1946 খ্রিষ্টাব্দের নৌ বিদ্রোহের কারণ ও তাৎপর্য
ভূমিকা
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্তিম লগ্নে যেসব ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল 1946 সালের নৌ-বিদ্রোহ তাদের মধ্যে অন্যতম । ব্রিটিশ ও ভারতীয় নৌসেনাদের মধ্যে বৈষম্যমূলক আচরণ, ভারতীয় নৌ-সেনাদের স্বল্প বেতন প্রদান, ভারতীয় নৌ-সেনাদের নিম্নমানের খাদ্যবস্তু সরবরাহ করা এবং শ্বেতাঙ্গদের বর্ণবিদ্বেষী নীতি ইত্যাদির জন্য ভারতীয় নৌসেনারা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে । 1946 খ্রিস্টাব্দের 18 ই ফেব্রুয়ারি ‘রয়াল ইন্ডিয়ান নেভি’র প্রধান এম.এস. খানের নেতৃত্বে বোম্বের তলোয়ার নামক যুদ্ধ জাহাজের ভারতীয় নাবিকগণ প্রথম বিদ্রোহ শুরু করেন। প্রায় 1500 নাবিক এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে।
নৌবিদ্রোহের কারণ
1946 খ্রিস্টাব্দে বোম্বাইয়ের ভারতীয় নৌবাহিনীতে ব্যাপকভাবে যে বিদ্রোহ ঘটেছিল তার পিছনে একাধিক কারণ দায়ী ছিল। যথা—
(১) বেতন বৈষম্য : সমযোগ্যতা থাকা সত্বেও ইউরোপীয় নাবিকদের থেকে ভারতীয় নাবিকদের কম বেতন দেওয়া হত ।
(২) নিম্নমানের খাদ্য সরবরাহ : ইউরোপীয় নাবিকরা উত্কৃষ্ট মানের খাবার পেলেও ভারতীয় নাবিকদের জন্য নিকৃষ্ট মানের খাবার সরবরাহ করা হত।
(৩) জাতি বৈষম্য : ইংরেজ নাবিক ও নৌ-অফিসাররা ভারতীয় নাবিক ও নৌ-অফিসারদের যথেষ্ট ঘৃণার চোখে দেখত। এছাড়াও তারা ভারতীয় নাবিকদের অকারণে গালিগালাজ, অপমান ও খারাপ ব্যবহার করত।
(৪) বৈষম্যমূলক আচরণ : ব্রিটিশ নৌ-কর্মচারীদের সমান যোগ্যতা থাকা সত্বেও ভারতীয় নৌ-কর্মচারীদের কোনোদিনই পদন্নোতি হত না। চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে ভারতীয় নৌসেনাদের পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না।
(৫) ঝুঁকিপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্রে ভারতীয় নৌ-সেনাদের প্রেরণ বিপজ্জনক কেন্দ্রে যেখানে মৃত্যুর ঝুঁকি অপেক্ষাকৃত বেশি সেখানে বেছে বেছে ভারতীয় নৌসেনাদেরই পাঠানো হত।
(৬) আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারের প্রভাব : ব্রিটিশ সরকার আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিচার শুরু করলে সাধারণ ভারতীয় জনগণের মতো ভারতীয় নৌবাহিনীও ক্ষুব্ধ হয়। আজাদ হিন্দ বাহিনীর দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগ তাদের অনুপ্রাণিত করে। ইতিমধ্যে বিচারে আজাদ হিন্দ বাহিনীর ক্যাপ্টেন রশিদ আলির সাত বছরের কারাদন্ড হলে পরিস্থিতি অগিগর্ভ হয়ে ওঠে।
1946 খ্রিস্টাব্দের নৌ বিদ্রোহের গুরুত্ব
আপাত দৃষ্টিতে নৌ-বিদ্রোহ ব্যর্থ মনে হলেও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই আন্দোলনের সূদুর প্রসারী গুরুত্ব ছিল, যেমন—
1) এই বিদ্রোহের ফলে ইংরেজরা বুঝতে পারে ভারতবর্ষে তাদের দিন শেষ হয়ে এসেছে। নৌবিদ্রোহের গুরুত্ব উপলব্ধি করেই ব্রিটিশ সরকার এই প্রথম আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরে গুরুত্ব আরোপ করে।
2) নৌসেনাদের বিদ্রোহ সাধারণ মানুষের মনে ব্রিটিশ ভীতি দূর করেছিল। দেশীয় সেনা ও সাধারণ প্রজাদের মধ্যে ব্যবধান দূর হয়েছিল।
3) এই বিদ্রোহে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য স্থাপিত হয়েছিল। হিন্দু-মুসলিম নাবিক, এমনকি সাধারণ হিন্দু-মুসলিম প্রজারাও বিদ্রোহে সাম্প্রদায়িক ঐক্যের পরিচয় দিয়েছিল।
4) এই বিদ্রোহের ফলে ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য 1946 খ্রিস্টাব্দে ক্যাবিনেট মিশনকে ভারতে পাঠায়।
উপসংহার
রজনীপাম দত্তের মতে, এই বিদ্রোহ ভারত ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা করেছিল। তাই নৌবিদ্রোহের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। সুমিত সরকার নৌবিদ্রোহকে বীরচিত সংগ্রাম এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের মুক্তিযুদ্ধের তুলনায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছেন।
আরও পড়ুন – নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য রচনা