাজে বিদ্যমান উৎপাদন পদ্ধতিও শ্রেণি কাঠামোর সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। কার্ল মার্কস মনে করতেন, একমাত্র সাম্যবাদী সমাজে ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
ন্যায়বিচার কাকে বলে?
ন্যায়বিচার: সর্বপ্রথম গ্রিক দার্শনিকগণ যথা-সক্রেটিস, সফোক্লিস প্রমুখের রচনার ন্যায়বিচার ধারণাটির উদ্ভব ঘটে। প্লেটো-র ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে ন্যায়বিচার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে গণ্য হয়। সমাজে বসবাসকারী নাগরিকগণ যখন তাদের ন্যায্য প্রাপ্য পায়, তখন তাকে ন্যায়বিচার বলে। রাষ্ট্র যখন নাগরিকদের ন্যায্য প্রাপ্য সকলের মধ্যে বণ্টন করে দেয় তখন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়।
জন রলসের ন্যায়বিচারের তত্ত্বটি লেখো।
রলসের ন্যায়বিচার তত্ত্ব: জন রল্স তাঁর ‘A Theory of Justice’ গ্রন্থে ন্যায়বিচারের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এক নতুন ধারণার অবতারণা করেন। তিনি ন্যায়বিচারকে ক্ষমতা, সুযোগসুবিধা, অধিকার, স্বাধীনতা, আত্মমর্যাদা, আয় ও সম্পদের মতো প্রাথমিক সামগ্রীর ন্যায্য বণ্টন বলে অভিহিত করেন। তাঁর মতে, সমবণ্টন হল ন্যায়বিচারের প্রধান উৎস।
তিনি হলেন ন্যায়ের আধুনিক ধারণার প্রবক্তা। তিনি বলেন, সমস্ত সামাজিক মূল্যবোধ, স্বাধীনতা ও সুযোগ, আয় ও সম্পত্তি এবং আত্মমর্যাদার ভিতকে সমভাবে বণ্টন করতে হবে, যদি না এই সমস্ত মূল্যবোধগুলির কোনো একটি বা সবগুলির অসম বন্টন সবার সুবিধার্থে হয়। রলস ন্যায্যতা (Faimess)-কেই ন্যায় হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। তাঁর ন্যায় তত্ত্বের মাধ্যমে তিনি একটি সাধারণ নীতির অবতারণা করেছেন, যে নীতিতে তিনি যুক্তিসংগত কারণে সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে বৈষম্যকে সমর্থন করেছিলেন।
ফ্রেডারিখ হায়েকের ন্যায়বিচারের তত্ত্বটি লেখো।
হায়েকের ন্যায়বিচার তত্ত্ব: ফ্রেডারিখ হায়েক তাঁর The Constitution of Liberty (১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ) গ্রন্থটিতে ন্যায়বিচারের তত্ত্বটি প্রকাশ করেন। তাঁর মতে, কোনো ব্যক্তি নিজের কল্যাণের জন্য যা চায় বা তাকে যে স্বাধীনতা দেওয়া হয় তা-ই হল ন্যায়বিচার। তিনি বলেন সামাজিক মঙ্গলের পরিবর্তে ব্যক্তির মঙ্গল করাই ন্যায়বিচারের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। তাঁর এই বক্তব্য থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, তিনি সামাজিক ন্যায়বিচারের পক্ষপাতী ছিলেন না।
রবার্ট নোজিকের ন্যায়বিচার তত্ত্বটি লেখো।
রবার্ট নজিক এর ন্যায়বিচার তত্ত্ব: রবার্ট নোজিক (Robert Nozick) তাঁর Anarchy, State and Utopia গ্রন্থে ন্যায়বিচারের তত্ত্বটি উপস্থাপন করেন। তিনি ছিলেন বাজার অর্থনীতির সমর্থক। তাঁর মতে ব্যক্তি হিসেবে একজন মানুষের জন্মানোর পর থেকেই কিছু স্বত্ত্বাধিকার জন্মায়। এই অধিকারগুলি সংরক্ষণ করাকেই ন্যায়বিচার বলা হয়। অর্থাৎ, ব্যক্তি যাতে তার অধিকারগুলি বিনা বাধায় ভোগ করতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখাই হল ন্যায়বিচার। রবার্ট নোজিক পদ্ধতিগত ন্যায়ের তত্ত্বটি প্রচার করেছিলেন। তিনি আরও বলেন, ব্যক্তির সৎ উপায়ে কষ্টার্জিত সম্পত্তির উপর তার নিজের দাবি থাকা আবশ্যক। ব্যক্তির অর্জিত অর্থ থেকে প্রাপ্ত মুনাফা, রাষ্ট্র জনসাধারণের মধ্যে পুনর্বণ্টন ঘটালে তা ন্যায় প্রতিষ্ঠার পথে কাঁটা তৈরি করবে। তাই নোজিক ন্যূনতম রাষ্ট্র-এর পক্ষপাতী ছিলেন।
ন্যায় ও সাম্যের পারস্পরিক সম্পর্কটি কী?
ন্যায় ও সাম্যের সম্পর্ক: গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। অধ্যাপক ল্যাস্কি ন্যায় ও সাম্যের সম্পর্কটির মধ্যে কোনো বিভেদ করেননি। তিনি বলেছেন, আধুনিক রাষ্ট্রে বৈষম্যকে বজায় রেখে প্রকৃত ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তাই সাম্য ও সমানাধিকার না থাকলে সমাজে কখনোই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। তাই জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে একমাত্র সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
সাম্য ও ন্যায়ের সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে প্লেটোর অভিমত লেখো।
প্লেটোর মতে সাম্য ও ন্যায়: সাম্য ও ন্যায় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দুটি স্তম্ভস্বরূপ। গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে গেলে সর্বপ্রথম ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্লেটো সাম্য ও ন্যায়ের সম্পর্কের ভিত্তিতে বলেছেন, নৈতিক ভাবনারূপে ন্যায়ের সঙ্গে কর্তব্যের সম্পর্ক থাকলেও সাম্যের তত্ত্ব এখানে সরাসরি আসেনি। তাঁর মতে, সাম্যের মাধ্যমে ন্যায়ের প্রচার ঘটেনি।
সাম্য ও ন্যায়ের সম্পর্কের ভিত্তিতে বার্কারের অভিমত লেখো।
বার্কারের মতে সাম্য ও ন্যায়: অধ্যাপক বার্কার সাম্য ও ন্যায়কে পরস্পরের পরিপূরক বলে মনে করেন। তাঁর মতে, একমাত্র সাম্যভিত্তিক সমাজেই ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। বৈষম্যমূলক সমাজে ন্যায়ের কোনো স্থান নেই। একমাত্র আইনগত সাম্যকে কেন্দ্র করেই সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ সাম্য ছাড়া ন্যায়ের অস্তিত্বকে কল্পনা করা যায় না।
সাম্য ও ন্যায়ের সম্পর্কে ল্যাস্কির অভিমত লেখো।
ল্যাস্কির মতে সাম্য ও ন্যায়: অধ্যাপক ল্যাস্কি ন্যায় ও সাম্যের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করেননি। তিনি সমাজের সম্পদ বণ্টনের উপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন যে, উদ্বৃত্ত উৎপাদন যদি সমভাবে বণ্টিত হয়, তবে সাম্যের সঙ্গে ন্যায়ের কোনো পার্থক্য থাকবে না। অর্থাৎ তিনি অর্থনৈতিক সাম্যের সঙ্গে ন্যায়ের পারস্পরিক সম্পর্ককে বুঝিয়েছেন।
জন রলসের মতে সাম্য ও ন্যায়ের সম্পর্ক কী?
জন রলসের মতে সাম্য ও ন্যায়: আধুনিক নয়া সমতাবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন রলস তাঁর ন্যায় তত্ত্বে সকলের জন্য মৌলিক স্বাধীনতা এবং সকলের সুযোগের ন্যায্য সমতা এই দুটি নীতির সাহায্যে সাম্য ও ন্যায়ের বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর ন্যায়তত্ত্বে তিনি স্বাধীনতা ও সুযোগ, আয় ও সম্পদ এবং আত্মমর্যাদার মতো সামাজিক মূল্যবোধগুলিকে সমবন্টনের কথা বলেন। তিনি বলেছেন সমাজে সাম্য থাকলে তবেই ন্যায় প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি (Separation of Power) বলতে কী বোঝায়?
ফরাসি চিন্তাবিদ মন্তেস্কু তাঁর The Spirit of Laws গ্রন্থে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিটির উল্লেখ করেন। এই নীতিটির অর্থ হল সরকারের তিনটি বিভাগ অর্থাৎ আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ একে অপরের থেকে স্বতন্ত্র থাকবে। তারা আলাদাভাবে নিজের কার্যসম্পাদন করবে। সরকারের এই তিনটি বিভাগ একে অপরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।
পূর্ণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ কাকে বলে?
পূর্ণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ: পূর্ণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বলতে কঠোর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে বোঝায়। যখন সরকারের তিনটি বিভাগ অর্থাৎ আইন, শাসন ও বিচার বিভাগ সম্পূর্ণভাবে পৃথক হয়ে কার্যসম্পাদন করে এবং কোনো বিভাগই একে অপরের বিভাগীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না, তখন তাকে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ বলে। এই নীতিরই কঠোর রূপকে পূর্ণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ বলে অভিহিত করা হয়।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রধান প্রধান শর্তগুলি কী?
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রধান শর্তসমূহ: ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বলতে বোঝায় সরকারের তিনটি বিভাগ অর্থাৎ আইন, শাসন ও বিচার বিভাগ সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন এবং স্বতন্ত্রভাবে ক্ষমতা ভোগ করবে। এই নীতির শর্তকে তিন দিক থেকে আলোচনা করা যেতে পারে। যথা-
- সরকারের এক বিভাগ অন্য বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না,
- এক বিভাগ অন্য বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করবে না এবং
- একই ব্যক্তি একাধিক বিভাগের সঙ্গে কোনোভাবেই যুক্ত থাকবে না।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির মূল কথা কী?
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির মূল কথা: ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির মূল প্রবক্তা হলেন মন্তেস্কু। তিনি প্রথম ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিটির উল্লেখ করেন। এই নীতির মূল কথা হল রাষ্ট্রের প্রধান তিনটি বিভাগ অর্থাৎ আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতার সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রতা অর্থাৎ তিনটি বিভাগ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে কাজ করবে।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিটিকে কারা স্বাধীনতার রক্ষাকবচ বলে স্বীকার করেননি?
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিটি স্বাধীনতার রক্ষাকবচ কি না তা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্যের শেষ নেই। কোনো কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিটিকে স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে উল্লেখ করেন। আবার কেউ কেউ এই নীতিটিকে স্বাধীনতার রক্ষাকবচ বলে মেনে নেওয়ার পক্ষপাতী নন। স্যাবাইন, গিলক্রিস্ট প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে স্বাধীনতার রক্ষাকবচ বলে স্বীকার করে নিতে সম্মত নন।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির কয়েকজন সমর্থকের নাম লেখো।
সমর্থক: কোনো কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিটির প্রয়োগের পক্ষপাতী। তাঁরা মনে করেন, সরকারের তিনটি বিভাগ একে অন্যের থেকে স্বতন্ত্র হওয়া উচিত। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টট্ল, রোমান দার্শনিক পলিবিয়াস ও সিসেরো, ফরাসি দার্শনিক বোদা, ইংরেজ দার্শনিক জন লক্ ও হ্যারিংটন প্রমুখ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিটিকে সমর্থন করেছেন।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পক্ষে চারটি যুক্তি দাও।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পক্ষে চারটি যুক্তি হল-
- সরকারের স্বৈরাচারী প্রবণতা রোধ করা সম্ভব হয়,
- দেশে নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রযুক্ত হওয়া আবশ্যক,
- ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষে উপযোগী। ফলে বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ গণতান্ত্রিক দেশেই এই নীতি মান্য করা হয় এবং
- আইন, শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকে। ফলে এই তিনটি বিভাগের মধ্যে কর্মকুশলতা বৃদ্ধি পায়।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বিপক্ষে চারটি যুক্তি দাও।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বিপক্ষে চারটি যুক্তি হল-
- এই নীতির বাস্তব প্রয়োগ সম্ভব নয়। কারণ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকারের তিনটি বিভাগ কখনোই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে পারে না,
- সরকারের তিনটি বিভাগ স্বতন্ত্রভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে জনকল্যাণমূলক কার্যাবলি ব্যাহত হবে,
- স্বতন্ত্রভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে সরকারের তিনটি বিভাগ স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে, ফলে ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয় এবং
- সরকারের কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। প্রতিটি বিভাগ নিজেদের দায় অন্যের উপর চাপানোর চেষ্টা করতে পারে।
কে প্রথম ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণকে একটি তত্ত্ব বা মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন?
১৭৪৮ সালে ‘The Spirit of Laws’ গ্রন্থে মন্তেস্কু ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণকে প্রথম একটি তত্ত্ব বা মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণকে ব্যক্তিস্বাধীনতার একটি গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ হিসেবে প্রচার করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এক মৌলিক নীতি হিসেবে প্রকাশ করেন।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বাস্তব প্রয়োেগ যে অসম্ভব তার একটি উদাহরণ দাও।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বাস্তব প্রয়োগ অসম্ভব তার একটি উদাহরণ হল-এই নীতিটি কার্য কার্যকর হলে ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয় এবং স্বৈরাচারিতার পথ প্রশস্ত হয়। এই নীতি প্রয়োগের ফলে এক বিভাগ অপর বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না বলেই সরকার স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। এই কারণে এই নীতিটি কোনো বিভাগের স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হয়ে উঠতে পারে না।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিটির উৎস লেখো।
উৎস: ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ ধারণাটি অত্যন্ত প্রাচীন একটি ধারণা। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টট্ল প্রথম এই নীতিটির উল্লেখ করেন। এরপর রোমান চিন্তাবিদ পলিবিয়াস ও সিসেরোর রচনাতেও ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। এছাড়াও লক্, হ্যারিংটন ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিটির পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে মার্সিলিয়াস ও বোদার রচনাতেও এই নীতির পরিচয় পাওয়া যায়।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিটির বাস্তব প্রয়োগ ঘটেছে এমন কয়েকটি দেশের নাম লেখো।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিটির আলোচনা বিশেষ স্তরে উন্নীত হয় আমেরিকার স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং ফরাসি বিপ্লবের সময়কালে। এই নিয়ে বহু রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সমালোচনা করলেও কোনো কোনো রাষ্ট্রে এই নীতিটির বাস্তব প্রয়োগ ঘটেছে। যেমন-আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো, ব্রাজিল, চিন প্রভৃতি দেশে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিটির প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের গণপরিষদ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে নীতিটি অপরিহার্য বলে ঘোষণা করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিটির পীঠস্থান বলে মনে করা হয়। মার্কিন সংবিধানের ১, ২, ৩ নং ধারায় যথাক্রমে আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের হাতে পৃথকভাবে ক্ষমতা ন্যস্ত হয়েছে।
কোন ঘটনার সময়ে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিচির তাত্ত্বিক আলোচনা থেকে বাস্তব প্রয়োগ ঘটে?
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ ধারণাটি একটি অতি প্রাচীন ধারণা, গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টট্ল প্রথম এই ধারণাটি উল্লেখ করেন। তারপর থেকে বহু রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এই ধারণাটিকে সমর্থন জানান। প্রাচীনকাল থেকে এই ধারণাটি একটি তাত্ত্বিক ধারণা হিসেবেই বিদ্যমান ছিল। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ ও ফরাসি বিপ্লবের সময়ে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিটির তাত্ত্বিক আলোচনা থেকে বাস্তব প্রয়োগ ঘটে।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির দুটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির কতকগুলি মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই বৈশিষ্ট্যগুলিকে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির মূল নীতি হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এগুলি হল-
[1 সরকারের তিনটি বিভাগের পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য: ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য। এর অর্থ হল, তিনটি বিভাগের ক্ষমতা ও কাজকর্মের এক্তিয়ার হবে সম্পূর্ণ পৃথক।
[2 একে অপরের কাজে হস্তক্ষেপ না করা ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির অপর একটি বৈশিষ্ট্য হল, সরকারের তিনটি বিভাগ কেবল স্বতন্ত্রভাবে নিজ নিজ কার্যই সম্পাদন করবে না, পাশাপাশি একে অপরের কার্যে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকবে। শাসন, আইন ও বিচার-এই তিন বিভাগ নিজেদের ক্ষমতার এক্তিয়ারের মধ্যে থেকে কাজ করবে।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি সম্পর্কে জৈব মতবাদীরা কী বলেন?
জৈব মতবাদীদের অভিমত: জৈব মতবাদীরা ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বিপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেছেন। তাদের মতে, সরকার হল জীবদেহের মতো। জীবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি যেমন একে অপরের থেকে পৃথকভাবে থাকতে পারে না তেমনই সরকারের বিভাগগুলিও পারস্পরিক বন্ধনে আবদ্ধ। ব্লুন্টস্ট্সি-র মতে, দেহ থেকে মস্তিষ্ককে আলাদা করলে জীবদেহের যেমন মৃত্যু ঘটবে, তেমনই সরকারের তিনটি বিভাগকে একে অপরের থেকে পৃথক করলে সেই রাষ্ট্রেরও পতন অবশ্যম্ভাবী।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি সম্পর্কে সমাজতন্ত্রবাদীরা কী বলেন?
সমাজতন্ত্রবাদীদের অভিমত: সমাজতন্ত্রবাদীদের মতে, সরকার সর্বদা পুঁজিবাদী শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করে। সরকারের তিনটি বিভাগ একত্রিত ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও কখনোই সর্বহারা শ্রেণির স্বার্থ সুরক্ষিত হয় না। তাঁরা বলেন, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অর্থহীন। সরকার যেমন পুঁজিবাদী শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করে, তেমনই সরকারের তিনটি পৃথক বিভাগ স্বতন্ত্রভাবে একই কাজ করবে।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি সম্পর্কে ব্ল্যাকস্টোনের অভিমত লেখো।
ব্ল্যাকস্টোনের অভিমত: ইংল্যান্ডের আইনজ্ঞ ব্ল্যাকস্টোন ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর Commentaries on the Laws of England গ্রন্থে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিটি উল্লেখ করেন। তাঁর মতে, সরকারের তিনটি বিভাগ স্বতন্ত্রভাবে কার্যসম্পাদন করলে নিজেদের স্বতন্ত্রতা বজায় থাকবে এবং জনগণের জীবন, সম্পত্তি ও স্বাধীনতা সম্পর্কিত স্বার্থগুলি সংরক্ষিত হবে। ফলে এই নীতিটির বাস্তব প্রয়োগ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
মন্তেস্কুর পর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে আরও পরিস্ফুট করেন কে? ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি কোথায় চালু আছে?
১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দে মন্তেস্কু তাঁর ‘The Spirit of Laws’ গ্রন্থে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিটির প্রথম প্রয়োগ ঘটান। পরবর্তীকালে ইংল্যান্ডের আইনজ্ঞ ব্ল্যাকস্টোন এই নীতিটি আরও পরিস্ফুট করেন। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো, ব্রাজিল, চিন প্রভৃতি দেশে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি চালু রয়েছে।
কোন্ ধরনের সরকার ব্যবস্থার ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বাস্তব প্রয়োগ লক্ষ করা যায়? কোন্ সংবিধানে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির সর্বপ্রথম প্রয়োগ ঘটে?
রাষ্ট্রপতি পরিচালিত শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বাস্তব প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে এই নীতির সর্বপ্রথম প্রয়োগ ঘটে।
নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের নীতি বলতে কী বোঝো?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান রচয়িতাগণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পাশাপাশি আরও একটি নীতি মার্কিন সংবিধানে উল্লেখ করেছেন। এই নীতিটি হল, নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি (Principles of Checks and Balance)। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের ফলে সরকারের তিনটি বিভাগ বা কোনো একটি বিভাগ যাতে অসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠতে, ব্যক্তিস্বাধীনতা ব্যাহত করতে না পারে বা স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে না পারে, সেই জন্য নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি গৃহীত হয়েছিল। এই নীতির মাধ্যমে আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ একে অপরের উপর কিছু নিয়ন্ত্রণ স্থাপন ও প্রভাব বিস্তার করে।
আরও পড়ুন – সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলি