1943 খ্রিস্টাব্দে বাংলায় দুর্ভিক্ষের কারণ গুলি কী ছিল
(i) খাদ্য উৎপাদন হ্রাস
1942 খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও জলস্রোতে বাংলার আমন ধানের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এবং বহু গবাদি পশু মারা যায়। শস্যের উৎপাদন প্রায় 50 থেকে 90 শতাংশ কমে যায়। ফলে ওই বছর খাদ্য সংকট চরমে ওঠে।
(ii) বাণিজ্য গন্ডি প্রথা
ব্রিটিশ সরকার 1942 খ্রিস্টাব্দে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে বাণিজ্য গন্ডি প্রথা চালু করায় ব্যবসায়ীরা অন্যান্য প্রদেশ থেকে বাংলায় খাদ্যশস্য আমদানি করতে পারেনি। প্রাদেশিক সরকারগুলিও নিজ প্রদেশের বাইরে খাদ্যশস্য রপ্তানির ক্ষেত্রে অনিচ্ছা প্রকাশ করলে বাংলায় খাদ্যশস্য আমদানি একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়।
(iii) খাদ্য সরবরাহ ব্যাহত
1942 খ্রিস্টাব্দের বন্যায় গ্রামীণ রাস্তাগুলি ভেঙে যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। এই অবস্থায় বাংলার দূর-দূরান্তের গ্রামগুলিকে খাদ্য ত্রাণ ও চিকিৎসার সুযোগ পৌঁছে দেওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে।
(iv) বার্মা থেকে চাল আমদানি ব্যহত
জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় 1942 খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের হাত থেকে বার্মা দখল করে নিলে বার্মা থেকে বাংলায় পূর্বপ্রচলিত চাল আমদানি প্রথা বন্ধ হয়ে যায়।
(v) পোড়ামাটি নীতির প্রয়োগ
জাপান কর্তৃক বার্মা দখলের পর ব্রিটিশ সরকার আশংকা করেছিল যে জাপান হয়তো বাংলা হয়ে ব্রিটিশ ভারতে অভিযান চালাতে পারে। এজন্য পোড়ামাটি নীতি অনুসারে বার্মার নিকটবর্তী চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে আসার সময় সরকার সেখানকার খাদ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সমূলে ধ্বংস করে। ফলে সেখানে খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা একেবারেই ভেঙ্গে পড়ে।
(vi) সেনাবাহিনীতে খাদ্য রপ্তানি
বাংলায় খাদ্যাভাব সত্ত্বেও সরকার যুদ্ধের সময় ভারত থেকে প্রচুর খাদ্য শস্য বাইরে রপ্তানি করে। প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত শস্য সরবরাহ করে সেনাদের চাহিদা নিশ্চিত করতে গিয়ে সেখানে বহু খাদ্যের অপচয় হত। ফলে খাদ্য সংকট আরও বৃদ্ধি পায়।
(vii) মজুতদারী
বাংলায় খাদ্য সংকটের আভাস পেয়ে বহু ব্যবসায়ীরা প্রচুর পরিমাণে খাদ্যশস্য কিনে গুদামে মজুদ করে এবং দুর্ভিক্ষের সময় বহু গুণ বেশি দামে তা বিক্রি করে। ফলে খাদ্যশস্যের মূল্য যথেষ্ঠ বৃদ্ধি পায় ও খাদ্যাভাব চরমে পৌঁছায়।
পঞ্চাশের মন্বন্তরের ফলাফল
1943-এর দুর্ভিক্ষের ফলে বাংলায় যে আর্থসামাজিক অবনমন ঘটেছিল তা ছিল মর্মান্তিক। এই দুর্ভিক্ষের ফলাফল ছিল ভয়ংকর—
প্রথমত, পঞ্চাশের মন্বন্তরে অনাহার ও বিভিন্ন রোগের প্রকোপে বাংলায় প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়। অন্তত 40 থেকে 70 লক্ষ বা আরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়।
দ্বিতীয়ত, মন্বন্তরের সময় বাংলায় চূড়ান্ত অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসে। দরিদ্র পরিবারগুলির দীর্ঘকাল ধরে সঞ্চিত অর্থ নিঃশেষ হয়ে যায় ও তারা ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করে।
তৃতীয়ত, ভয়াবহ পঞ্চাশের মন্বন্তর বাংলায় চূড়ান্ত মানবিক বিপর্যয় ঘটায়। খিদের জ্বালায় মানুষ অখাদ্য-কুখাদ্য খেতে শুরু করেছিল। এমনকি অভাবের তাড়নায় অনেকে স্ত্রী-সন্তানদের বিক্রি করে অন্যত্র চলে যায়।
চতুর্থত, এই অবস্থায় স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের নৈতিক অধঃপতন ঘটে। বাংলার মানুষ বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যে জড়িয়ে পড়ে ও তাদের পরিবারগুলিতে ভাঙন ধরে।
পঞ্চমত, কিছুটা দেরিতে হলেও ব্রিটিশ সরকার এই দুর্ভিক্ষ মোকাবিলার চেষ্টা করেছিল। ন্যায্য মূল্যে শস্য বিক্রয়, অন্য প্রদেশ থেকে খাদ্য আমদানি ইত্যাদি উপায়ে তারা দুর্ভিক্ষ রোধ করার চেষ্টা করেছিল। তবে প্রয়োজনের তুলনায় এই প্রচেষ্টা ছিল খুবই সামান্য।
ষষ্ঠত, দুর্ভিক্ষের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে সরকার দুর্ভিক্ষের পর ‘দুর্ভিক্ষ অনুসন্ধান কমিশন’ গঠন করে। এই কমিশনের রিপোর্টে প্রশাসনিক, পৌর ও সামরিক নীতির ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করা হয়।
উপসংহার
পঞ্চাশের মন্বন্তরে বাংলার দরিদ্র মানুষেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সঠিক সময়ে বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে প্রয়োজনীয় সহায়তা না পৌঁছানোয় বহু মানুষের মৃত্যু ঘটে। দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলগুলিতে সরকার খাদ্য সরবরাহ করলেও তার আগেই পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন – ভারতে রেলপথ প্রবর্তনের উদ্দেশ্য ও প্রভাব আলোচনা করো