ভাব সম্মিলন কবিতার প্রশ্ন উত্তর | একাদশ শ্রেণি 2nd Semester WBCHSE

সূচিপত্র

ভাব সম্মিলন কবিতার প্রশ্ন উত্তর | একাদশ শ্রেণি 2nd Semester WBCHSE

ভাব সম্মিলন কবিতার প্রশ্ন উত্তর
ভাব সম্মিলন কবিতার প্রশ্ন উত্তর

১। ‘ভাব সম্মিলন’ কাকে বলে? আলোচ্য পদটিতে রাধার আনন্দের যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা নিজের ভাষায় লেখো।

উত্তর : ভাবসম্মিলন: বৈষ্ণব পদাবলিতে শ্রীকৃষ্ণ মথুরা চলে যাওয়ার পরেও শ্রীরাধিকার ভাবলোকে রাধাকৃষ্ণের মিলনচিত্র অঙ্কিত হয়েছে। রাধার অনুভবে শ্যাম আবার ব্রজধামে ফিরে এসেছেন। তার এই ফিরে আসার সুখের অনুভূতিতে শ্রীরাধিকা উল্লসিত হয়েছেন। একে ভাবোল্লাস বা ভাবসম্মিলন বলে।

শ্রীরাধিকার আনন্দের চিত্র: আমাদের পাঠ্য ‘ভাব সম্মিলন’ পদে শ্রীরাধিকা তাঁর সখীকে জানিয়েছেন, তাঁর আনন্দের কোনো সীমা নেই। কারণ শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ভাবলোকে আবার ফিরে এসেছেন। আসলে প্রাণনাথ শ্রীকৃষ্ণ চিরদিন তাঁর মনের মন্দিরে বসবাস করেন। কৃষ্ণ দূরে থাকার সময় পাপী চাঁদ তাঁকে যতটা দুঃখ দিয়েছে, এখন প্রিয়তম কৃয়ের মুখদর্শনে তাঁর ততটাই সুখ অনুভূত হয়েছে। দীর্ঘ বিরহ পর্যায়ে শ্রীরাধিকা অনুভব করেছেন কৃষ্ণই তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তাই মহামূল্যবান ধনরত্ন পেলেও তিনি আর কৃষ্ণকে দূরদেশে পাঠাবেন না। তাই শ্রীরাধিকার ভাবজগতে পুনরায় শ্রীকৃষ্ণের মিলনে মনে আনন্দ প্রকাশিত হয়েছিল।

২। “কি কহব বে সখি আনন্দ ওর।”- এই পদটি কোন্ পর্যায়ের পদ এবং এখানে ‘ওর’ শব্দটির অর্থ লেখো। আলোচ্য পদে বক্তার আনন্দ কীভাবে প্রকাশিত হয়েছে লেখো।

উত্তর : পর্যায়: “কি কহব রে সখি আনন্দ ওর”-আলোচ্য কবিতাটি প্রাক-চৈতন্য পর্বের বৈয়ব পদসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পদকর্তা বিদ্যাপতি রচিত। এটি ভাবোল্লাস ও মিলন পর্যায়ের পদ।

অর্থ: এখানে ‘ওর’ শব্দটির অর্থ হল সীমা বা শেষ। শ্রীরাধিকার আনন্দের শেষ নেই আলোচ্য উক্তিতে এই বিষয়টিই পরিস্ফুট।

৩। “চিরদিনে মাধব মন্দিরে মোর”- কে, কাকে মাধব বলেছেন? উক্তিটির তাৎপর্য কী?

উত্তর : যে বলেছেন: কবি বিদ্যাপতি রচিত ‘ভাব সম্মিলন’ কবিতায় উদ্ধৃত উক্তিটি শ্রীরাধিকার।

যাকে বলেছেন: আলোচ্য উদ্ধৃতিতে রাধিকা শ্রীকৃষ্ণকে মাধব বলে উল্লেখ করেছেন।

উক্তিটির তাৎপর্য: ভাবসম্মিলনের পদে বিরহ-বিচ্ছেদে জর্জরিত শ্রীরাধিকা তাঁর মনে মাধব অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের উপস্থিতি উপলব্ধি করে আত্মতৃপ্তি অনুভব করেছেন। শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে ছেড়ে গিয়েছিলেন মথুরায়। শ্রীকৃষ্ণের অনুপস্থিতি প্রতি মুহূর্তে তাঁকে দগ্ধ করেছে। কিন্তু শ্রীরাধিকা এতদিন পর উপলব্ধি করেছেন শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর শারীরিক বিচ্ছেদই সম্ভব। মানসলোকে তাঁরা অভিন্ন সত্তা। রাধিকার ভাবলোকে আবির্ভূত হয়েছেন তাঁর প্রাণনাথ। আর সেই মুহূর্তেই তাঁর বিরহ-বেদনা দূর হয়ে গিয়েছে। এখন তাঁর মনোজগৎ কৃষ্ণময়। তিনি ভাবছেন চিরদিন কৃষ্ণ তাঁর মনের মন্দিরে বিরাজ করবেন। অর্থাৎ, কৃয় চিরদিন শ্রীরাধিকার হৃদয়ে বিরাজ করবেন।

৪। “পাপ সুধাকর যত দুখ দেল। পিয়া-মুখ-দরশনে তত সুখ ভেল।।”- কার, কখন এই উপলব্ধি ঘটে? তাঁর এই মন্তব্যের কারণ ব্যাখ্যা করো।

উত্তর : যাঁর উপলব্ধি: বিদ্যাপতির লেখা আলোচ্য ‘ভাব সম্মিলন’ কবিতায় এই উপলব্ধি শ্রীরাধিকার।

যখন এই উপলব্ধি: কৃষ্ণের অনুপস্থিতিতে, প্রেমময় চাঁদের আলো রাধাকে কৃষ্ণের কথা মনে করাত। কিন্তু শ্রীরাধিকা কৃষ্ণকে কাছে পেতেন না। দীর্ঘ বিরহ শেষে ভাবলোকে কৃষ্ণকে কাছে পেলে শ্রীরাধিকার এই উপলবিধ হয়।

মন্তব্যের কারণ: শ্রীরাধা যখন প্রিয় কৃষ্ণের বিরহে কাতর, তখন চাঁদের মায়াবী জ্যোৎস্না যেন কৃষ্ণের কথা মনে করিয়ে রাধার বিরহ যন্ত্রণাকে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলত। চাঁদের জ্যোৎস্নালোক শ্রীরাধাকে আরও বেশি কৃষ্ণের কথা মনে করাত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই বিরহ যন্ত্রণার অবসান ঘটেছে। শ্রীরাধিকা পরম প্রিয়ের সন্ধান পেয়েছেন ভাবলোকে। তাই তাঁর দুঃখের অবসান ঘটেছে।

বৃন্দাবন ছেড়ে শ্রীকৃষ্ণ চিরতরে চলে গিয়েছিল মথুরায়। ফলে রাধার বিরহ গভীরতর হয়ে উঠেছিল। বৈয়ব পদকর্তা বিদ্যাপতি রাধার এই হৃদয়যন্ত্রণা অনুভব করেছিলেন। কিন্তু শ্রীরাধার এই বিরহজনিত দুঃখ বেদনাকেই একমাত্র সত্য বলে মেনে নিতে রাজি নন বৈয়ব কবি বিদ্যাপতি। কৃষ্ণের মথুরা গমনের সত্যতাকে মেনে নিয়ে, শ্রীরাধার তীব্রতর হৃদয়বেদনা অনুভব করে, বিদ্যাপতি ভাবলোকে তাঁদের মিলন সম্পন্ন করিয়েছেন।

কৃষ্ণের ধ্যানে তন্ময় হয়ে রাধা মানসলোকে মিলিত হয়েছেন প্রিয়ের সঙ্গে। মনের মন্দিরে কৃষ্ণকে পেয়ে আর হারানোর ভয় নেই তাঁর।

অপরিসীম আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠেছেন রাধা। বিরহকালে পাপী চাঁদের আলো তাঁকে যত দুঃখ দিয়েছিল, ভাবলোকে প্রিয়কে চিরতরে পেয়ে ঠিক ততখানিই সুখের অনুভূতি হয়েছে রাধার।

৫। “পাপ সুধাকর যত দুখ দেল।”- ‘সুধাকর’ শব্দের অর্থ কী ও সুধাকরকে ‘পাপী’ বলা হয়েছে কেন? ‘যত দুখ বলতে এখানে কীসের ইঙ্গিত করা হয়েছে?

উত্তর : সুধাকর শব্দের অর্থ: ‘সুধাকর’ শব্দের অর্থ হল চাঁদ বা চন্দ্র। সুধাকরকে। পাপী বলার কারণ: বিদ্যাপতির লেখা ‘ভাব সম্মিলন’ কবিতায় আমরা দেখি প্রিয়তম কৃষ্ণের বিরহে রাধিকা যখন দুঃখে কাতর, তখন চাঁদের মায়াবী জ্যোৎস্না যেন আরও বেশি করে তাঁকে কৃষ্ণের কথা মনে করাচ্ছে। অথচ তিনি শ্রীকৃষ্ণের কাছে যেতে পারছেন না। শ্রীরাধিকার বিচ্ছেদ বেদনা দ্বিগুণ করে তোলার জন্য সুধাকরকে পাপী বলা হয়েছে।

যত দুখ প্রসঙ্গ: শ্রীরাধিকাকে ফেলে রেখে প্রিয় কৃয় গিয়েছেন মথুরায়। সমগ্র বৃন্দাবন আকুল হয়ে উঠেছে রাধিকার বিরহ-কাতরতায়। – বৃন্দাবনের বক্ষে নেমে আসা মায়াবী চাঁদের জ্যোৎকস্নালোক সেই বেদনাকে • দ্বিগুণ করেছে। চাঁদের প্রতি তাই শ্রীরাধিকার মনে বড়োই আক্রোশ জন্মেছে। • প্রিয়-বিচ্ছেদে তিনি মুহ্যমান হয়ে পড়েছেন। প্রিয়-মিলনের পূর্বে রাধার • এরূপ অবস্থার বর্ণনাতেই ‘যতদুখ’ শব্দবন্ধটির অবতারণা।

৮। “পিয়া-মুখ-দরশনে তত সুখ ভেল।।”- ‘পিয়া-মুখ’ কার ও তা দেখে কে সুখ লাভ করেছে? তাঁকে দেখে কীভাবে সুখ পাওয়া গেল?

পিয়া-মুখ যাঁর: ‘পিয়া-মুখ’ বলতে পাঠ্য ‘ভাব সম্মিলন’ পদটিতে শ্রীকৃষ্ণের মুখশ্রীর কথা বলা হয়েছে।

যে সুখলাভ করেছে: ‘পিয়া-মুখ’ দর্শন করে স্বয়ং শ্রীরাধিকা সুখ লাভ করেছেন।

যেভাবে সুখ পাওয়া গেল: বৃন্দাবন ছেড়ে কৃষ্ণ বহুদিন যাবৎ মথুরায় অবস্থান করছেন। তাঁর শূন্যতা বৃন্দাবনকে মলিন করেছে। বৃন্দাবনবাসী কৃষ্ণদর্শনে আকুল হয়ে উঠেছে। আর তাঁর প্রাণাধিক প্রিয়া শ্রীরাধিকার অবস্থা বড়োই করুণ। দুষ্ট চন্দ্র বারবার কৃষ্ণের কথা মনে করিয়ে তাঁকে আরও বেশি জর্জরিত করছে। দীর্ঘ অদর্শনে রাধার মনে কৃষ্ণের জন্য প্রবল বিরহ যন্ত্রণা জেগে উঠেছে। কিন্তু হঠাৎই ভাবসম্মিলনের অনুভূতিতে শ্রীরাধিকা দেখেন, তাঁর মানসপটে শ্রীকৃষ্ণ যেন সর্বত্র, সর্বক্ষণ বিরাজ করছেন। তাই শ্রীরাধিকার মনে কৃষ্ণকে দেখতে না পাওয়ার দুঃখ মুহূর্তে মুছে গিয়েছে। তাই মনোজগতের ভাবনায়, কৃষ্ণকে কাছে পেয়ে শ্রীরাধিকা সখ লাভ করেছেন।

৯। “আঁচর ভরিয়া যদি মহানিধি পাই তব হাম পিয়া দূর দেশে না পাঠাই ‘পিয়া’ দূর দেশে গিয়েছিলেন কেন? বক্তা শ্রীরাধিকা তাঁকে আর দূরদেশে পাঠাতে রাজি হননি কেন?

উত্তর : দূরদেশে যাওয়ার কারণ: বিদ্যাপতির লেখা পাঠ্য ‘ভাব সম্মিলন’ কবিতা থেকে নেওয়া আলোচ্য উক্তিতে শ্রীরাধিকা তাঁর প্রিয় কৃষ্ণর দূরদেশে অর্থাৎ মথুরায় যাওয়ার কথা বলেছেন। কৃষ্ণ মথুরায় গিয়েছিলেন রাজা কংসকে বধ করার উদ্দেশ্যে।

রাজি না হওয়ার কারণ: প্রিয়তম কৃষ্ণ দূরদেশে চলে গেলে শ্রীরাধিকা প্রিয় বিরহে কাতর হয়ে পড়েন। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর প্রাণনাথ, তাঁরা অভিন্ন সত্তা। তাই শ্রীকৃষ্ণের অনুপস্থিতি রাধিকাকে মৃতবৎ করে তুলেছে। মণিহারা ফণীর ন্যায় তিনি ছটফট করছেন। তাই নিঃসঙ্গ রাধা এরপর যখন কৃষ্ণকে নিজের ভাবজগতে পুনরায় ফিরে পান, তখন তিনি অনুভব করেন কৃষ্ণই তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তাই কোনো কিছুর বিনিময়ে শ্রীরাধিকা অমূল্য কৃষ্ণকে দূরদেশে পাঠাতে রাজি নন। কারণ প্রিয়বিরহ তাঁর পক্ষে পুনরায় সহ্য করা অসম্ভব, মৃত্যুর সমান। আঁচল ভরে মূল্যবান ধনরত্ন পেলেও রাধা তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ শ্রীকৃয়কে আর দূরে যেতে দেবেন না।

১০। আঁচর ভরিয়া যদি মহানিধি পাই। তব হাম পিয়া দূর দেশে না পাঠাই।।”- ‘মহানিধি-র আক্ষরিক ও অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝিয়ে দাও। ‘মহানিধি পেলে বক্তা কী করবেন?

আক্ষরিক অর্থ: বৈয়ব পদকর্তা বিদ্যাপতি রচিত আমাদের আলোচ্য পাঠ্য ‘ভাব সম্মিলন’ পদটি থেকে উদ্ধৃতিটি গৃহীত। আলোচ্য উদ্ধৃতি থেকে সংকলিত-‘মহানিধি’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল মহৈশ্বর্য, মহামূল্যবান সম্পদ। পার্থিব ধনরাশি, যা মানুষকে বিত্তশালী করে, কখনো-কখনো লোভী, স্বার্থপর করে তোলে।

অন্তর্নিহিত অর্থ: পাঠ্যানুসারে ‘মহানিধি’ শব্দটির অন্তর্নিহিত অর্থ স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। রাধিকার কাছে শ্রীকৃয় হলেন মহামূল্যবান রত্ন সমান, তাঁর হৃদিমাণিক্য, তাঁর অভিন্ন সত্তা।

বক্তা যা করবেন: শ্রীকৃষ্ণ মথুরা চলে যাওয়ার পর শ্রীরাধিকা যে বিরহ যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছিলেন, সেই অন্তরের বিরহ ক্লেশ কাটিয়ে উঠেছেন। যে শারীরিক বিচ্ছেদ রাধিকাকে পীড়িত করছিল, সেই বিচ্ছেদ-বেদনা রাধিকার মানসলোকে এসে হঠাৎই প্রশমিত হয়েছে। রাধা ভাবলোকে অনুভব করেছেন শ্রীকৃষ্ণকে। তাঁরা এখন অভিন্ন সত্তা। মানসলোকে ঘটেছে যুগল প্রেমের মূর্তির ভাবসম্মিলন। কারণ তাঁর কাছে সমগ্র জগৎ এখন কৃমময়। কৃষ্ণ তাঁর কাছে পরম ঐশ্বর্যের সমান। তবে প্রিয় কৃষ্ণকে তিনি যে কাছে পেয়েছেন, কোনো মহৈশ্বর্যের বিনিময়েই তিনি আর তাঁকে দূরদেশে চলে যেতে দেবেন না।

১১। শীতের ওঢ়নী পিয়া গীরিষির বা বরিষার ছত্র পিয়া দরিয়ার না।।”- প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আলোচ্য উদ্ধৃতিটি ব্যাখ্যা করো।

প্রসঙ্গ: কবি বিদ্যাপতি রচিত পাঠ্য ‘ভাব সম্মিলন’ কবিতা থেকে আলোচ্য উদ্ধৃতিটি সংগৃহীত। আলোচ্য অংশে কবি বুঝিয়েছেন প্রিয়তম শ্রীকৃষ্ণ, কেবল শ্রীরাধিকার প্রেমিকই নন, তিনি তাঁর ত্রাতাস্বরূপ। রাধার জীবনে কৃষ্ণের গুরুত্ব কতখানি, তা বোঝাতে বিদ্যাপতি এই মালা রূপক অলংকার ব্যবহার করেছেন।

ব্যাখ্যা: দীর্ঘদিন কৃষ্ণবিচ্ছেদ শূন্য শ্রীরাধিকাকে উন্মাদিনী করে তুলেছিল। আকাঙ্ক্ষিত প্রিয়তমকে মানসলোকে পেয়ে তাঁর আনন্দের আর সীমা নেই। ভাবের অতিশয্যে ভেসেছেন শ্রীরাধিকা। সখীর কাছে সেই আনন্দ ব্যক্ত করছেন, নানা অলংকার-অভিধায় ভরিয়ে তুলছেন শ্রীকৃষ্ণকে। শ্রীকৃষ্ণ যে তাঁর কাছে কতটা মূল্যবান, তা বোঝাতে কী বলবেন, কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। তিনি সখীকে বলছেন, ওড়না বা উত্তরীয় যেমন শীতের প্রকোপ থেকে শরীরকে রক্ষা করে তেমনই শ্রীকৃষ্ণ যেন শ্রীরাধিকার অসময়ের রক্ষক, আবার প্রবল গ্রীষ্মের দিনে সুশীতল বাতাসের মতো শ্রীকৃয় শ্রীরাধিকার জীবনে আনেন প্রশান্তি। কৃষ্ণ যেমন ছাতার ন্যায় প্রতিকূলতার ধারা বর্ষণ থেকে রাধিকাকে রক্ষা করেন, তেমনই কৃষ্ণই তাঁর জীবন নদীর নৌকা। দুর্গম ভব পারাবারের কান্ডারি। রাধার জীবনে তিনি নিশ্চিন্ত আশ্রয় সুখ। অর্থাৎ রাধার জীবন জুড়ে শ্রীকৃষ্ণ বিরাজমান। এ কথাই আলোচ্য অংশে বর্ণনা করা হয়েছে।

১২। ভণিতা কী ও পাঠ্যপদে কোথায় ভণিতার আভাস রয়েছে? পদকর্তার পরিচয় দাও।

ভণিতা: পদের মাঝে বা শেষে কবির নামযুক্ত উক্তিকে ভণিতা বলা হয়। ভণিতার মাধ্যমে পদকর্তার নিজস্ব প্রকাশরীতির এবং ব্যক্তি পরিচয় পাওয়া যায়। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে বিশেষত পদাবলি রচনার ক্ষেত্রে ভণিতা ব্যবহৃত হত।

ভণিতার আভাস: আলোচ্য পদটির নবম পঙ্ক্তিতে কবি বিদ্যাপতি ভণিতা ব্যবহার করেছেন, যথা- “ভণয়ে বিদ্যাপতি শুন বরনারি”।

১৩। “ভণয়ে বিদ্যাপতি শুন বরনারি”- ‘বরনারি’ শব্দের অর্থ কী এবং কাকে ‘বরনারী’ বলা হয়েছে? তাঁকে ‘বরনারি বলার কারণ কী?

বরনারি শব্দের অর্থ: বিদ্যাপতি রচিত পাঠ্য ‘ভাব সম্মিলন’ কবিতার ভণিতা অংশে ব্যবহৃত ‘বরনারি’ শব্দের অর্থ শ্রেষ্ঠ রমণী।

যাকে বলা হয়েছে: আলোচ্য পদে শ্রীরাধিকাকে ‘বরনারি’ বলা হয়েছে। বরনারি বলার কারণ: পাঠ্য ‘ভাব সম্মিলন’ পদে শ্রীরাধিকাকে – বিদ্যাপতি বরনারি বলে সম্বোধন করেছেন। কারণ শ্রীরাধিকা হলেন শ্রীকৃষ্ণের সখীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। কারণ একমাত্র শ্রীরাধিকাই হ্লাদিনী শক্তির অধিকারী। তাই অভিন্ন সত্তা রাধিকা ও শ্রীকৃষ্ণ কখনোই বিচ্ছিন্ন হওয়ার নয়। ২} বৈয়ব সাহিত্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু বা নায়িকা হলেন শ্রীরাধা। তিনি শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তিরূপা অর্থাৎ তিনি সচ্চিদানন্দ কৃষ্ণের আনন্দ আস্বাদনের শক্তিস্বরূপ। রাধা, কৃষ্ণেরই অংশ। রাধার মাধ্যমেই কৃষ্ণ, প্রেমে মগ্ন হন। তিনি আর রাধা কোনো পৃথক সত্তা নন। কৃষ্ণের আহ্লাদিনী শক্তিকে বলা হয় হ্লাদিনী শক্তি, রাধা কৃষ্ণের আরাধিকা (যিনি স্বয়ং কৃষ্ণ কর্তৃক আরাধিতা)।

শ্রীচৈতন্যদেবকে কেন্দ্র করে বৈয়ব সাহিত্য প্রাক-চৈতন্য ও উত্তর ২ চৈতন্যযুগে বিভক্ত হয়েছে। প্রাক-চৈতন্যযুগের সাহিত্যে রাধার প্রেম ছিল নই লৌকিক অনুভূতির। কিন্তু উত্তর চৈতন্যযুগের রাধাপ্রেম সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক এবং বৈয়বসাহিত্য অনুসারে ব্রজগোপিনিদের মধ্যে রাধাই সর্বশ্রেষ্ঠ। কৃষ্ণপ্রেমে সকল বাধা অতিক্রম করে শ্রীকৃষ্ণের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য তিনি কুল-মান মর্যাদা সর্বস্বত্যাগ করেছেন। বৈয়ব রসশাস্ত্রের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘উজ্জ্বলনীলমণি’-তে বলা হয়েছে, চন্দ্রাবলী ও রাধার মধ্যে শ্রীরাধাই সর্ববিষয়ে শ্রেষ্ঠা। রাধার প্রেমই কৃষ্ণের সৌন্দর্য, মাধুর্যকে বিকশিত করেছে।

১৪। সুজনক দুখ দিবস দুই- চারি- সুজন কে ও তাঁর দুঃখের কারণ কী? তাঁর দুঃখের অবসান কীভাবে ঘটেছিল?

সুজন: বিদ্যাপতি রচিত আলোচ্য ‘ভাব সম্মিলন’ পদে সুজন বলতে শ্রীরাধিকাকে বোঝানো হয়েছে।

সুজনের দুঃখের কারণ: শ্রীরাধিকাকে ফেলে রেখে প্রিয় কৃষ্ণ গিয়েছেন মথুরায়। সমগ্র বৃন্দাবন আকুল হয়ে উঠেছে রাধিকার বিরহ-কাতরতায়। বৃন্দাবনের বক্ষে নেমে আসা মায়াবী চাঁদের জ্যোৎস্নালোক সেই বেদনাকে দ্বিগুণ করেছে। প্রিয়-বিচ্ছেদে তিনি মুহ্যমান হয়ে পড়েছেন। প্রিয়ের সঙ্গে দীর্ঘ বিচ্ছেদে শ্রীরাধিকা দুঃখে কাতর হয়েছিলেন। সেই অতীত দুঃখ-স্মৃতি প্রসঙ্গেই আলোচ্য উদ্ধৃতিটির অবতারণা।

দুঃখের অবসান ঘটে যেভাবে: পাঠ্য ‘ভাব সম্মিলন’ পদে আমরা দেখি, শ্রীকৃষ্ণ চিরতরে মথুরা চলে যাওয়ার পরেও শ্রীরাধিকা তাঁর ভাবলোকে শ্রীকৃয়কে খুঁজে পেয়েছেন। এর ফলে কৃষ্ণের আর চলে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তিনি চিরকাল শ্রীরাধিকার অন্তরেই বিরাজ করবেন। তাই সুজন অর্থাৎ শ্রীরাধিকার দুঃখের অবসান ঘটেছে। দীর্ঘ বিরহকাল যাপনের পর প্রিয়ের সঙ্গে ভাবলোকে মিলনের আনন্দে আত্মহারা হয়েছেন শ্রীরাধা।

১৫। বৈষ্ণব দর্শনে ভাব সম্মিলনের তাৎপর্য কী? পাঠ্য কবিতায় রাধার ভাব সম্মিলন কীভাবে প্রকাশ পেয়েছে?

ভাবসম্মিলনের তাৎপর্য: ভাবসম্মিলন হল শ্রীরাধিকার ভাবলোকে রাধাকৃল্পের মিলন। বৈয়ব দর্শনানুসারে, শ্রীকৃষ্ণ মথুরা চলে যাওয়ার পরেও শ্রীরাধিকার মানসলোকে, তাঁর অনুভবে আবার ব্রজধামে ফিরে আসেন।

তাঁর এই ফিরে আসার, তাঁকে কাছে পাওয়ার অনুভূতিতে শ্রীরাধিকা উল্লসিত হন। ভাবলোকে রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তির অভিন্ন হয়ে ওঠাই ভাবসম্মিলন বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

রাধার ভাবসম্মিলন: শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবন ত্যাগ করে মথুরা যাত্রাকালে রাধাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি আবার তাঁর কাছে ফিরে আসবেন। কিন্তু তাঁর আর ফিরে আসা সম্ভব হয়নি। সাময়িক বিরহ-ক্লেশের পর রাধা বুঝতে পেরেছেন, জাগতিক মিলনের মধ্যে আছে বিরহ যন্ত্রণা। প্রতিমুহূর্তে প্রিয়তমকে হারাবার ভয়। এই ভয়-বিরহ-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় হল অন্তরের মধ্যে প্রিয়তমের সঙ্গে নিত্যমিলন। রাধার হৃদয় মন্দিরে যুগলের নিত্যমিলনই হল ভাবসম্মিলন।

যন্ত্রণাদগ্ধ বিরহী রাধা কৃষ্ণের সাধনায় মানসলোকে পেয়েছেন প্রিয়কে। তাই আর তাঁকে হারানোর ভয় নেই। সখীকে রাধা তাই জানিয়ে দিয়েছেন, চিরদিন মাধব তাঁর মনের মন্দিরে অবস্থান করবেন। জাগতিক কোনো দুঃখ-বেদনাই আর রাধাকে স্পর্শ করতে পারবে না। কোনো কিছুর বিনিময়েই তিনি আর প্রিয়তমকে দূর দেশে পাঠাতে রাজি নন। বিদ্যাপতি আলোচ্য পদে রাধাকৃয় প্রেমের গভীরতাটি স্পর্শ করতে পেরেছেন। বিদ্যাপতি উপলব্ধি করেছেন, কৃষ্ণপ্রেম শ্রীরাধার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য কতখানি অপরিহার্য। কৃষ্ণ, রাধার কাছে শীতের উয় আচ্ছাদন, গ্রীষ্মের শীতল বাতাস, বর্ষাকালের প্রয়োজনীয় ছাতা এবং অকূল সমুদ্রের নৌকা বিশেষ। অপূর্ব দক্ষতায় বিদ্যাপতি মালা রূপক অলংকারের যথাযথ প্রয়োগে, প্রত্নকলাবৃত্ত ছন্দের ব্যবহারে রাধার প্রেমকে মর্ত্যচারী করে তুলেছেন-এভাবেই আলোচ্য পদটি রাধাকৃষ্ণের ভাব সম্মিলনের যথার্থ নিদর্শন হয়ে উঠেছে।

১৬। ভাব সম্মিলন’ কবিতাটির কাব্য সৌন্দর্য আলোচনা করো।

কাব্য সৌন্দর্য: বিদ্যাপতি রচিত ‘ভাব সম্মিলন’ কবিতাটি শ্রীকৃয় ও রাধিকার প্রত্যক্ষ দর্শনজাত মিলনের কাহিনি নয়। রাধা তাঁর ভাবজগতে কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হয়ে অপরিসীম আনন্দ উপভোগ করেছেন। তাঁদের এই ভাবলোকে মিলনের ফলেই শ্রীরাধিকার সুখের অনুভূতিতে হয়েছে ভাবোল্লাস। তবে আধুনিক প্রেমকাব্য রূপেও এর কাব্যসৌন্দর্য অতুলনীয়।

‘ভাব সম্মিলন’ কবিতার শেষ দুটি পঙ্ক্তি ছাড়া সম্পূর্ণ কবিতাটি রাধার উক্তিতে রচিত। কৃষ্ণ বিরহের দুঃখের দিনগুলো পার করে প্রিয় কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনের উল্লাসে আনন্দিত রাধা। এতদিন চাঁদের মায়াবী আলো, কৃষ্ণকথা মনে এনে যে বেদনার জন্ম দিয়েছিল, কৃয় সান্নিধ্যে সেইসব দুঃখযন্ত্রণা যেন ধুয়ে মুছে গিয়েছে। শ্রীরাধা বুঝেছেন, শ্রীকৃষ্ণ তাঁর মহামূল্যবান ঐশ্বর্যস্বরূপ, সময়-অসময়-দুঃসময়ের ত্রাতা। এ প্রসঙ্গে পদকর্তা মালা রূপক অলংকারে শ্রীকৃয়কে তুলনা করেছেন, শীতের ওড়না, গ্রীষ্মের বাতাস, বর্ষার ছাতা, অথই ভবসাগর অতিক্রমের বৈতরণীরূপে। পদের পরিশেষে শ্রীরাধা আর পদকর্তা বিদ্যাপতি মানসপটে যেন একাত্ম হয়ে ওঠেন। তাই রাধিকার বিরহ-আনন্দে সহমর্মী পদকর্তা তাঁকে আশ্বাস দেন, সুজনের দুঃখ স্বল্পস্থায়ী, শ্রীকৃয় বিচ্ছেদও রাধার জীবনে তাই। অভিন্ন হৃদয় যাঁরা, তাঁদের কি শারীরিক বিচ্ছেদে পৃথক করা যায়! এভাবেই পদটি আধুনিক গীতিকাব্যের বৈশিষ্ট্যে পাঠককে গভীর ভাবজগতে নিয়ে যায়।

১৭। রাধাকৃষ্ণের লীলা বিষয়ক পদের প্রথম উল্লেখ কোথায় পাওয়া যায়? কবি বিদ্যাপতি রাধার দুঃখ ও আনন্দের সঙ্গে কীভাবে একাত্মতা অনুভব করেছেন, তা ‘ভাবসম্মিলন’ কবিতা অবলম্বনে লেখো।

উৎস: জয়দেব তাঁর ‘গীতগোবিন্দ’-এ উচ্চারণ করলেন- ‘মধুর কোমলকান্তপদাবলীং শূনু তদা জয়দেবসরস্বতীম’। ‘গীতগোবিন্দ’-এর প্রথম সর্গের তৃতীয় শ্লোকে, পদাবলি শব্দের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়।

এরপর ‘বৈষ্ণব পদাবলি’ চর্চা শুরু হয় আনুমানিক চতুর্দশ শতাব্দী থেকে। আর এর বিকাশ ঘটে আনুমানিক ষোড়শ শতাব্দীর সময়কালে।

বিদ্যাপতির একাত্মতা অনুভব: বিদ্যাপতি হলেন ভক্ত কবি। কৃষ্ণ যেমন রাধার আরাধ্য তেমন কবিরও আরাধ্য। তাই রাধার আনন্দ বেদনার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছে কবির অনুভব। বহুদিন পরে কৃষ্ণ ফিরে এসেছেন রাধার হৃদয়মন্দিরে। কৃষ্ণ মথুরায় চলে যাওয়ার পর রাধা বিরহযন্ত্রণা ভোগ করেছেন। তাই তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কবি রাধাকে বলেছেন, সুজনের দুঃখ বেশিদিন থাকে না, তা স্বল্প সময় স্থায়ী হয়। তাই স্বয়ং কৃষ্ণ শ্রীরাধিকাকে দুঃখ থেকে মুক্তি দিয়েছেন। কবিও তাই আনন্দিত। ভাবসম্মিলন • যেমন রাধাকৃষ্ণের মিলন, তেমনই হয়ে উঠেছে ভক্ত ও ভগবানেরও ভাবসম্মিলন। কবি বিদ্যাপতিও যেন শ্রীরাধিকার আনন্দের ভাগীদার হয়ে উঠেছেন, তাঁর আনন্দকে অনুভব করেছেন।

১৮। বিদ্যাপতি রচিত ‘ভাব সম্মিলন পদটিতে রাধাকে কবি বিদ্যাপতি কীভাবে চিত্রিত করেছেন?

উত্তর : মিথিলার রাজা শিবসিংহের সভাকবি বিদ্যাপতি বৈষ্ণব পদাবলিতে নানা পর্যায়ের পদে রাধা চরিত্র নির্মাণে বিশেষ পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। রাধার অপরিসীম হৃদয়বেদনা উপলব্ধি করে ভাবোল্লাস বা ভাবসম্মিলন পর্যায়ের পদে বিদ্যাপতি ভাবলোকে রাধাকৃষ্ণের মিলন ঘটিয়েছেন।

রাধার চরিত্র চিত্রায়ণ: আলোচ্য পদে সখির কাছে রাধা যে আনন্দ অনুভূতির কথা প্রকাশ করেছেন তার থেকে স্পষ্ট যে রাধা, কৃষ্ণ ছাড়া অসম্পূর্ণ। কৃয় ছাড়া রাধার জীবন তাৎপর্যহীন। সে কৃষ্ণপ্রেমে একনিষ্ঠ। বৃন্দাবন ছেড়ে কৃষ্ণ চিরতরে চলে গিয়েছেন মথুরায়। রাধা দীর্ঘ বিরহ যন্ত্রণা ভোগ করেও কৃষুধ্যানে মগ্ন হয়ে অন্তরে উপলব্ধি করেছেন প্রিয় কৃষ্ণের সান্নিধ্য। অর্থাৎ বিদ্যাপতির মতোই রাধা অনুভূতিপ্রবণ। চিরআকাঙ্ক্ষিত মানুষকে মনের মন্দিরে লাভ করে অপরিসীম আনন্দ লাভ করেছেন তিনি।

দীর্ঘ বিরহের সময় তাঁর শেষ হয়েছে। তাই তিনি সখীর কাছে কৃষ্ণপ্রেমের অনিবার্যতার কথা ঘোষণা করেছেন। কবি বিদ্যাপতির রাধা চঞ্চল। বিরহ তাঁর কাছে অন্তহীন সত্য নয়। দুঃখকে অতিক্রম করে কাঙ্ক্ষিত সুখের নাগাল পেয়েছেন রাধা। ত্যাগের মধ্যে দিয়ে প্রেমের মাধুর্যে তিনি বিশ্বাসী নন, রাধা ভাবলোকে প্রিয়সঙ্গ লাভ করেন চিরন্তন প্রেমসৌন্দর্যে তাঁর আগ্রহ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই বিদ্যাপতির রাধাকে ‘সত্বয়’, ‘লীলাময়ী’ আখ্যা দিয়েছেন। লীলাময়ী রাধার অন্তহীন প্রেমতুয়া পাঠ্য ‘ভাব সম্মিলন’ পদটিকে তাৎপর্যমণ্ডিত করে তুলেছে।

১৯। বৈষ্ণব পদাবলি বলতে কী বোঝায় এবং এতে কতগুলি রসপর্যায় আছে ও কী কী? বৈঘ্নব পদাবলির কালানুক্রমিক বিভাজন দেখিয়ে প্রতি পর্বের দুইজন করে পদকর্তার নাম লেখো।

বৈষ্ণব পদাবলি: বৈয়ব পদ হল মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের একটি বিশিষ্ট ধারা। যদিও এর অবলম্বন রাধাকৃয়-এর প্রেমলীলা তবুও বৈয়বতত্ত্ব, দর্শন ও ধর্মচিন্তার ব্যাখ্যাই হল এর মূল কথা। এর রস আস্বাদনে তৃপ্তি মেলে সহজেই। স্বয়ং চৈতন্যদেব বৈয়ব পদ শুনে আনন্দলাভ করতেন।

রসপর্যায়: বৈষ্ণব পদাবলিতে ‘রস’ একটি স্বতন্ত্র বিষয়। রাধাকৃষ্ণলীলা প্রকৃত নর-নারীর প্রেমলীলা নয়, এ হল পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার পরম মিলন। বৈষ্ণব রসশাস্ত্রের ভাব ও রসের নিরিখে বৈয়ব ভক্তবৃন্দ শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর-এই পাঁচ প্রকার রস আস্বাদন করেন।

বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের ভাগ: বৈয়ব পদাবলি সাহিত্যকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়-

চৈতন্য পূর্ববর্তী যুগের পদাবলি। চৈতন্য সমসাময়িক যুগের পদাবলি। চৈতন্য পরবর্তী যুগের পদাবলি।

পদকর্তাদের নাম: দুজন চৈতন্য পূর্ববতী যুগের পদকর্তা হলেন- বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস। চৈতন্য সমসাময়িক দুজন পদকর্তা হলেন- মুরারি গুপ্ত ও নরহরি সরকার এবং দুজন চৈতন্য পরবর্তী যুগের পদকর্তা হলেন জ্ঞানদাস ও গোবিন্দদাস।

২০। বিদ্যাপতিকে মৈথিল কোকিল বলা হত কেন? বিদ্যাপতি বাঙালি কবি নন, তাঁর কবিতার ভাষা বাংলা নয়- তথাপি তাঁকে বাংলা সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে কেন?

মৈথিল কোকিল বলার কারণ: মিথিলার রাজসভাকবি বিদ্যাপতিকে তাঁর রচনার সৌন্দর্য, মাধুর্য ও রোমান্টিক ভাবাবেগের প্রকাশশৈলীর কারণে ‘মৈথিল কোকিল’ বলা হত। মিথিলার কবি বিদ্যাপতির পদ, সাহিত্যর সর্বকালের সম্পদ।

বাংলা সাহিত্য জগতে বিদ্যাপতির জনপ্রিয়তার কারণ: বিদ্যাপতি মিথিলার রাজা শিবসিংহের সভাকবি ছিলেন। তিনি সংস্কৃত, অবহট্ট, মৈথিলি ভাষায় গ্রন্থ রচনা করেন। সেই সময় মিথিলা ছিল নব্যন্যায় চর্চার কেন্দ্র। বাংলা থেকে প্রচুর শিক্ষার্থী ন্যায় শিক্ষার জন্য মিথিলায় যেত। তখন তারা ন্যায়ের সূত্রের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যাপতির লেখা রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদাবলি শ্রবণ করত। পরে বাংলাতে তাদের মুখে মুখেই তা প্রচার ও জনপ্রিয়তা পায়। শোনা যায় মহাপ্রভু চৈতন্যদেব স্বয়ং বিদ্যাপতির পদ আস্বাদন করতেন। এভাবেই মিথিলার কবি বিদ্যাপতি তাঁর সুললিত পদাবলির দ্বারা বাংলা সাহিত্যের দরবারে সহজেই স্থান করে নেন।

আরও পড়ুন – একাদশ শ্রেণির বাংলা বিষয়ের ১ম সেমিস্টারের অন্যান্য অধ্যায়

Leave a Comment